Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিউইয়র্কের চিঠি

মামদানির নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মামদানির নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত

অনেক সময় আমেরিকানরা বলেন, ‘আমেরিকায় প্রকৃত অর্থে একটি মাত্র সিটি’ আছে এবং সে সিটির নাম নিউইয়র্ক। অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিয়ে যদি কেবল জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলেও দেখা যায়, আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি লসঅ্যাঞ্জেলেস বহু দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিটি হওয়া সত্ত্বেও এবং বিশেষ করে হলিউডের কারণে বিশ্বজুড়ে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও লসঅ্যাঞ্জেলেসের জনসংখ্যা নিউইয়র্কের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। নিউইয়র্ক সিটির জনসংখ্যা যেখানে প্রায় সাড়ে ৮৪ লাখ, সেখানে লসঅ্যাঞ্জেলেসের জনসংখ্যা ৩৯ লাখের নিচে। সাবওয়ে, বাস সার্ভিস ও সিটি ওয়াটার ট্রানজিটসহ নিউইয়র্ক সিটির বিশাল গণপরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার আমেরিকার অন্য কোনো বড় সিটিতে কল্পনাও করা যায় না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, নিউইয়র্ক সিটিতে মেট্রোপলিটন ট্রানজিট অথরিটি (এমটিএ) পরিচালিত সাবওয়ে ট্রেন এবং বাস ব্যবহারকারী যাত্রীর দৈনিক সংখ্যা ৭৬ লাখ। এছাড়া লং আইল্যান্ড রেল রোড (এলআইআরআর) ব্যবহারীর দৈনিক সংখ্যা সাড়ে ৮ লাখের বেশি।

নিউইয়র্ক সিটিতে সরকারি আবাসন ব্যবস্থা যে কোনো বৃহৎ আমেরিকান সিটির তুলনায় বিরাট। এমনও বলা হয়ে থাকে, নিউইয়র্ক সিটির সরকারি আবাসন ইউনিট চার লাখ, যা পার্শ্ববর্তী নিউ জার্সি স্টেটের জার্সি সিটি, রিচমন্ড ও পিটসবুর্গ সিটির জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। নিউইয়র্ক সিটিতে ১০ মিলিয়ন ডলারের সার্বজনীন প্রি-কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার আওতায় দুই বছর মেয়াদি শিশু পরিচর্যা ব্যবস্থা সিটির স্বল্প আয়সম্পন্ন পরিবারগুলোর জন্য এক আশীর্বাদ, যা আমেরিকার অন্যত্র অনুপস্থিত। নিউইয়র্ক সিটিতে এলিমেন্টারি থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত শিক্ষা দিতে পাবলিক স্কুলের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এ সিটিতেই আছে নয়টি স্পেশালাইজ্ড হাইস্কুল, যা সমগ্র আমেরিকায় ব্যতিক্রম। নিউইয়র্ক সিটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারীরাই কেবল স্পেশালাইজড স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ক্লাস এইটে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দু-তিন বছর আগে থেকে। হাইস্কুল শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব স্কুল থেকে ডিপ্লোমাধারীদের সিংহভাগ আমেরিকার আইভি লীগখ্যাত সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ লাভ করে অনেকটা অবলীলায়। নিউইয়র্কে নয়টি স্পেশালাইজ্ড স্কুল সমগ্র আমেরিকায় বিদ্বজনদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, এ ধরনের বিশেষায়িত স্কুলের অস্তিত্ব বৈষম্যমূলক বলে। স্কুলগুলোকে সাধারণ পাবলিক স্কুলে পরিণত করার দাবিও উঠছে। কিন্তু বাধা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও স্কুলগুলো টিকে আছে।

উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও নিউইয়র্ক সিটির স্থান আমেরিকায় ঈর্ষাতুল্য। ‘সিটি ইউনিটিভার্সি অব নিউইয়র্ক’, সংক্ষেপে ‘কিউনি’ অত্যন্ত স্বল্পব্যয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রদান করে। কিউনির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অন্য কোনো স্টেটে অবস্থিত হলে সেখানে পড়াশোনার ব্যয় কয়েকগুণ বেশি হতো। সিটির অন্যান্য কর্মযজ্ঞও বিশাল। সবকিছু সামলানো সিটি সরকারের জন্য কঠিন এক কাজ। সমগ্র দেশের চোখ এখন সিটির সদ্য নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট মেয়র জোহরান মামদানির দিকে; অনভিজ্ঞ এই তরুণ সিটির সবকিছু সামলে উঠতে পারবেন কিনা। তার জন্য সত্যিই কঠিন এক পরীক্ষা, যেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগাম হুমকি দিয়ে রেখেছেন, মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য ফেডারেল বরাদ্দ বন্ধ করে দেবেন। গত জুনে মামদানি ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আগামী বছরের ১ জানুয়ারি তিনি মেয়র হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কারা তাকে পদে পদে বাধার মুখে ফেলতে পারে। তার বিরুদ্ধে চরম কুৎসামূলক অপপ্রচার তো আছেই যে, তিনি নিউইয়র্কে ইসলামি শরিয়াহ আইন এবং উত্তর কোরিয়ার স্বেচ্ছাচারী শাসনের সমন্বয়ে সিটিতে কঠোর শাসন চালু করতে যাচ্ছেন।

একথা সত্য, নিউইয়র্ক সিটির শীর্ষ প্রশাসনিক পদে মামদানির আবির্ভাব রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মতো। তা সত্ত্বেও তার প্রতিপক্ষের কোনো অভাব নেই। এমনকি বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস, যিনি অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত এবং ফেডারেল তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি গ্রেফতার হতে পারেন এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি গোপনে ট্রাম্পের সঙ্গে সমঝোতা করে গ্রেফতার এড়ান, তিনিও মেয়র হিসাবে তার দায়িত্বের শেষ দিনগুলোতে মামদানির বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধা করছেন না।

তবে মামদানির নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাডামসের বিরুদ্ধে অভিযোগ কাজে লেগেছিল। তার প্রবল প্রতিপক্ষ নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোর বিরুদ্ধেও ছিল যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ। দৃশ্যত সবকিছুই ছিল মামদানির অনুকূলে। এখন দেখার পালা তিনি কীভাবে বিশাল এ নগরী পরিচালনা করেন। মামদানিকে মনে রাখতে হবে, নিউইয়র্ক স্টেট সরকারপ্রধান ক্যাথি সি হকুলকে তার সঙ্গে রাখা জরুরি। কারণ সাবওয়ে ও সিটি বাস এবং রিভার ট্রানজিট পরিচালিত হয় স্টেট কর্তৃক এবং এ প্রতিষ্ঠানের ওপর ঋণের বোঝা চেপে আছে। ভাড়া ফাঁকির পরিমাণ বার্ষিক ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এ পরিস্থিতিতে মামদানি বাসযাত্রীদের বিনাভাড়ায় পরিবহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কিন্তু থিয়োরি ও রিয়ালিটির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, মামদানি তা অনুধাবন করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিনা, এ প্রশ্নগুলো এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। স্টেট লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি এবং গভর্নর সম্মতি না দিলে মামদানির পক্ষে সিটির অনেক কিছু, যা অর্থব্যয়ের সঙ্গে জড়িত, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সেজন্য মামদানি সিটিবাসীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রতিটি বাস্তবায়নে তার প্রতি সিটিবাসীর যে আস্থা রয়েছে, তা পদে পদে প্রমাণ করতে হবে এবং তাদের আস্থাকে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া তার সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই।

নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সবচেয়ে আকর্ষণীয় নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল সিটির কর্মজীবী মানুষের জন্য প্রতিঘণ্টা ন্যূনতম মজুরি ৩০ ডলার নির্ধারণ করা। এটি বাস্তবায়ন করা তার পক্ষে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। মামদানির বিশ্বাস, তিনি তার মেয়াদকালে ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ৩০ ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হবেন। গত জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক সিটিতে ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১৬.৫০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০২৭ সালে এ মজুরি হার কার্যকর হওয়ার কথা। পাঁচ বছরে ন্যূনতম মজুরি প্রায় দ্বিগুণ করা মামদানির পক্ষে কঠিন এক কাজ হবে। মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও স্টেট লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বিল পাশ এবং গভর্নরের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। কারণ, এর সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনাকারী, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ইউনিয়ন ও অন্যান্য পক্ষের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। কোনো একটি পক্ষের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে বিষয়টি আদালতে গড়াতে পারে, যার অর্থ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়া অথবা আদৌ বাস্তবায়িত না হওয়া। মামদানি যখন তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন, তখন তিনি করপোরেশন এবং ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির কথা বলেছেন, যা তাকে প্রায় ১০ বিলিয়ন রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে তার ধারণা। তার কর বৃদ্ধির প্রস্তাব পাশ করাতেও স্টেট অ্যাসেম্বলি ও গভর্নর ক্যাথি হকুলের মুখাপেক্ষী হতে হবে। অতএব, মামদানি জনপ্রিয় ভোটে মেয়র বিজয়ী হলেও তার সামনে যে বাধার পাহাড়, সেগুলো ডিঙ্গাতে তাকে অসীম ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম