বাঁশের কেল্লা : ত্রিমুখী শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে বাঁশের কেল্লা খড়কুটার মতোই উড়ে যাওয়ার কথা। উড়ে গিয়েও ছিল। কিন্তু তাই বলে প্রতিরোধকারীরা হার মানেননি। শেষ রক্তবিন্দুটুকু ঢেলে দিয়ে তারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুমহান আদর্শ রেখে গিয়েছিলেন। সৈয়দ মীর নিসার আলী তথা তিতুমীরের নেতৃত্বে ১৮৩০-এর দশকের বাঁশের কেল্লা নির্মাণ কেবল একটি কৃষক বিদ্রোহ ছিল না; এটি ছিল বাংলার গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশ শাসন, হিন্দু জমিদারদের শোষণ এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে এক তীব্র মুসলমান প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রকাশ। সর্বোপরি এটি ছিল বাংলার মাটিতে ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার চেষ্টা।
তিতুমীরের বিদ্রোহের বীজ প্রোথিত ছিল তৎকালীন বাংলার ত্রিমুখী শোষণের মধ্যে : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল ও জমিদারদের অত্যাচার, ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক শোষণ এবং ধর্মীয় নির্যাতন।
ব্রিটিশদের ১৭৯৩ সালে আরোপিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এখানকার আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। হিন্দু জমিদার শ্রেণির জমির স্থায়ী মালিকানা পাওয়ার কথা জোর দিয়ে বলা হলেও এ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পদক্ষেপের ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলা সমাজ কাঠামোর মূলে কঠোর আঘাত হানা হয়েছিল। মোগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি, যা ছিল মূলত কর বা খাজনা মওকুফ করা জমি। এ ভূমি বিভিন্ন কারণে অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দান করা হতো। ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তীর্থস্থানের মতো জনহিতকর কাজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ ধরনের নিষ্কর ভূমি অনুদান দেওয়া হতো। এখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা হতো এর মাধ্যমে। এটি ছিল রাষ্ট্রের একটি দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। মোগল আমলে এ ব্যবস্থা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলার মোট জমির এক-তৃতীয়াংশই ছিল লাখেরাজ এবং অন্যান্য ধরনের নিষ্কর সম্পত্তি। ব্রিটিশ সরকারি নথিপত্রে এ জমিকে ‘বাজে জমি’ বলা হতো। কারণ এখান থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পেত না। ব্রিটিশদের দরকার ছিল নগদ লাভ। সেজন্য এসব জমিও বাজেয়াপ্ত করে জমিদারদের দিয়ে দেওয়া হয়।
লাখেরাজদারদের মধ্যে মুসলমানরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারাই এ বাজেয়াপ্তকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান উইলিয়াম হান্টার তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’-এ এই পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘এর ফলে শত শত মুসলমান পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, যা এতদিন লাখেরাজ ওয়াকফের জমির ওপর নির্ভরশীল ছিল, মারাত্মক আঘাত পেল। মুসলমান আলেমসমাজ প্রায় ১৮ বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।’
জমিদাররা ব্রিটিশদের কাছে নির্দিষ্ট খাজনা দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য প্রজাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার শুরু করে। পুরো জমিদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল জবরদস্তির ওপর। যত বেশি কর, তত বেশি বিলাসী জীবনযাপনের সুযোগ। ফলে জমিদারদের লোভ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। জমিসংশ্লিষ্ট করারোপ করেই জমিদাররা ক্ষান্ত হতো না। ব্রিটিশরা বর্ণহিন্দুদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিত, মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানো হয়েছে। তখন চলত হিন্দু রাজত্ব। এ হিন্দু রাজত্ব নানাভাবে প্রকাশ পেত। এর অংশ হিসাবেই অনেক জমিদার মুসলমান প্রজাদের ধর্মীয় আচার-আচরণের ওপর অযৌক্তিক কর ধার্য করতেন। যেমন-দাড়ি রাখার ওপর কর, মসজিদ বা মক্তব নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণ বা এর ওপর জরিমানা আরোপ।
ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক শোষণও কম ছিল না। তারা তাদের একচেটিয়া বাণিজ্যের স্বার্থে স্থানীয় কুটির শিল্প (বিশেষত বস্ত্রশিল্প) ধ্বংস করেছিল। যে বস্ত্রশিল্প ছিল বিশ্বের সেরা, সেটা একেবারেই শেষ হয়ে গেল। ফলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ে এবং দারিদ্র্য প্রকট হয়। এর সঙ্গে ছিল নীলচাষ। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপে বস্ত্রশিল্পে প্রয়োজনীয় নীলের জোগান দিতে হতো বাংলার কৃষকের। কৃষক খাদ্য উৎপাদন বাদ দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য হতো।
তিতুমীর কিন্তু প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক পথেই সমস্যাগুলোর সমাধান চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। এমন এক প্রেক্ষাপটে জমিদারদের অত্যাচার এবং ব্রিটিশদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে ধর্ম সহায়ক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মক্কা থেকে হজ করে ফিরে আসার পর তিনি প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে ইসলামের বিশুদ্ধ চর্চার দিকে মনোযোগ দেন। এ ধর্মীয় পুনর্জাগরণই বাংলার মুসলমান কৃষকের মধ্যে এক নতুন ঐক্য ও প্রতিরোধ চেতনা জাগিয়ে তোলে। তারা অনুভব করে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের পাশাপাশি ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর আঘাত সহ্য করা যাবে না। তিতুমীর তার অনুসারীদের নিয়ে একটি ‘মুজাহিদ’ (ধর্মযোদ্ধা) দল গঠন করেন, যা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে একটি সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। তাদের প্রতিরোধ চেতনার প্রধান লক্ষ্য ছিল শোষণের অবসান ঘটানো এবং এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে মুসলমানরা নির্ভয়ে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার ভোগ করতে পারবে।
নারিকেলবাড়িয়ায় বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা নির্মাণের পর তিতুমীর কার্যত ওই অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন এবং নিজেকে বাদশাহ হিসাবে ঘোষণা করেন। তার অধীনে একজন প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য প্রশাসনিক পদও সৃষ্টি করা হয়। এটি ছিল বাংলার মাটিতে ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার চেষ্টা।
বাঁশের কেল্লা প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও জমিদারদের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল। তারা এ বিদ্রোহকে কঠোর হাতে দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী আধুনিক কামান, বন্দুক ও গোলাবারুদ নিয়ে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। কেল্লার ভেতরে থাকা বিদ্রোহীরা লাঠি, তলোয়ার ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আধুনিক কামানের গোলার মোকাবিলা করে। এ অসম যুদ্ধে তিতুমীর শহীদ হন এবং তার অনুসারীদের অনেককে হত্যা বা বন্দি করা হয়।
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার পতন হলেও এটি বাংলার মুসলমান কৃষকের মধ্যে শোষণমুক্তির ও আত্মমর্যাদার যে চেতনা সৃষ্টি করেছিল, তা পরবর্তীকালে ফরায়েজি আন্দোলন এবং ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এটি ছিল বাংলার গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় চেতনা ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক সফল সমন্বয়।
প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ এবং তাদের দোসর জমিদারদের বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কেন বিদ্রোহ করেছিল? এরিক জে. হবসবমের মতে, বিদ্রোহের মূল তাৎপর্য নিহিত রয়েছে কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা ও অবাধ্যতায়। অনুরূপভাবে, কার্লোস ভেলেজ-ইবানেজ যুক্তি দিয়েছেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজেদের সামাজিক স্বাধীনতার অনুভূতি প্রকাশ করে।
বিপুল আত্মত্যাগ সত্ত্বেও উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে কৃষক বিদ্রোহগুলো যথাযথ স্থান পায়নি। এর কারণ হিসাবে ইতিহাসবিদ রনজিৎ গুহ স্বীকার করেন, ইতিহাসবিদরা কৃষকের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা ও তাতে নিহিত বিরোধগুলোকে গুরুত্ব দেননি। বরং তারা এ চেতনা ও জাগরণকে কেবল নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও এ প্রসঙ্গে বলেন, ভারতের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলনগুলোকে এমনভাবে তুলে ধরা উচিত, যেখানে কৃষক সচেতন ঐতিহাসিক বিষয় হিসাবে উপস্থিত থাকেন। এসব বিদ্রোহ দেখিয়ে দেয় যে, ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ও অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তি একই সঙ্গে গ্রামীণ সমাজের মানুষকে সংগঠিত করতে পারে।
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ছিল ব্রিটিশ এবং তাদের দোসর জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের সাহস, ঐক্য ও প্রতিরোধের এক দৃঢ় প্রতীক। ফলে যথার্থভাবেই তিতুমীর আজও বাংলার মানুষের কাছে সাহস, আত্মত্যাগ এবং শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে শ্রদ্ধেয়।
মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক

