শতফুল ফুটতে দাও
টার্মিনাল নির্মাণ : বিদেশি বিনিয়োগ কতটা উদ্বেগজনক
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অর্থনীতি শাস্ত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ধারণাটি খুবই বিতর্কিত। কয়েক দশক আগে বামধারার অর্থনীতিবিদরা বিদেশি বিনিয়োগকে একটি দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। এই মতাবলম্বী অর্থনীতিবিদরা এখনো বেশ তৎপর। তবে ১৯৭৮ সালের পর কমিউনিস্ট চীন বিদেশি বিনিয়োগ আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে। কিন্তু এ আমন্ত্রণ শর্তহীন ছিল না। চীনের সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর লাগাম টেনে ধরে তাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কিন্তু চীনের বিশাল বাজার ও সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো চীনে বিনিয়োগের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের ফলে চীনা অর্থনীতি প্রভূতভাবে উপকৃত হয়েছে। চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গতি পেয়েছে। একইভাবে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদার মনোভাব দেখিয়েছে। এখন ভিয়েতনামের অর্থনীতি তরতর করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। চীন এবং ভিয়েতনাম, উভয় দেশই সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্টশাসিত। তাদের তুলনায় আমাদের দেশের বামপন্থিরা কি উন্নত মানের বামপন্থি? তাই যদি হতো, এরা ইতোমধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে সক্ষম হতো। কিন্তু বাস্তব অবস্থা যা, এদের সাংগঠনিক ক্ষমতা দিনের পর দিন ক্ষয় হয়ে চলেছে।
এ কথা সত্য যে, বহুজাতিক করপোরেশনগুলো যে দেশে যায়, সে দেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মওকা খোঁজে। এতে আতিথ্যপ্রদানকারী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়। একসময় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে কলা চাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখত। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার ফলে ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। এসব সামরিক সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এসব দেশে গণতন্ত্র উচ্ছেদ করা হয় এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির একটি বড় ব্যবসা ছিল কলা নিয়ে। তাই যেসব দেশে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি পদচিহ্ন রেখেছিল, সেসব দেশকে ‘কদলি প্রজাতন্ত্র’ বা Banana Republic বলা হতো।
কিন্তু চীন ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সেভাবে ঘটেনি। চীন ও ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট শাসকরা এসব বিদেশি বিনিয়োগকারীর ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং দেশ দুটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো আপত্তিকর কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিকর আচরণ থেকে মুক্ত থাকার অন্যতম শর্ত হলো জাতীয় সরকারকে হতে হবে শক্তিশালী এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে প্রবল দক্ষ। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদীরা, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীনকে মোকাবিলা করার যে নীতি গ্রহণ করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উপকূলে এবং বঙ্গোপসাগরের তীরে একটি বন্দর বহুজাতিক সংস্থার হাতে তুলে দিতে গিয়ে যথেষ্ট সাবধানী হতে হবে। অন্যথায় বিপদও ঘটতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে মধ্যপন্থি অর্থনীতিবিদদের যুক্তি হলো, যদি বিদেশি বিনিয়োগ কয়েকটি ফারাক (Gap) হ্রাস করতে পারে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আমন্ত্রণ করা যেতে পারে। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের অনেক ব্যাপারেই ঘাটতি থাকে। এ ঘাটতিগুলো কিছুটা হলেও পূরণের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। উল্লেখযোগ্য ফারাকগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রযুক্তিগত ফারাক, ব্যবস্থাপনা ফারাক, উদ্যোগের ফারাক, সঞ্চয়ের ফারাক, কর্মসংস্থানের ফারাক, প্রতিযোগিতা শক্তির ফারাক ইত্যাদি। যদি বিদেশি বিনিয়োগের দ্বারা এ ফারাকগুলো হ্রাস করা যায়, তাহলে যথোপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে বিদেশি বিনিয়োগ আমন্ত্রণ করা যৌক্তিক হবে বৈকি।
এ মাসেই চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নিয়ে ডেনমার্কের মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে ৩৩ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী দুপক্ষকে নানা শর্ত মেনে চলতে হবে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ কনসেশন চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। ৩৩ বছর মেয়াদি এ চুক্তির নানা বিষয় কেন লুকিয়ে রাখা হবে, তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। স্বচ্ছতা না থাকলে সমালোচনা হতেই থাকবে, যদিও বিনিয়োগকারী এপিএম টার্মিনাল্সের ব্যবসায়িক বিষয়গুলো ছাড়া চুক্তির অন্যান্য বিষয় প্রকাশে বাধা নেই বলে জানা গেছে।
দৈনিক প্রথম আলোর সূত্রে জানা যায়, চুক্তির পর পরিচালনার বিভিন্ন ধাপে বিনিয়োগ করতে হবে এপিএম টার্মিনাল্সকে। এ সময় বন্দরের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। এপিএম টার্মিনাল্সের ঘোষণা অনুযায়ী টার্মিনাল উন্নয়নে তারা ৫৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। চুক্তির পর তাদের বিনিয়োগ শুরু হয়েছে।
টার্মিনাল চালু হলে শুরু হবে কনটেইনারপ্রতি আয় ভাগাভাগি। গড়ে ৮ লাখ একক কনটেইনার ধরে (প্রতিটি কনটেইনারের দৈর্ঘ্য ২৩ ফুট) ৩০ বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ একক কনটেইনার উঠানো-নামানো হতে পারে। এতে বন্দরের আয় হতে পারে ৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বাইরে বহির্নোঙরে জাহাজ আসার পর থেকে টার্মিনালে ভেড়ানো পর্যন্ত যত মাশুল আছে, তা পাবে বন্দর। হিসাব করে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে বন্দরের আয় ৩০ বছরে ৭০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। মেয়াদ শেষে বন্দর লালদিয়া টার্মিনালের অবকাঠামোসহ ফেরত পাবে।
এপিএম টার্মিনাল্সের বিনিয়োগ উঠতে শুরু করবে বাণিজ্যিক পরিচালন কার্যক্রম শুরুর পর। টার্মিনালের প্রধান আয় জাহাজ থেকে কনটেইনার উঠানো-নামানো ও কনটেইনার রাখা বাবদ মাশুল। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসির সমীক্ষা ও বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির হিসাব করে দেখা যায়, এ দুই খাতে প্রতি বক্স কনটেইনারে (২০ ফুট ও ৪০ ফুট কনটেইনার একটি ধরে) সম্ভাব্য মাশুল আয় হতে পারে ১৭৩.৬৬ ডলার। এপিএম টার্মিনাল্স ৮ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামা করবে। বন্দরের হিসাবে ৮ লাখ একক কনটেইনারে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪ হাজার ৪২৬ বক্স কনটেইনার (প্রতি বক্স কনটেইনারে ১.৫৮ একক কনটেইনার)। এ হিসাবে এপিএমটির বছরে সম্ভাব্য আয় হতে পারে ৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, ৩০ বছরে দাঁড়াবে ২৬৩ কোটি ডলারে। এর বাইরে কনটেইনার খুলে পণ্য সরবরাহের নানা সেবা ব্যবহার বাবদ আয় করবে টার্মিনালের বিদেশি অপারেটর। এ আয় থেকে বিনিয়োগ ও পরিচালন ব্যয়ের খরচের পর মুনাফা তুলতে হবে এপিএমটিকে। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে এপিএমটির ব্যয়ের একটি অংশ পাবেন বাংলাদেশি কর্মীরা। এটাই হলো বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানজনিত উপযোগ।
বাংলাদেশে বন্দর খাতে এটি ২য় কনসেশন চুক্তি। এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে বন্দর খাতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের সঙ্গে চুক্তি হয়। আওয়ামী লীগ আমলে করা ওই চুক্তিরও বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি। সে সময় ওই চুক্তি নিয়ে অনেককে সরব হতে দেখা যায়নি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালস বিশ্বখ্যাত। এ কাজে তাদের দক্ষতা আছে। ফলে তা দক্ষভাবে টার্মিনাল চালালে পণ্য রপ্তানিতে সময় কমবে। চুক্তিতে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু না থাকলে এবং ব্যবসার খরচ না বাড়লে এ চুক্তিকে আমরা ইতিবাচক হিসাবেই দেখছি।’
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। এ বন্দরটিকে মাফিয়াগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে রেখে অভাবনীয় দুর্নীতিতে লিপ্ত। এমন অপকর্ম না হলে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় অন্তত দ্বিগুণ হতো। বিশেষ বিশেষ রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মাফিয়াগোষ্ঠী এ বন্দরটিকে তাদের অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এসব গোষ্ঠী জাতীয় অর্থনীতির উন্নতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। একটি বন্দরের দক্ষতা বোঝার জন্য যে সূচক ব্যবহার করা হয়, তা হলো Just Time Index বা JTI. চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট লেগেই থাকে। কনটেইনার নামানো-উঠানোতে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। এর ফলে জেটিআই বিবেচনায় বিশ্বের অনেক বন্দর থেকে পিছিয়ে আছে, যে কারণে জাতীয় অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতাই যদি লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ অদক্ষ অনেক খাত বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। বিদেশিরা এসব খাতের ব্যাপারে উৎসাহী হয় না। এমনিতেই বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম এবং স্থবির। এ থেকেই বোঝা যায়, সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
বাংলাদেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অতি প্রয়োজনীয়। ট্রাম্পের পালটা শুল্ক নীতি মোকাবিলা এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ কোনো বাধা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগের শর্তগুলো জনসমুখে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।
এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি কেন করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চুক্তিটির বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, তাতে এই চুক্তিকে দেশবিরোধী বলার সুযোগ নেই। আমার উদ্বেগের বিষয় হলো এ চুক্তি ব্যবহার করে যদি কোনো রকমের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা হয়, তা প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে যথোপযুক্ত শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

