Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা : জুলাই বিপ্লবের গর্ব হাইজ্যাক

Icon

মেজর (অব.) মনজুর কাদের

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা : জুলাই বিপ্লবের গর্ব হাইজ্যাক

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ফ্যাসিবাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যারা একদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন রাজপথে, তারা এখন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসকের উত্থান যাতে না ঘটে, তা রুখে দেওয়ার জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কোনো প্রবণতা নেই অনেকের মধ্যে। যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন করতে করতে বয়ঃবৃদ্ধ হয়ে গেছেন, অতীতে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি, তাদের অনেকেই অতিদ্রুত নামের পেছনে যাতে ‘সংসদ-সদস্য’ পদ লিখতে পারেন, তার জন্য ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছেন।

ভাবখানা এরকম, দেশ এবং গণতন্ত্র বাঁচানোর চিন্তাভাবনা পরে করা যাবে, কিন্তু খালি মাঠে গোল (আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাতীয় পার্টিবিহীন রাজনৈতিক মাঠ) দিয়ে সংসদ সদস্যপদ জীবনে একবার হলেও পেতে হবে এবং তা এখনি হতে হবে। তাদের প্রশ্ন : ফেব্রুয়ারি মাস আসতে কেন এত সময় লাগছে?

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচন গত ৫৪ বছরে বহুবার অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু সেই সংসদ দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে পারেনি বরং নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে এক মহাদুর্নীতিবাজ সমাজব্যবস্থা, তৈরি হয়েছে দুষ্ট ব্যবসায়ী চক্র (অলিগার্ক), যারা রাজনৈতিক অঙ্গন স্থায়ীভাবে কিনে নিয়েছে। এ চক্র সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এরা সবাইকে অর্থ দেয় (অনেকেই একে চাঁদাবাজি বলে); যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন, তারাই এ দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী চক্রের ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়েছে, এখান থেকে বাইরে আসার কোনো শক্তি তাদের নেই।

২২ পরিবারের স্থলে কয়েক ডজন অলিগার্ক

পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এ বিজয়ী হওয়া গেছে; কিন্তু এখন ফ্যাসিস্টসৃষ্ট কয়েক ডজন নব্য দুষ্ট ব্যবসায়ী পরিবারের (অলিগার্ক) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও কোনো ফলাফল পাওয়া গেল না। গত ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমেও এদের প্রভু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও এদের নবউত্থান হয়েছে, এরা অসৎ রাজনীতিকদের ছায়াতলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, ফলে জনগণ এদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, কোনো পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

এ ধরনের গণবিরোধী, গণবিধ্বংসী, সমাজবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছিল এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অনেক সংস্কার কমিশন গঠন করে বিশদ প্রস্তাব পেশ করেছে, যার বৈধতা (ভ্যালিডেশন) দেওয়ার কথা ছিল গণভোটের মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটে রাজি নয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

গণভোট ও সংসদ নির্বাচন

ফ্যাসিস্ট কর্তৃক সৃষ্ট গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা থেকে গণমুখী বন্দোবস্তের দিকে যেতে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন, দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একইদিনে, একই সময়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া নিঃসন্দেহে হিমালয় পর্বত হেঁটে পার হওয়ার মতো কঠিন কাজ।

তবুও কিছু কিছু রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একইদিনে, একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট করা চ্যালেঞ্জিং বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। রাজধানীর গুলশানে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের আয়োজনে নির্বাচনবিষয়ক এক কর্মশালায় ২২ নভেম্বর তিনি বলেন, একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট করার জন্য এমন মুখোমুখি পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন কখনো পড়েনি।

টু-ইন-ওয়ান : গণভোট ও নির্বাচন একসঙ্গে

জাতির উদ্দেশে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নভেম্বর ১৩, ২০২৫-এ দেওয়া ভাষণে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিন্তাভাবনা থাকলেও তা সময়ের স্বল্পতার কারণে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

টাইম অ্যান্ড স্পেস

তবে হাতে থাকা সময় এবং বাস্তব অবস্থা (টাইম অ্যান্ড স্পেস) বিবেচনা করলে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একইসঙ্গে অনুষ্ঠান করা অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পেছন থেকে সময় গণনা (ব্যাকওয়ার্ড ক্যালকুলেশন অফ টাইম) করলে বোঝা যাবে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা কতটা অসম্ভব :

* ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬-এ (বৃহস্পতিবার) উভয় নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলে হাতে সময় থাকে মাত্র ৭০ দিন।

* শুক্র, শনিবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদ গেলে থাকে ৪৭ দিন।

* ৪৭ দিনের মধ্যে ডাবল ব্যালট পেপার ছাপানো, ডাবল ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থা করা, ভোটকেন্দ্র মেরামত, প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা, গণভোটের প্রয়োজনীয়তা এবং গণভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে ভোটারদের অবহিতকরণ-সব মিলিয়ে ডাবল নির্বাচনের মহাযজ্ঞের বৈতরণী পার হওয়া ভার্জিন নির্বাচন কমিশনের (যাদের অতীতে কোনো নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতা নেই) পক্ষে সম্ভব কিনা, তা দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যারা দ্রুত নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তারা এসব প্রতিকূলতা কীভাবে মোকাবিলা করবেন, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সাধারণ নির্বাচন ও গণভোট

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মাত্র দুটি দেশে গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৫ সালে ইতালীয় গৃহযুদ্ধ এবং অক্ষশক্তি থেকে ইতালির মুক্তির পরের বছর রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের ওপর একটি জনপ্রিয় গণভোট ডাকা হয় এবং এর ফলে ভোটাররা রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের বিকল্প বেছে নেন। ১৯৪৬ সালে ইতালির গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য ইতালির সাধারণ নির্বাচন একইদিনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালের ১০ জুন সুপ্রিমকোর্ট অফ ক্যাসেশন ফলাফল ঘোষণা করে: ১২,৭১৭,৯২৩ জন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে এবং ১০,৭১৯,২৮৪ জন নাগরিক রাজতন্ত্রের পক্ষে। এ অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর ফেস্টা ডেলা রিপাবলিকা কর্তৃক স্মরণ করা হয়।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ বেলিজে সাধারণ নির্বাচন এবং গণভোট (রেফারেন্ডাম) একইদিনে হয়েছে : সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল বেলিজের সংসদের (House of Representatives) জন্য। একইদিনে একটি সংবিধান-রেফারেন্ডামও হয়েছিল-প্রশ্ন ছিল: ‘বেলিজের সিনেট নির্বাচন করা হবে কি?’ রেফারেন্ডাম ছিল পরামর্শমূলক এবং তার প্রস্তাবটি অবলম্বন করা হয়নি, কারণ ভোটদানের পরিমাণ কম ছিল।

আশি বছর আগে ইতালির গণভোট কোনো উদাহরণ হতে পারে কিনা, তা ভেবে দেখার বিষয়। এছাড়া ১৯৪৬ সালে ইতালির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ। অপরদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হলো ১৮ কোটি। বিপুলসংখ্যক ভোটার একই সময়ে ডাবল ভোট প্রদান করবেন, যা নিঃসন্দেহে জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সংস্কার নিয়ে ষড়যন্ত্র

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর জনগণ আশা করেছিল, দ্রুত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হবে; কিন্তু তা হয়নি, বরং কৌশলে অনেকেই প্রকাশ্যে সংস্কারের পক্ষে থেকে গোপনে সংস্কারের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করেছেন। গণভোটকে অনেকে ফালতু বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে জনসমক্ষে উপহাস করেছেন।

সরকার বলেছে, গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’সূচক হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এ প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

সংবিধান রচনা নিয়ে সমস্যা

নির্বাচন এবং গণভোট-উত্তর পরিস্থিতি কী রকম জটিল হতে পারে, তার উদাহরণ হলো পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের এলএফও-এর অধীনে নির্বাচন। এ দুটি নির্বাচনের পর সংবিধান রচনার কথা ছিল; কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে দুটো অ্যাসেম্বলির পরিণতি কী হয়েছিল, তা সবার জানা আছে।

রাজনৈতিক শক্তি নেই

সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংস্কারের জন্য সরকার ভরসা করেছিল ফ্যাসিবাদীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। কিন্তু ফ্যাসিবাদীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ফ্যাসিস্টসৃষ্ট দুষ্ট ব্যবসায়ী চক্রের পাতা ফাঁদে আটকে পড়েছেন-যারা ফ্যাসিস্টকে সাড়ে পনেরো বছর টিকিয়ে রেখেছিল। এ দুষ্ট চক্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থায়ন করছে। অতি গোপনে তাদের প্রিয় ফ্যাসিস্টকে পুনর্বাসিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যা গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যোগ হয়েছে নতুন উপাদান। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও রাজনৈতিক মাঠে গুরুতর প্রভাব ফেলবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা উঠেছে। সম্ভাব্য প্রভাব এবং ঝুঁকি হলো, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তির কারণে আওয়ামী লীগ স্পেস খুঁজে বের করে উত্তেজনা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি করতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ডের রায় ‘আবেগগত তাপমাত্রা’ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং সহিংসতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়ছে। ইতোমধ্যে রায় ঘোষণার কারণে বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরদার হওয়ার খবর এসেছে।

এর বিপরীতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও গভীর হতে পারে-অনেকে এটিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল করার উদ্দেশ্য হিসাবে দেখছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা রয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের কারণে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না এবং রাজনীতিতে তার ফিরে আসা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বৈদেশিক চাপ

মানবাধিকার গ্রুপ, যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার বিচারের স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দেশগুলো রাজনৈতিক পুনঃসংহতি (National reconciliation) এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান করতে পারে। বিশেষ করে ভারত, যেখান থেকে শেখ হাসিনা নির্বাসনে আছেন, এক ধরনের দ্বিধায় পড়তে পারে-প্রত্যর্পণ, নিরাপত্তা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সব বিষয়ই জটিল হয়ে উঠেছে।

মনোনয়ন জটিলতা

সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বর্তমান বড় দলগুলোর অস্থিরতা বা সহিংসতা ভোটারদের মধ্যে ভীতি তৈরি করতে পারে, যা তাদের উৎসাহ বা অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকেই মনে করেন, ভোট ও নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি ন্যায্য না হয়, তাহলে ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নির্বাচনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ইতোমধ্যেই এর কয়েকটি চিহ্ন দেখা দিচ্ছে, যেগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ এবং ভোট প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।

বিপ্লবী চেতনা ধ্বংস

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনাকে প্রতিবিপ্লবীরা ধ্বংস করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ২৫ নভেম্বর বড় একটি রাজনৈতিক দলের একজন বড় নেতা বলেছেন, ‘যদি বলি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ড. ইউনূস থাকবেন না, ইট ইজ পসিবল’। এ নেতা যে শক্তির ওপর ভর করে ড. ইউনূসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন, সেই শক্তি ২৪ ঘণ্টা নয়, ২ ঘণ্টার মধ্যে যে কাউকেই ফেলে দিতে পারে। তবে সেই শক্তি ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে, নিলে পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে কিনা, সে প্রশ্নও আছে।

ফিরে আসার স্বপ্ন

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ফাঁসি থেকে বেঁচে যে কোনো উপায়ে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়, যেমন তার পিতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নিশ্চিত ফাঁসি থেকে বেঁচে এসে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু তার পিতাকে সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অত্যাচার এবং দুঃশাসনের কাফফারা দিতে হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে।

আধিপত্যবাদী ভারত শেখ হাসিনাকে সরাসরি ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। তাই তারা ফ্যাসিবাদীবিরোধী দলগুলোর ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আবারও সব প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গোপনে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যবহার করে ভারত ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিজেদের তাঁবেদারদের বিজয়ী করার চেষ্টা করবে, এ কাজে ব্যর্থ হলে তারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন

২০১৪ সালের একতরফা সাধারণ নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপি এবং জামায়াত জোট তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যার ফলে ১৫৩ জন প্রার্থীকে আওয়ামী লীগ সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করেছিল। শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে ২০১৪ সালের নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য তৎকালীন বিরোধী দলগুলো যে আন্দোলন করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব নিয়মনীতি, লজ্জা-শরম উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ১৫৩ জন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হ?ওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনের আগেই বিজয়ী হয়েছিলেন; কিন্তু সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বর্তমান অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, তা স্পষ্ট নয়। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয়, তাহলে ভোটাররা যে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’

২০১৪ সালের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হলো ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবী শক্তিকে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়া যেমনটি বলেছিলেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’।

ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য মদদপুষ্ট হয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সার্বিক অবস্থার অবনতি করার জন্য অনবরত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন, যার ফলে দেশের মধ্যে একটি প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে চলেছে। এরা জুলাই বিপ্লবের গর্ব হাইজ্যাক করেছে। এ পরিস্থিতিতে গত ৫৪ বছরের গতানুগতিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান অগ্রাধিকার পাবে, নাকি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচিকে ‘বৈধ’ (ভ্যালিডেট) করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করে বর্তমান জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে-এ বিষয়টির মীমাংসা কীভাবে হবে, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আধিপত্যবাদী শক্তি দ্বারা বাংলাদেশের নিষ্পেষিত ও বঞ্চিত মজলুম জনসাধারণ।

মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম