Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

মুজিববর্ষের উৎসব যেন মুজিবকে ছাড়িয়ে না যায়

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুজিববর্ষের উৎসব যেন মুজিবকে ছাড়িয়ে না যায়

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। এখন যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এ বছর (২০২০) তার বয়স হতো একশ’ বছর। তার এ জন্মশতবার্ষিকী সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে এবং বিদেশেও সাড়ম্বরে পালনের ব্যবস্থা হয়েছে। ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উৎসব চলছে।

মুজিববর্ষ পালনের জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে অভিনন্দন জানাই। এ সরকারে মহাজোটের অন্য কোনো শরিক দলের অংশগ্রহণ নেই। তাই এ সরকারকে মহাজোট সরকার বলছি না। বলছি আওয়ামী লীগ সরকার। এখন মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল কী করবে, তা তারাই জানে।

মহাজোটে তারা মন্ত্রিত্ব না পেলেও থাকবেন মনে হয়। যদি না থাকেন তাহলেও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে মহাজোটের ভেতরের ও বাইরের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে তাতে যোগ দেয়া অথবা দলীয়ভাবে দিবসটি উদ্যাপনের ব্যবস্থা করা।

সরকারেরও উচিত হবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে মহাজোটের শরিক দল এবং মহাজোটের বাইরের ইচ্ছুক দলগুলোকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া। বঙ্গবন্ধু এখন আর কোনো দলীয় নেতা নন। ১৯৭১ সালে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় নেতায় উন্নীত হন।

১৯৭৩ সালে ৭৩ জাতির জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের (ঘঅগ) ত্রয়ী নেতার একজন হয়ে বিশ্বনেতার মর্যাদা পান। ইতঃপূর্বে ন্যামের নেতা পদে গণ্য হতেন নেহেরু, নাসের ও টিটো। প্রথম দু’নেতা নেহেরু-নাসেরের মৃত্যুর পর ন্যামের নেতা বলে চিহ্নিত হন মুজিব, ইন্দিরা ও টিটো।

প্রায় একই সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেন হিমালয়ের সঙ্গে এবং আলজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুমেদীন তাকে সম্বোধন করেন ‘রসূলে সালাম’ (শান্তির দূত)।

বঙ্গবন্ধুর ইরাক সফরের সময় ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন তাকে সোনালি কালিতে ছাপানো পবিত্র কোরআনের এক খণ্ড উপহার দেন এবং ডেইলি ‘বাগদাদ টাইমস’ মন্তব্য করেন, ‘এতকাল অবিভক্ত বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে পরিচিত ছিল ‘টেগোরস বেঙ্গল’ নামে। এখন বহির্বিশ্বে স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচিত মুজিব’স বাংলাদেশ (মুজিবের বাংলাদেশ) নামে।’

বিবিসির জনমত সমীক্ষায় বঙ্গবন্ধু বিশ শতকের সেরা বাঙালি বলে নির্বাচিত হন। তাতে রবীন্দ্রনাথকে খাটো করা হয়েছে বলে এক বাংলাদেশি নিম পণ্ডিত মন্তব্য করেন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত ড. তপন রায় চৌধুরীকে (তিনি তখন অক্সফোর্ডে অবস্থান করছিলেন) জিজ্ঞেস করা হলে ড. চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এখন আর বাঙালি কবি নন।

তিনি সর্বভারতীয় কবি। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাকে বিশ্বকবিও বলা হয়। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হলে কোনো অন্যায় হয় না।’

বিশ্বে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং করছেন এ রকম বহু মহানায়ক আছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু তার দেশকে স্বাধীন করেননি, একটি বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তা এবং তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে পুনর্জীবন দান করেছেন। এর কোনো তুলনা নেই।

তার জন্মশতবার্ষিকী যথার্থভাবে পালন প্রতিটি বাঙালির- বাংলা ভাষাভাষীর কর্তব্য। বাঙালিরা উৎসবে মাতুন তাতেও আপত্তি নেই; কিন্তু একটি মাত্র সতর্ক বাণী- মুজিববর্ষের উৎসব যেন মুজিবকে অতিক্রম করে না যায়, তার আদর্শকে ভুলে ব্যক্তিকে নিয়ে উৎসব না করে।

বাংলাদেশে যদি তা হয় সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। মুজিববর্ষ পালনের পরিকল্পনা থেকে উদ্যাপন পর্যন্ত দেশের শীর্ষ আমলারা অবশ্যই যুক্ত থাকবেন। কিন্তু তাতে থাকতে হবে গণসম্পৃক্ততা। দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নির্দেশে কাজ করবেন; বুদ্ধিজীবীরা শীর্ষ আমলাদের নির্দেশে কাজ করবেন না।

করলে কী হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালনের আলো-ছায়ার অনুষ্ঠানটিতে। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী যে ক’জন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে তাদের প্রত্যেকে বলেছেন, এ আলো-ছায়ার অনুষ্ঠানটিতে অপরিপক্বতার ছাপ রয়েছে প্রচুর। এ অনুষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বাড়ায়নি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের কমিটিতে রয়েছেন, এমন এক বুদ্ধিজীবী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনারা থাকতে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানে এসব কী হচ্ছে? তিনি বললেন, ‘দত্ত কারও ভৃত্য নয়, সঙ্গে এসেছি।’ জিজ্ঞেস করলাম, কথাটার মানে কী? তিনি বললেন, কমিটিতে নাম আছে বটে, কমিটির কোনো সভায় ডাক পড়ে না।

আমরা ‘সাক্ষী গোপাল’। তার কথা শুনে মনে পড়ল, এ সরকারি কমিটির আমিও একজন সদস্য। কিন্তু কমিটির কোনো সভায় ডাক পড়েনি। ডিসেম্বরে ঢাকায় গিয়ে ১০ দিন ছিলাম। কমিটির কর্তা আমলাদের কেউ কোনোদিন ডেকেও জিজ্ঞেস করেননি, এ অনুষ্ঠানমালা সম্পর্কে আমার কোনো প্রস্তাব-পরামর্শ আছে কি না। আমরা ‘নামের খসম আজিজ মিছির।’

পাঠক বন্ধুরা ভাববেন না, আমলাদের কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে এসব কথা লিখছি। ক্ষুব্ধ অবশ্যই হচ্ছি, তা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপিত হবে কি না, সে কথা ভেবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলো-ছায়ার অনুষ্ঠানটি দেখে মনে হয়েছে, যারা এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছেন তারা কোনোদিন কোনো মহানায়ক- যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মাও সে তুং, সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে তৈরি আলো-ছায়ার অনুষ্ঠান অথবা চলচ্চিত্র দেখেননি।

আমি একবার আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে লস এঞ্জেলেসে গিয়েছিলাম। একটু কাছেই সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের স্মৃতি সংরক্ষণের মিউজিয়াম। বিশাল এলাকাজুড়ে নিক্সন মিউজিয়াম। নিক্সন সচ্ছল ঘরের সন্তান ছিলেন না। একতলা একটি অতি সাধারণ ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

সেই দালানটি অবিকল সে রকম আছে (টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের পুরনো বাড়িটিতে যেমন রংচং মাখানো হয়েছে, তেমনটি নয়)। তারপর এলাকাজুড়ে নিক্সন মিউজিয়াম। পাশেই নিক্সন এবং নিক্সনপত্নীর ঘাসে ঢাকা কবর।

আমি সেই ঘাসে ঢাকা কবরে পা রেখে হাঁটছিলাম। একজন নিরাপত্তারক্ষী বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, এটা লেট প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং তার পত্নীর কবর। আমি সঙ্গে সঙ্গে কবরের ওপর থেকে সরে এসেছি।

মিউজিয়াম হলে নিক্সনের লাইফ সাইজ স্ট্যাচু। বিশাল স্ক্রিনে তার বিভিন্ন বক্তৃতাদানের চলচ্চিত্র চলছে। তার স্বকণ্ঠের বাণী সারা দিন বাজছে। আরেকটি কক্ষে তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণের দৃশ্য রঙিন আলো-ছায়ার খেলার মধ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে। ডিজনি স্টাইলে তাকে ছায়ামূর্তি হিসেবে দেখানো হয়।

বোস্টন শহরে প্রেসিডেন্ট কেনেডি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছেন সে বাড়িটি দেখেছি। তার মিউজিয়ামে কী বিশাল লাইব্রেরি ঘর। তিনি যে ক্লাবে যেতেন সে ক্লাবে গেছি। সমুদ্রে যে নৌকায় চড়তেন, সেটি এখনও সমুদ্র পাড়ে বাধা রয়েছে। তাতে চড়েছি।

মনে মনে দারুণ মুগ্ধ হয়েছি গেটিসবার্গে লিঙ্কনের মিউজিয়ামে গিয়ে। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের কাছে যে থিয়েটারে লিঙ্কন আততায়ীর হাতে নিহত হন সেই থিয়েটারে গেছি। তিনি যে চেয়ারে বসে নিহত হয়েছেন, সেই চেয়ারে বসেছি। থিয়েটারটিকে তার চেয়ার, পর্দা, টিকিটসহ সেই আগের মতো রাখা হয়েছে।

থিয়েটারের পর্দায় আলো-ছায়ায় প্রতি সপ্তাহে একবার রিক্রিয়েট করা হয় গেটিসবার্গে সেই ঐতিহাসিক ভাষণদানরত প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনকে। প্রস্তরগাত্রেও লিপিবদ্ধ সেই ভাষণ- ‘The government for the people, by the people, of the People.’

আমি গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের বিশাল স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে কল্পচোখে দেখেছি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল লাইফ সাইজ ভাস্কর্য। একটি প্রস্তর বেদিতে ভাস্কর্যটি বসানো। প্রস্তর বেদিতে ৭ মার্চের ভাষণটি বাংলা ও ইংরেজিতে খোদিত।

এ ভাস্কর্যকে ঘিরে আরও চার শহীদ জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের ছোট ভাস্কর্য বসানো। এ ময়দানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু পাঠাগার ও প্রেক্ষাগৃহ। বঙ্গবন্ধুর শুধু ৭ মার্চের ভাষণ নয়, বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলো তার কণ্ঠে প্রতিদিন বাজছে।

আলো-ছায়ার খেলায় দেখানো হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন। সঙ্গীতগৃহে বাজছে জাতীয় সঙ্গীতসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশাত্মবোধক গান। একটি প্রস্তরে জাতীয় পতাকাকে তার রং ও সূর্যসহ বসানো হয়েছে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশেই।

আমার এ স্বপ্ন ভঙ্গ হতে, কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসতে দেরি হয়নি। ফিরে এসে দেখি গেটিসবার্গে লিঙ্কনের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর কল্পিত ভাস্কর্যের সামনে নয়।

মনে পড়ল মাত্র কয়েক বছর আগে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে তার পারিবারিক পুরনো ভবনটির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আগেও এসে দাঁড়িয়েছি। দেখে তখন মনে হয়েছে ভবনটির সংস্কার প্রয়োজন।

সংস্কার এমনভাবে করতে হবে যাতে এর রং, গঠনকৌশল অবিকল আগের মতো থাকে। তাতে নতুনত্ব যোগ করা না হয়। শেক্সপিয়রের চারশ’ বছরের পুরনো বাড়ি একই চেহারায় রাখা গেলে বঙ্গবন্ধুর একশ’ কী দেড়শ’ বছরের বাড়ি মেরামত করে একই চেহারায় রাখা যাবে না কেন?

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক পুরনো বাড়িটির চেহারা দেখে নজরে পড়ে বাড়িটির সেকালের ছোট ইটের গাঁথুনি কোনো কোনো স্থানে এখনকার বড় ইটের গাঁথুনি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে (কেন, ছোট ইট কি তৈরি করা যেত না?)।

আর ভবনটির সারা অঙ্গে মেরুন অথবা অনুরূপ কোনো রঙের ছড়াছড়ি। মনে হবে আশি বছরের কোনো বুড়িকে রঙিন শাড়ি পরানো হয়েছে।

নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সংস্কারের কাজটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী হয়তো তার প্রিয়ভাজন আমলা এবং বিল্ডার্স কোম্পানিকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে জাতির পিতার প্রতি তার দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। হায়রে আমার বাংলাদেশ!

লন্ডন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

লন্ডন মুজিববর্ষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম