ওয়ার কোর্স : মুক্তিযুদ্ধের দূরদর্শী পরিকল্পনা
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এ সময়টি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। হানাদার বাহিনীকে চতুর্মুখী আক্রমণে নাস্তানাবুদ করে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল আমাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। এসব দুঃসাহসী অপারেশনের ভাগীদার ছিল বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স। তাই আজ তুলে ধরেছি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কোর্স বা ‘পাইওনিয়ার কোর্সে’র (First Bangladesh War Course) ইতিকথা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় এক লাখ সুপ্রশিক্ষিত সৈন্যের বিরুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাত্র পাঁচটি ইউনিটের ভগ্নাংশ ও স্বল্পসংখ্যক অফিসারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দেশমুক্ত করা একটি দুঃস্বপ্ন বৈ কিছু নয়। কিন্তু তারপরও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দুঃসাহসী ও চৌকস বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা পৃথিবীর মায়া-মহব্বত পরিত্যাগ করে শুধু প্রতিরোধ যুদ্ধই শুরু করেননি; অসংখ্য ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক-যারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন-তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণও দেওয়া শুরু করেন তারা। এ বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল সুপ্রশিক্ষিত কমিশনড অফিসারের। এ চিন্তা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের দূরদর্শী প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর মাথায় আসে ওয়ার কোর্স চালু করার পরিকল্পনা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত গণহত্যা শুরু হলে ২৫ মার্চ রাতেই বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ঐতিহাসিক মিটিংয়ের মাধ্যমে যুদ্ধকে একক নেতৃত্বের (জেনারেল এমএজি ওসমানী) অধীনে এনে যুদ্ধক্ষেত্রকে বিভিন্ন সেক্টর/অঞ্চলে ভাগ করে কমান্ডারদের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি জাতীয় সরকার গঠনের পরামর্শ বা সুপারিশ করা হয়। সে অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল রাজনৈতিক নেতারা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন; যা মুজিবনগর সরকার নামেও পরিচিত। ১৭ এপ্রিল এ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) শপথ গ্রহণ করেন। এ সরকার সেনাবাহিনীর ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া মিটিংয়ের সব পরিকল্পনার অনুমোদন দেয় এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে।
২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং যুদ্ধে সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এ সরকারের অধীনে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপলাভ করে এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধ একটি সমন্বিত রূপলাভ করে এবং সেনাবাহিনী ও সর্বস্তরের জনসাধারণের মুক্তিবাহিনীর মনোবল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সারা দেশকে প্রথমে ছয়টি ও পরবর্তীকালে ১২-১৫ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্সে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। কিন্তু লক্ষাধিক পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাত্র পাঁচ ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শক্ত প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলা সহজসাধ্য হবে না বলে জেনারেল ওসমানী ও ঊর্ধ্বতন কমান্ড বুঝতে পারেন। তাই এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব আরও সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তাও ভীষণভাবে অনুভূত হয়। এ ছাড়া আসন্ন বর্ষাকালের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তারা।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও কয়েকটি ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড গঠন করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেজন্য প্রয়োজন হয় সুপ্রশিক্ষিত কমিশনড অফিসারের। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার একটি ‘নিয়মিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, যার প্রথম ধাপ হিসাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি মিলিটারি একাডেমির। অস্থায়ী ‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা-জেনারেল ওসমানীর বিশেষ অনুরোধে অতঃপর বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানের লক্ষ্যে কমিশনড অফিসার তৈরির প্রশিক্ষণের জন্য একটি অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারত সরকারও এতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের অনুমোদনে শিলিগুড়ির উত্তর-পূর্বে, জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স রিজার্ভ ফরেস্টের পার্বত্য জঙ্গলে ভুটান সীমান্তের কাছে অবস্থিত ছিল মূর্তি প্রশিক্ষণ শিবিরটি। ভুটান হয়ে ভারতে প্রবেশকৃত মূর্তি নদীর পাশে অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমি স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ওই স্থানে আগে থেকেই ‘মুজিব ক্যাম্প’ নামে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলছিল। এটিকে নতুন করে সংগঠিত করা হয় ‘মুজিব উইং এবং ‘ভাসানী উইং’ নামে। ‘ভাসানী উইং’ হয় অস্থায়ী একাডেমি। এ একাডেমিতে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রচলিত ‘ওয়ার কোর্সে’র আদলে ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ‘বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ চালু করার সিদ্ধান্তও অনুমোদিত হয়। প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতীয় বাহিনীর বিভিন্ন র্যাংকের চৌকস অফিসার।
দুর্দশাগ্রস্ত জীবন: এখানে পদাতিক ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের থাকার জন্য আগে থেকেই দুটি পুরোনো টিনশেড বিদ্যমান ছিল। ক্যাডেটদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ফলে তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করতে হয়। তারা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে এ কষ্ট মেনে নেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ব্রিগেডিয়ার আরপি সিংহ ক্যাপ্টেন অবস্থায় এখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে স্বল্প সময়ে কমিশনড অফিসার তৈরির জন্য প্রচলিত ‘ওয়ার কোর্সের’ অভিজ্ঞতা বা কনসেপ্ট মাথায় ছিল। সে আদলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ‘ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি’ (IMA) ও ‘অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি’র (OTA) প্রশিক্ষণ সিলেবাস ও সূচিকে কনডেন্সড করে এ একাডেমিতে ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল ক্যাডেটদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও দুঃসহ একটি বিষয়।
বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের শুভ সূচনা: একাডেমির প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের জন্য জেন্টলম্যান ক্যাডেট নির্বাচন করার লক্ষ্যে জুন মাসের প্রথমেই প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট কর্নেল মুহাম্মদ আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ নির্বাচন কমিটি সব সেক্টর ও যুদ্ধরত ইউনিটগুলো পরিদর্শন করেন এবং সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসার হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন যুদ্ধরত তরুণদের মধ্য থেকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কেবল সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার পদে যোগদানে ইচ্ছুকদের বাছাই করা হয়। শিক্ষিত, মেধাবী, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন দুর্ধর্ষ চৌকস ৬০ জন তরুণকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামালও নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ) থেকে ৪৭ পিএমএ লং কোর্সের একজন জেন্টলম্যান ক্যাডেট পালিয়ে এসে এ কোর্সে যোগ দেন। এই ৬১ জন গেরিলা ক্যাডেটকে আধুনিক সমর শিক্ষায় পারদর্শী করে কমিশন প্রদানের লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশ-ভুটান সীমান্তের মূর্তিতে অবস্থিত অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রেরণ করা হয়। ৩০ জুন থেকে দিন-রাত ১৪ সপ্তাহের কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং প্রশিক্ষণ শুরু হয় ‘ফার্স্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের’ ক্যাডেটদের। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সামরিক নেতৃত্ব তৈরি করার লক্ষ্যেই যুদ্ধরত এ যুবকদের নিয়মিত সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের সব কৌশল, অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও শারীরিক শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলা হয়।
প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজ: ৯ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। সফলভাবে ১৪ সপ্তাহের টানা কঠিন প্রশিক্ষণ ও পরিশ্রমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবরূপ পায় এই দিনে। ঐতিহাসিক এ দিনে পাসিং আউট প্যারেড বা সমাপনী কুচকাওয়াজ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নির্মিত এয়ার ফিল্ডে সকাল সাড়ে ৮টায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীর সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক এ কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি হিসাবে প্যারেড পরিদর্শন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী, অন্যান্য মন্ত্রী, উইং কমান্ডার আবদুল করিম খন্দকার (পরবর্তী সময়ে বিমানবাহিনী প্রধান ও মন্ত্রী), ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মুহাম্মদ খাদেমুল বাশার (পরবর্তীকালে বিমানবাহিনী প্রধান) এবং মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সেনা অফিসাররা। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসাবে কমিশন লাভ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের ৬১ জন দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কেবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম স্বাক্ষরিত ‘পার্চমেন্ট কমিশন সার্টিফিকেট’ (বিশেষ ধরনের উন্নতমানের কাগজ) দিয়ে তাদের ভূষিত করা হয়েছিল; যা ছিল চলমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সামরিক একাডেমিতে কঠোর প্রশিক্ষণের পর সফলতার নিদর্শন।
সাধারণ পাসিং আউট প্যারেড: All Rounder বা চৌকস ক্যাডেট হিসাবে এ কোর্সে প্রথম স্থান অধিকার করে ʻC-in-Cʼs Caneʼ অর্জন করেন সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সাইদ আহমেদ (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল, ডিভিশন কমান্ডার ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত)। একটি দেশ সৃষ্টির সূচনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত গৌরবময় এই ঐতিহাসিক দিনে ছিল না কোনো জাঁকালো আনুষ্ঠানিকতা, ‘ফ্যানফেয়ার’, ‘মিলিটারি ব্যান্ড’ এবং সাধারণ ‘ভোজের’ আয়োজন! এ গেরিলা অফিসারদের ছিল না কোনো মাথার টুপি, বেল্ট, কোনো ধরনের সাজ-সজ্জা; দেওয়া হয়েছিল কেবল ‘খাকি ট্রাউজার ও শার্ট’ এবং একজোড়া ‘জঙ্গল বুট’। বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এত সাধারণ পাসিং আউট প্যারেড হয়তো ছিল একমাত্র এটিই। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সাপ্তাহিক নিউজ লেটার ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয় ১১ মে থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৫ অক্টোবরের সংখ্যায় প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ‘পাসিং আউট প্যারেড’ নিয়ে ফটো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
কমিশন লাভের পরপরই এই দুর্ধর্ষ অফিসারদের বদলি করা হয় যুদ্ধরত বিভিন্ন সেক্টর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে। তারা সবাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটে বা পদাতিক বাহিনীতে যোগ দেন। এ তরুণ অফিসারদের অসাধারণ রণনৈপুণ্যে ও সমরকৌশলে যুদ্ধক্ষেত্রের পুরো চিত্রই পালটে যায়। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ তীব্র গতি লাভ এবং তা দেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। সম্মুখযুদ্ধের সব ফ্রন্টে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের অন্যতম উজ্জ্বল এক অফিসার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। কমিশন পাওয়ার পর তিনি জেনারেল এমএজি ওসমানীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব বা এডিসি হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন এবং দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা যায়।
হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে এ কোর্সের তিনজন অফিসার শাহাদতবরণ করে শহিদের মর্যাদা লাভ করেন; তারা হলেন শহিদ বীরউত্তম লেফটেনেন্ট আবু মঈন মুহাম্মদ আশফাকুস সামাদ, শহীদ বীরবিক্রম লেফটেনেন্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম এবং শহিদ লেফটেনেন্ট সেলিম কামরুল হাসান। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য ও দুঃসাহসিক অবদানের জন্য এ কোর্সের একজন ‘বীরউত্তম’, দুজন ‘বীরবিক্রম’ এবং ১৭ জন ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব অর্জন করেন। অতি সম্ভাবনাময় এ কোর্সের সবাই ছিলেন দারুণ মেধাবী, অকুতোভয় যোদ্ধা ও চৌকস সামরিক নেতা। আমাদের সেনাবাহিনীতে যখন মাত্র ২৮/২৯ জন জেনারেল ছিলেন-তাদের মধ্যে এ কোর্সেরই ছিলেন চারজন : মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ বীরপ্রতীক, মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান বীরপ্রতীক, মেজর জেনারেল মাসুদুর রহমান বীরপ্রতীক এবং মেজর জেনারেল মরহুম খোন্দকার মো. নূরন্নবী। পরে এ কোর্সের মুখ আরও উজ্জ্বল করেন দুজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, দুজন রাষ্ট্রদূত, একজন সচিব, ছয়জন পিএইচডিধারী এবং দুজন এমপি/একজন মন্ত্রী পদে আসীন হয়ে। ইতোমধ্যে ৬১ জন সদস্যের ২০ জনই তাদের ইহজীবন শেষ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গেছেন। তারা এবং প্রথম ওয়ার কোর্সের সব অফিসার হলেন আমাদের সামরিক বাহিনীর উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের দ্বারা একটি নতুন দেশ সৃষ্টির পর দেশ ও সামরিক বাহিনী গঠনে তাদের অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com
