যেসব কারণে বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদ
শেখ রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিয়ে বিচ্ছেদের আধিক্য বা সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ইদানীং পত্র-পত্রিকায় নানা রকম খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সমাজসচেতন ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতামতও পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এসব লেখায় যেমন বিচ্ছিন্নভাবে বিয়ে বিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান আছে, তেমনি আছে বিভিন্নজনের বিভিন্ন ধরনের মত ও ব্যাখা। তবে সব লেখায় একটি অভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে, যা হলো বর্তমানে বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিবৃদ্ধি।
আচার, অনুষ্ঠান, রীতিনীতির পার্থক্য থাকলেও মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য অনাদিকাল থেকে বিয়ে পৃথিবীর সব সমাজের অতি পুরোনো প্রাতিষ্ঠানিক আচার। বিয়ে নারী-পুরুষের যুগলবন্দি হওয়ার একটি আইনসম্মত বৈধ মাধ্যম। বিয়ে নামক সেতুবন্ধের মাধ্যমে সূচনা হয় দুজনের নতুন জীবনের।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে মনীষীরা সময়ে সময়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ দিয়েছেন। নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ভাষায়- নর ও নারী উভয় মিলে একই বস্তু হয়। নর ও নারীর ভিন্ন কোনো পরিচয় নেই, একই পরিচয়-মানুষ। দুজনে দুজনার! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি...।
কিছু নাহি ভয় জানি নিশ্চয় তুমি আছ, আমি আছি।
পাড়ি দিতে নদী হলে ভাঙে যদি ছিন্ন পালের কাছি
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব-তুমি আছ আমি আছি।
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যতদিন দোহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, থোক মহীয়সী-তুমি আছ, আমি আছি।
আজ থেকে চারশ বছর আগে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রখ্যাত রাজনীতিক, কূটনীতিক ও নৈতিক চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, Wives are
young men’s mistresses companions for middle age: and old men’s nurses. ইংরেজি ‘Mistress’ শব্দটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে Mistress বলতে ভালোবেসে প্রেমডোরে আবদ্ধ কোনো নারীকে বোঝায়। বেকনের মতে, বিয়ের শুরুটা হবে ভালোলাগা-ভালোবাসা থেকে। যৌবনে যাকে প্রণয়াবদ্ধ করা যায়, সে-ই প্রৌঢ়ত্বে পরম বন্ধু হতে পারে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বেকনের তত্ত্বের সত্যতাও প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে, যখন দেখি প্রেমের বিয়েও প্রথম বিয়ে বার্ষিকীর আগে ভেঙে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জন ব্লেইকের উক্তি স্মরণযোগ্য : Marriage is the death-bed of love. পরিণয় পূর্ব প্রেমোচ্ছ্বাস ও আবেগমথিত মধুর সম্পর্ক পরিণয়-পরবর্তী রূঢ় বাস্তবতা ও পারস্পরিক দায়িত্ব পারিপার্শ্বিক পার্শ্বচাপ ও প্রতিকূলতার কারণে ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। শুরু হয় বোঝাপড়ার নতুন পর্ব।
প্রেমের বিয়েতে প্রথম থেকে উভয়ের প্রতি উভয়ের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে বিধায় আশাহত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে কালজয়ী ঘটনার নায়ক গ্রেট ব্রিটেনের রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড দুবার তালাকপ্রাপ্ত আমেরিকান নারী ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড সিম্পসনকে পাওয়ার জন্য রাজত্ব পরিত্যাগ করে পরবর্তী জীবন তার সঙ্গে অতিবাহিত করেছেন। অ্যাডওয়ার্ড ১৯৩৬ সালের ১১ ডিসেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেন ‘I have found it impossible to carry on the heavy burden of responsibility and to discharge the
duties of king as I would wish to do without the help and support of the woman I love.’ অ্যাডওয়ার্ড তার সম্পর্কের গভীরতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন, সম্পর্কের মূল্যায়ন করেছেন এবং পরবর্তীকালে আমৃত্যু সিম্পসনের সঙ্গে বসবাস করেছেন। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন সিম্পসনের সঙ্গে তার বোঝাপড়া সঠিক হবে। ভালোবাসার সম্পর্ককে তিনি রাজত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে পৃথিবীতে এমন আরও দুটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম বিত্তশালী বিল গেটস্ কন্যা জেনিফার ভালোবেসে বিয়ে করেছেন মিসরের একজন সাধারণ যুবক নায়েল নাসেরকে। অ্যাডওয়ার্ডের মতো জাপানের রাজকন্যা মাকো রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেছেন একজন সাধারণ ছেলেকে বিয়ে করে। তাদের সম্পর্ক কতটা স্থায়ী হবে, তাদের মোহমুক্তি হবে কিনা, সেটি ভবিষ্যতের বিষয়। তবে আভিজাত্য ও বিত্ত-বৈভবের স্বর্গ থেকে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে ধূলির ধরায় নেমে কোনো সম্পর্কের মূল্যায়ন করে তারা যে নির্ভীকচিত্তের পরিচয় দিয়েছেন, তার মূল্য অনেক।
ফিরে আসি বেগম রোকেয়ার কথায়-নর ও নারী মিলে একই বস্তু হয়। পানি ও চিনি মিলে শরবত হয়; কিন্তু তেল ও পানি একই পাত্রে দীর্ঘদিন থাকলেও নতুন কিছু হয় না। স্ব-স্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে তেল ও পানি হিসাবে নিজের আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখে। একে অপরের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য একে অপরের কাছে কাচের মতো স্বচ্ছ থাকা উচিত। পত্রিকায় গোপালগঞ্জের একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘বিয়েটা যেভাবেই হোক-নিজের পছন্দ বা পারিবারিকভাবে-এমন কোনো বিষয় গোপন করা উচিত নয়, যা পরে জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। যদি কোনো কিছু গোপন করে থাকেন, সে জানতে পারলে ভাববে আপনি ঠকিয়েছেন।’
আরেকজন লিখেছেন, প্রতারণা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও অসম বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। বিয়ের আগে একে অপরের আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক অবস্থান-সবকিছু সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল হওয়া উচিত এবং প্রাসঙ্গিক সবকিছুই সুস্পষ্টভাবে একে অন্যকে জানানো উচিত। অন্যথায় বিয়ের মধ্যেই সৃষ্টি হতে পারে ভাঙনের কারণ। বিয়ের পর একে অপরের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানকে খাটো করে মন্তব্য করলে নিঃসন্দেহে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে, যা থেকে ধীরে ধীরে ডালপালা বিস্তারলাভ করে উভয়ের সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলবে।
বিচ্ছেদের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বিয়েবহির্ভূত তৃতীয় নারী/পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক। এ ত্রিভুজ প্রেমের কারণে সমাজে বহু অঘটন ঘটছে, এমনকি নারী/পুরুষ একে অপরকে খুন করতেও দ্বিধা করছে না। যতই নিন্দা করা হোক, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং খোলামেলা মেলামেশা ও দেখা-সাক্ষাতের কারণে অসংযত আবেগের বশে সৃষ্ট পরকীয়া নামক সামাজিক ব্যাধির অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। এটি একটি প্রকট সমস্যা।
বিয়ে নামক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একজন ছটফট করছেন, অন্যজন পেছন থেকে টেনে ধরছেন। এ ক্ষেত্রেও একে অন্যের কাছে স্বচ্ছ হওয়া দরকার। একে অন্যের সঙ্গে খোলামেলা কথা না বলে গোপনে গোপনে চক্রান্ত করে বক্র পথে হাঁটলে শুধু নিজের নয়, পুরো সংসারের এবং একইসঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনেরও মারাত্মক ক্ষতি হবে। আজীবনের জন্য ভিকটিম হবে সন্তান।
কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবী সহযোগী চে গুয়েভারা কিউবায় আলিদা নামক তার একজন নারী বিপ্লবী সহযোগীর প্রেমে পড়েন। চে তখন বিবাহিত ও এক কন্যাসন্তানের জনক। তিনি কিউবায় তার স্ত্রী হিলডা গার্ডিয়াকে পুরো ঘটনা জানিয়ে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তাব করেন। হিলডা সম্মতি দেন, বিচ্ছেদ হয় এবং চে আলিদাকে বিয়ে করেন।
পরবর্তীকালে চে হিলডাকে কিউবায় এনে তাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এখানে চে যদি গোপনে আলিদাকে বিয়ে করতেন বা হিলডা যদি বিয়ে বিচ্ছেদে সম্মতি না দিতেন, তাহলে হয়তো ঘটনা ভিন্নদিকে প্রবাহিত হতো, যা কারও জন্যই শুভ হতো না। একটি নির্মম বাস্তবতা হলো, বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি এবং যে কোনো একপক্ষ চুক্তিভঙ্গ করার অধিকার রাখে। আরও মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, এ চুক্তি ছিন্ন করার জন্য যখন একজন অন্যজনকে খুন করার মতো নির্মম সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বিচ্ছেদই শ্রেয় বলে প্রতীয়মান হয়।
দাম্পত্য জীবনে পরস্পর পরস্পরকে নিবিড়ভাবে বুঝতে হবে। দাম্পত্য জীবন প্রতিযোগিতার স্থান নয়। একজন অন্যজনের কাছে থাকবে স্বচ্ছ কাচের মতো। এখানে সহযোগিতা ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। সমঝোতার জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, আর এ ত্যাগ যদি সবসময় এক পক্ষের হয়, তাহলে সেটা সমঝোতা নয়, অন্য কিছু। আজকের সমাজে নারীরা আগের মতো মুখ বুজে সহ্য করে না, তাদেরও মত আছে, স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা আছে-এ সত্য মেনে নিতে হবে।
বিয়ের শুরুতেই বা বিয়ের মধ্যে যাতে ভাঙনের কারণ নিহিত না থাকে সে জন্য উভয় পক্ষকে, দুই পরিবার এবং বিশেষ করে পাত্র-পাত্রীর উচিত খোলামেলা আলোচনা করে একে অন্যের সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক সব বিষয় জেনে নেওয়া এবং কোনোরূপ ভুল তথ্য যেন কোনো পক্ষ পরিবেশন না করে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতন হওয়া দরকার।
দুটি মানুষের পাশাপাশি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য দরকার মনস্তাত্ত্বিক মিল। দুজনের দুটি ভিন্ন হৃদয় যদি মিলে একাকার না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে ত্যাগ ও সমঝোতার সেতুবন্ধ নাও হতে পারে। বাস্তব জীবনে কখনো কখনো স্বল্প পরিচিত কাউকে অনেক আপন মনে হয়, আবার বহুদিনের পরিচিত কাউকে সে রকম কাছের মনে হয় না।
বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর পছন্দই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে, অন্য কিছু কোনোরূপ অনুঘটক হিসাবে সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া অনুচিত। স্বামী ও স্ত্রীকে মনে রাখতে হবে, জীবনের পথ সবটাই আনন্দে ভরা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অর্থাভাব, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, জরা-রোগ, সামাজিক সমস্যা আছে, থাকবে; কিন্তু যে কোনো দুর্বিপাকে দুজনকে সমান তালে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলতে হবে।
নারী ও পুরুষের সম্পর্ক হবে প্রীতি ও ভালোবাসার; সমতা, সমঝোতা ও সহমর্মিতার। নারী ও পুরুষ হবে একে অন্যের পরিপূরক ও সম্পূরক। নারী ও পুরুষের সম্পর্ক হবে অভিন্ন, অচ্ছেদ্য, পরম বন্ধুত্বের, আস্থা ও বিশ্বাসের, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার; যেখানে বন্ধন হবে অটুট।
শেখ রফিকুল ইসলাম : মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর
