দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের একটি ঘটনা
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে এডল্ফ হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার সীমান্তসংলগ্ন সুদেতেনল্যান্ড এলাকায় একটা স্বল্পমাত্রার যুদ্ধ শুরু করেন এবং কিছু সময়ের মধ্যেই এলাকাটি দখল করে নেন। তার যুক্তি, ওই এলাকায় জার্মান ভাষাভাষী অনেক মানুষ আছে।
একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অংশ দখল করা ভয়ংকর এক কাণ্ড; কিন্তু সেটা নিয়ে ইউরোপের অন্য দেশের তেমন কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না। কিন্তু ঘটেছে আরও ভয়ংকর ঘটনা। এর পর জার্মানির মিউনিখে হিটলারের সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির সরকারপ্রধানরা সেটা সমর্থন করে চুক্তি করেন। এ চুক্তি মিউনিখ চুক্তি নামে পরিচিত।
অত্যন্ত সমালোচিত এ চুক্তিটিকে অনেকে বিশ্বাসঘাতকতাও বলেন (মিউনিখ বিট্রেয়াল)। এর কারণ হচ্ছে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার সামরিক চুক্তি ছিল অর্থাৎ আক্রান্ত হলে ফ্রান্স সামরিকভাবে চেকোস্লোভাকিয়ার পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ফ্রান্স রীতিমতো চুক্তি করে ওই অঞ্চলটি তুলে দেয় জার্মানির হাতে।
এমন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার পেছনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো, বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুক্তি ছিল-তারা ইউরোপে একটি বড় যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে। এ চুক্তির পর হিটলারও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন ইউরোপের আর কোনো ভূমির ওপরে তার কোনো দাবি নেই। কিন্তু আমরা জানি হিটলারের ভূমির নেশা এতে তো কমেইনি বরং বেড়েছিল। তিনি এরপর পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেন। শেষ পর্যন্ত পোল্যান্ড দখল করার জন্য অভিযান শুরুর পর তো রীতিমতো একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের এ ঘটনা প্রমাণ করে, স্বৈরশাসকদের ছাড় দিয়ে লাভ হয় না। বরং ছাড়ের ঘটনা তাদের আরও সাহসী, আরও আগ্রাসী করে তোলে। এটা যে সত্য এ সময়েও, সেটার প্রমাণ আমরা পেলাম ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেত্রে। পুতিন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন এজেন্ট। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেন।
এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হওয়ার কারণে কেজিবি যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন চাকরি হারান ভ্লাদিমির পুতিন। অথচ এই পুতিনই মাত্র ১০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে রাশিয়ার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই বহুবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি। পুতিন এটাকে কোনোদিনও মেনে নিতে পারেননি। এর পাশাপাশি তার আরও কিছু বক্তব্য শুনলে একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানা পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন দেখেন।
পুরোপুরি একই দেশ হয়ে না গেলেও পুতিনের স্বপ্ন হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সবকটি প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার স্যাটেলাইট স্টেট হয়ে থাকবে। তাদের অবশ্যই রাশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) এবং সামরিক জোট কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনেরও (সিএসটিও)-এর সদস্য হতে হবে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক কোনো দেশ ন্যাটো তো বটেই, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়াও মেনে নিতে রাজি নন পুতিন।
২০০৮ সালে জর্জিয়া ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আলোচনা শুরু করার পর দেশটিতে আক্রমণ করে রাশিয়ান বাহিনী। রাশিয়া যখন জর্জিয়া আক্রমণ করে তখন জর্জিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাসভিলি আশা করেছিলেন ন্যাটোর সদস্য না হলেও ন্যাটো অন্তত তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে জোরালো সমর্থন দেবে। কিন্তু হয়নি সেটা। সপ্তাহখানেক স্থায়ী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দক্ষিণ ওসেটিয়া আর আবখাজিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জর্জিয়া। অঞ্চল দুটিতে কার্যত রাশিয়ার শাসন জারি আছে।
এরপর ২০১৪ সালে রাশিয়া সবার নজরের সামনে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। রাশিয়ার এ আচরণের জন্য আমেরিকা তার ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিতে গিয়েও পারেনি ইউরোপীয় মিত্রদের অনীহার কারণে। এরপর তিনি যা করলেন তা চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে হিটলার যা করেছিলেন, তার কথা মনে করিয়ে দেয়।
পুরো ইউক্রেনে রুশভাষীর সংখ্যা ২০ শতাংশের কাছাকাছি হলেও পূর্বাঞ্চলের দনবাস অঞ্চলে রুশভাষীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। রুশ ভাষাভাষীদের মদদ দিয়ে ইউক্রেনের ওপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন পুতিন। দনবাস অঞ্চলের সীমান্তে ইউক্রেনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং এটা এখন প্রকাশিত সত্য সেই অঞ্চলের রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেনারাও যুদ্ধ করছে। আট বছর স্থায়ী যুদ্ধে অন্তত ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, যখন এ যুদ্ধ শুরু হয়, তখনো ইউরোপ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে রাজি ছিল না। তারপর সর্বশেষ যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে তখন ইউরোপও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার পথে যায়। রাশিয়ার প্রতি ইউরোপের এ নির্লিপ্ততার প্রধান কারণ জ্বালানির জন্য দেশটির ওপর অতি নির্ভরতা।
ইতিহাস একদিন নিশ্চিতভাবেই বলবে রাশিয়ার মতো একটা রাষ্ট্রের ওপর চরমভাবে জ্বালানিনির্ভর হওয়া ছিল পশ্চিমাদের জন্য এক ভয়ংকর কৌশলগত ভুল। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যুদ্ধ শুরুর পর। সেই যুদ্ধ থামানোর নামে ইউক্রেনের স্বার্থের ঘোর বিরোধী মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মধ্যস্থতা করে ফ্রান্স, জার্মানি। নিজের একটি এলাকার দখল হারিয়ে ভয়ংকর একটি যুদ্ধের চাপে পড়ে ইউক্রেন সেই চুক্তিতে রাজি হয়।
ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকার করেন না পুতিন। এ নিয়ে তিনি দীর্ঘ লেখা লিখেছেন, এমনকি সর্বশেষ ভাষণেও বলেছেন কথাটা। তাই ইউক্রেনকে দখল করে পুরো নিজের অংশ করে ফেলবেন কিনা এমন সন্দেহ করছেন অনেকে। তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ধারণা করা যায়, তিনি সম্ভব হলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আটক করবেন, কিংবা তার পতন ঘটিয়ে সেখানে একজন পুতুল প্রেসিডেন্ট বসাবেন।
সেই প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করবেন রাশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) এবং সামরিক জোট কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনেরও (সিএসটিও) সদস্য হতে। বিশেষ করে সিএসটিও এর সদস্য হলে সেখানে রাশিয়ার পুতুল প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কোনো গণআন্দোলন তৈরি হলেও প্রেসিডেন্টকে দিয়ে আহ্বান জানিয়ে রাশিয়া সৈন্য পাঠাতে পারবে। কিছুদিন আগে কাজাখস্তানে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট কাসিম তোকায়েভের বিরুদ্ধে জনগণ রাস্তায় নামলে রুশ সৈন্য নামিয়ে অভ্যুত্থান দমন করা হয়।
ইউক্রেনের মিশন সফল হলে পুতিন থেমে যাবেন না। এবারের সংকট শুরুর আগে শুধু ইউক্রেনকে ন্যাটোতে নেওয়া যাবে না, এ দাবি করেই তিনি থেমে থাকেননি, ন্যাটোকে ১৯৯৭ সালের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও করেছিলেন পুতিন। এর অর্থ হচ্ছে, ৩০ সদস্যের ন্যাটোর ১৪ সদস্যকেই বাদ দিতে হবে। বিশ্বের অনেকে অনুমান করছেন, তার পরবর্তী লক্ষ্য হতে যাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভেঙে তৈরি হওয়া তিন বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাতভিয়া। এর মধ্যেই তিনি এ রাষ্ট্রগুলোসহ পূর্ব ইউরোপের সব ন্যাটো সদস্য দেশের মাটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ভারী অস্ত্র প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন।
২০১৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেছেন, ‘উদারনৈতিক মতবাদ (লিবারেল আইডিয়া) বাতিল হয়ে গেছে। এটা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের চাওয়া এবং চাহিদার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত...আমার মতে কোটি কোটি মানুষের জন্য সনাতন মূল্যবোধ অনেক বেশি সুসংহত এবং গুরুত্বপূর্ণ। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি উদারনৈতিক চিন্তা বাতিল হতে হবে।’
একজন অতি ক্ষমতাধর শাসকের পক্ষে তার সীমান্তে উদারপন্থি কোনো রাষ্ট্রের টিকে থাকাকে সহ্য না করাই স্বাভাবিক। নিজ দেশের জনগণ পার্শ্ববর্তী দেশ দেখে উৎসাহিত হয়ে সেরকম উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থা চাইতে পারে, যা তার ক্ষমতায় টিকে থাকাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। তাই তার সীমান্তে ইউক্রেন কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্র উদারনৈতিক পশ্চিমা ধাঁচের রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকা পুতিনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পুতিন চাইবেন তার ধারার সরকারব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ুক আরও যত বেশি সম্ভব জায়গায়।
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুতিনকে আগে থামানো যায়নি, এবারও থামানো যাবে বলে মনে হয় না। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক যৌক্তিকভাবে বলেছে, ইউক্রেন সংকটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোর ভূমিকা কোনোভাবেই যথাযথ ছিল না। সত্যিকার অর্থে পুতিনকে থামানো উচিত ছিল অনেক আগে জর্জিয়া আক্রমণ করার সময়ই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বহু সমরবিদ স্পষ্টভাবে বলেছেন, চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেনল্যান্ড দখল করার পরই হিটলারকে থামানো উচিত ছিল বল প্রয়োগ করে হলেও।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
