বিজয়-বিষাদের এক ঐতিহাসিক মাস
ড. এম এ মাননান
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডিসেম্বর মাসটি এলেই স্মৃতির আয়নায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে উতলা করে তোলে সেই দিনগুলো, যে দিনগুলোতে ঘটেছিল অভাবনীয় অনেক ঘটনা। অনেক আতঙ্ক তাড়া করে ফিরে আমার মতো আরও অনেককে, যারা দেখেছে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বের দমবন্ধ দুঃসহ অবস্থা আর ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন বর্বরতার আতঙ্ক-জীবন বাঁচানো, সম্পদ বাঁচানো আর আব্রু বাঁচানোর আতঙ্ক।
জীবনভর আমার বাবাকে তাড়া করেছে ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশ-ভারতের অঙ্গ বঙ্গভূমিতে সামন্তবাদী নিপীড়ক জমিদারদের শোষণ-অত্যাচার আর সাতচল্লিশ-উত্তরকালের দুই দশক ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মৌসুমি দুর্ভিক্ষ, কখনো কখনো কলেরা-ম্যালেরিয়া-যক্ষ্মার মহামারি। এখন আমাকে তাড়া করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম বর্বরতা, এর সঙ্গে স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা-শাসকদের ব্রিটিশদের চেয়েও বেশি মাত্রার শোষণ-বঞ্চনা আর ঠগবাজি।
ভারত বিভাগের মাত্র বছর দুয়েকের মাথায় বাংলার শ্যামল মাটিতে আমার আগমন। আমি সব সময়ই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে, স্রষ্টা আমাকে পাঠিয়েছেন এ বাংলার শ্যামলিমায় প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরা ছবির মতো একটি পল্লিতে, যেখানে সব ঋতুতেই বসে সবুজের মেলা। এমন মায়াভরা বাংলাকে আগে শোষণ করেছে মোগল-ব্রিটিশরা; এরপর করেছে বাঙালিবিদ্বেষী পাকিস্তানি জান্তারা। এরা ২৪টি বছর ধরে এই সুন্দর মাটিকে, প্রকৃতির নির্মলতাকে ধ্বংস করে দিয়ে এ অঞ্চলটাকে বিত্তহীন, সম্মানহীন একটি ভিক্ষুকের জন্মস্থলে পরিণত করে শোষণ-নিপীড়ন-লুটপাট নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিল। মাত্র দুই যুগ এদের হাতে ছিল এ অঞ্চলের শাসনভার। এরই মধ্যে এরা এটিকে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে বাঙালির প্রবেশ সীমিত করে দিয়ে, প্রশাসনের উচ্চ পদগুলোতে পাকিস্তানিদের বসিয়ে, সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের না-রাখার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে, পাট-কাগজসহ প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট করে অঞ্চলটিতে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করে মেরুদণ্ডহীন করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় এরা সফল হয়ে যেত, যদি টুঙ্গিপাড়ার বাগইর নদীর পাড়ের ‘রাখাল বালক’টির মতো একজন অকুতোভয় বাঙালি সন্তানের আবির্ভাব না হতো, যিনি বাঙালি জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে ঐক্যের ছত্রতলে নিয়ে আসেন এবং ‘পশ্চিম পাকিস্তানিদের’ সব ষড়যন্ত্র-কুটচাল নস্যাৎ করে দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন-একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ।
এমন একটি ভূখণ্ডে আমার বাপ-দাদাদের বসবাস, যেখানে মঙ্গা ছিল নিত্যবছরের অনিবার্য ঘটনা, স্থানীয় মহামারি ছিল নিত্যসহচর। জনজীবন ছিল বিবর্ণ। ব্রিটিশদের হাত থেকে পাকিস্তানিদের হাতে পড়ে হয়ে উঠল আরও বিবর্ণ। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই স্মৃতির পাতাগুলো বিবর্ণতার চাদর ভেদ করে সজীব হয়ে ওঠে। ১৯৬০-এর দশকের প্রথমদিকে হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালে ‘পাক সার জমিন সাদবাদে’র কম্বলের তলায় যুবসমাজকে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। জানার কোনো সুযোগই ছিল না আমরা কে।
আমরা নিজ দেশে থেকেও কেন পরবাসীর মতো। দেশে প্রতিবছর দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ কেন হয়। আশ্বিন-কার্তিকে কেন মানুষ ক্ষুধায় কাতরায়। গ্রামে গ্রামে কেন হাড় জিরজিরে শিশু আর মায়েদের জরাজীর্ণ চেহারা। রিলিফের চালের দিকে কেন সবাইকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কৃষক কেন সার পায় না। কেন কিনতে হয় বিদেশ থেকে আগত খয়রাতি সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়-চোপড়। নিলামি কাপড়ে জীবন কেন নিলাম হয়ে যায়। গ্রামগঞ্জে কেন শিল্পজাত পণ্য পাওয়া যায় না।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কেন বই-কাগজ-খাতা কিনতে পারে না। অভাবের শিকার প্রায় প্রতিটি গ্রামীণ পরিবার কেন ছেলেমেয়েদের পোশাক দিতে পারে না। মায়েরা-বোনেরা কেন বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। আশপাশের দশটা গ্রামেও কেন একটা স্কুল খুঁজে পাওয়া যায় না। সারা গ্রামেও কেন একটা টিউবওয়েল নেই। মানুষ কেন পুকুর-নদীর পানি পান করতে বাধ্য হয়। আমাকে কেন ১৪/১৫ মাইল দূরের হাইস্কুলে পায়ে হেঁটে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। কলেজে পড়ার আশা কেন দুরাশা হয়ে যায়।
এসব প্রশ্নের জবাব না ছিল আমাদের শিক্ষকদের কাছে, না ছিল মুরব্বিদের কাছে। বহুদূর পাড়ি দিয়ে কলেজে পড়তে যাওয়ার পর থেকে প্রশ্নগুলো আরও সরব হতে থাকে। উত্তর খুঁজতে থাকি। ’৬৬ সালের মাঝামাঝি লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজে পড়ার সময় কিছুটা জবাব পেয়ে যাই, যখন জানতে পারি তরুণ নেতা শেখ মুজিব ৬-দফা ঘোষণা করেছেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন ৬-দফার, মানুষকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এর মর্মার্থ।
আমিও পেয়ে যাই ৬-দফার প্রচারপত্র। দেখি, এ তো আমাদের স্বার্থরক্ষার দাবি, আমাদের মুক্তির সনদ। ৬-দফা আমার এবং আমার সহপাঠীদের চেতনায় বিস্ফোরণ ঘটায়। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ৬-দফার প্রচারে একাত্ম হয়ে যাই। আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উপ্ত করে তুলি তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বাসনাগুলোকে, যে বাসনাগুলো মুক্তি পাওয়ার, একটা ভালো জীবন গড়ার, বিবর্ণ দেশকে সজীব করার। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বাঙালি তরুণরা।
শোষণ-বঞ্চনার পাশাপাশি শাসকদের হীনম্মন্যতার কারণে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। হয়তো এমন পরিস্থিতিই আমার না-দেখা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে নিহত-আহতদের করুণ স্মৃতি অব্যক্ত অশ্রু ঝরিয়েছিল তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের এক বুক ভালোবাসা-ভরা বিনম্র হৃদয়ে। মনে হয়েছিল, সে প্রেক্ষাপটেই হয়তো তিনি ‘পূর্ব বাংলার মুক্তির সনদ’ নামে পরিচিত ৬-দফা প্রণয়ন করেন, যার মধ্যে বাঙালিদের মনের চাওয়াগুলো মঞ্জুরিত হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই ঢাকা শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম।
ঘটতে থাকে অকল্পনীয় বুক-কাঁপানো সব ঘটনা : ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজনকে জড়িয়ে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে এক মিথ্যা মামলা, গণআন্দোলনের মুখে মামলা প্রত্যাহারসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান, ঊনসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে অগণিত ছাত্রজনতার সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্তকরণ, আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯), গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন (২৫ মার্চ) এবং একই দিন দৃশ্যপটে কুচক্রী ইয়াহিয়া খানের আগমন, সামরিক আইন জারিসহ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা, সত্তরের জানুয়ারিতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর একাত্তরের ১৭ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, বিজয়-পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া সরকারের ন্যক্কারজনক আচরণ, বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, অনেক অভূতপূর্ব ঘটনার মধ্যেই ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণকালে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর অগ্রভাগে উচ্ছলিত দ্রোহের ভাষা আর দেশকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান, ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে কয়েক লাখ লোকের প্রাণহানি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং পরিণামে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ইন্তেকাল।
৩০ লাখ বাঙালির সাগরসম রক্ত ও কয়েক লাখ মা-বোনের আব্রুর বিনিময়ে, আর কোনো রকমে বেঁচে থাকাদের সাহায্য-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে ফুটে ওঠে একটি স্বাধীন ব-দ্বীপ, নাম তার বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর শুধুই একটি বিজয়ের মাস নয়, নয় শুধু ইতিহাসের পাতায় গেঁথে দেওয়া একটি অনবদ্য ঘটনার পট। এটি মুক্তির অরুণোদয়ের ছোঁয়ায় সিক্ত লাল-সবুজের আবিরে মাখা, স্বপ্নের পাখিদের নীল দিগন্তে ছুটে যাওয়া ডানার ঝাপটা, মুক্ত সমীরণে অবগাহনের উল্লাসের একটি শীতল পরশ। এ মাসটির সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে খুঁজে পাই অতীতকে, নানা রঙের দিনগুলোকে।
তবে আক্ষেপ আর শঙ্কাও আছে অনেক। যে রকম দেশের কথা ভেবেছিলেন এবং স্বপ্নের আখরে লিখেছিলেন এ দেশেরই স্বপ্নদ্রষ্টা, সে রকম একটা দেশ কি আমরা তার বিদেহী আত্মাকে উপহার দিতে পেরেছি? আমরা কি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম হয়েছি? অর্থনৈতিক মুক্তি কি মিলেছে? পঁচাত্তরের দুষ্টচক্র কি রক্তবীজ-দৈত্যের চেহারায় সর্বত্র গেড়ে বসেনি? মাত্র বারো বছর আগে একটি অনিয়ম-দুর্নীতি-অপশাসন-প্রবঞ্চনার স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে স্বাপ্নিক বাবার স্বপ্নচারিণী কন্যা অনেক বাধা, অলীক সমালোচনা আর দেশি-বিদেশি চক্রান্ত অতিক্রম করে, হঠাৎ চেপে বসা অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে, অতিমারির বিশ্বকাঁপানো-ছোবল পাশ কাটিয়ে বিশ্বনন্দিত অগ্রগতি সাধন করে খোঁড়া করে রাখা দেশটাকে উন্নত দেশের মর্যাদায় আসীন করার মহাসড়কে নিয়ে এসেছেন।
এ বিষয়টি যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি এ কথাও সত্য যে, বর্তমান নেতৃত্ব আরও বেশি সাহসী না হলে এবং রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে চলমান ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে না পারলে দুই কোটির অধিক মানুষকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনা যাবে না। ভিন দেশের সাহায্যনির্ভরতা দূর করে আপন পায়ের উপর দাঁড়ানো যাবে না। স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর চেয়েও বড় প্রকল্পের স্বপ্ন দেখা যাবে না। কৃষিতে-শিল্পে স্বনির্ভর হওয়া যাবে না। এবং স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুর মনের পটে আঁকা একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মানসে শুরু হওয়া চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
বিজয়ের মাসে একান্ত কামনা, আলোতে ভরে উঠুক আমাদের সব অর্জন। পরাজিত শত্রুদের মুখে ছাই মেখে সামনে এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ।
ড. এম এ মাননান : কলাম লেখক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
