Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে এই রাজনীতি

Icon

এম এ আজিজ

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে এই রাজনীতি

প্রবচন আছে, ‘বাও নাই বাতাস নাই গাঙ হুদোই লড়ে, বয় করে ডর করে কুমির বুজি দরে।’ অর্থাৎ ‘বাতাস বা ঝড়ো হাওয়া নেই, কিন্তু নদীর পানি অকারণেই নড়ে। মনে ভয় লাগে কুমির বুঝি ধরে।’ দেশের পরিস্থিতি কি এমনটাই ইঙ্গিত করছে? রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাত্রা দেখে দেশের মানুষ পরিস্থিতি পরখ করতে অভ্যস্ত। এ মুহূর্তে বিরোধী দলের আন্দোলনের মাত্রা ক্ষীণকায়। দেশের রাজনৈতিক মাঠ দৃশ্যত ফাঁকা। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তুলছে, ‘বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই’।

অনেকেরই মনে অন্তহীন প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কি পরিবর্তন ঘটেনি? ভূ-রাজনীতির ফাঁদ থেকে দেশ কি মুক্ত? দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আয়বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা কি সামর্থ্যরে মধ্যে? নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচ থেকে টেনে তোলা কি সম্ভব? দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভঙ্গুরতা আদৌ কি কাটবে? অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও দ্রব্যমূল্য ভালো কিছু কি নির্দেশ করছে? শেষ পর্যন্ত জাতি গণতন্ত্রের পথে কি চলতে পারবে? ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, যা গণতন্ত্র চর্চার প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করে আনছে। দলের উপরের স্তরে পরিবারতন্ত্র বহাল রেখে তৃণমূলে গণতান্ত্রিক চর্চা চলমান রাখার চেষ্টা এক ধরনের দ্বিচারিতা এবং অলীক স্বপ্ন। দলের উপরের স্তরে পরিবারতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিলে নিচে তা সংক্রমিত হবেই। অনেকেই পিতা, স্বামী বা নিকটাত্মীয় দলের বড় নেতা হওয়ার সুবাদে রাজনীতিবিদ। দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি বা নির্বাচনে যে কোনো স্তরে প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা দেখে বলাই যায়, রাজনীতি এখন পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্রেরই নিয়ন্ত্রণে। রাজনৈতিক দলগুলো যুক্তির সাহায্যে সত্যাসত্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ বিবেচনায় নিয়ে সবার জন্য রাজনীতিতে সমান সুযোগের পথ সৃষ্টি না করলে শেষ অবধি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অটুট রাখা কঠিন হতে পারে। অনেক মন্ত্রী-এমপি দলীয় নির্দেশ অমান্য করে উপজেলায় উত্তরাধিকারকে নেতৃত্বে বসাতে তিন ধাপে তাদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের মধ্য থেকে ৫২ জনকে প্রার্থী করেছেন। এমপিরা এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখতেই এত বেপরোয়া। অপরদিকে, বিএনপির উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৬১ জনকে একযোগে বহিষ্কার করেছে। ২৯ মে তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। দলগুলোর মধ্যে দলাদলি ও গণতন্ত্রের চর্চার অভাব এবং দেশে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্র প্রসারিত হচ্ছে। আনুগত্যের প্রশ্নে এবং ঐক্যের প্রতীক হিসাবে বড় দলগুলো তাদের সাবেক বড় নেতাদের ছেলেমেয়ে ও নিকটজনের ওপর বেশি ভরসা রাখছে বলেই সর্বস্তরে দলগুলো দ্রুত পরিবারতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।

আবার দলের উপরের স্তরের নেতারা প্রভাব-প্রতিপত্তি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলে নিচের স্তরের নেতারাও তাই অনুসরণ করবে। উপর পরিশুদ্ধ না করে নিচকে নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দলের উপরের স্তর প্রশ্নাতীত বা অনুকরণীয় নৈতিক সততা থাকলে তৃণমূলে আপনা থেকেই তা বিস্তৃত হবে।

অপরদিকে, দেশের প্রতিটি বড় দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল। তাই এক ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনেই দল চলে। কোনো দল যেমন করেই হোক সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দলটির পক্ষ থেকে যিনিই সরকারপ্রধান হন, তিনিই হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী শাসক। কারণ দেশের সংবিধান তাকে প্রায় সব ক্ষমতার অধিকারী করেছে। এ কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতির কারণে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে কোনো জাতীয় সমস্যায়ও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়া মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়ায় প্রায় সব জাতীয় নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে ধারাবাহিকভাবে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে তিন ধরনের অভিনব বিতর্কিত কৌশল বাস্তবায়ন করে বর্তমান সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃত্ব হারিয়েছে।

যে কোনো দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার অঙ্গীকার’ থেকে সরে যায়। অনুচ্ছেদ-৭-এ প্রদত্ত ‘জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার’ কথা স্মরণ রাখে না। অনুচ্ছেদ ৮-এর ‘চার মূলনীতি’ বুঝেও বাস্তবায়ন করে না। আইন তৈরি করতে অনুচ্ছেদ ২৬-এর ‘মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল’ বিধানগুলোকে আমলে নেয় না। ১৯৭২ সালে সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে ১৮ বার তা সংশোধন করা হয়েছে। ‘সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে’ ইচ্ছানুসারে সংবিধান কাটাছেঁড়া করায় বিতর্ক যেন পিছুই ছাড়ছে না। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত-সহিংসতামুক্ত রাজনীতির জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি অনুগত হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণকে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া। নচেৎ, সরকার হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে না। বিরোধীদলগুলোও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে না।

এ অচলাবস্থা কাটবে কোন পথে? হ্যাঁ, রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিবিষ্ট হলে সম্ভব। যেমন: ভারতের মতো স্বাধীনতায় প্রশংসনীয় কীর্তির অধিকারীদের স্মরণ করা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে সংঘটিত সব ক্ষত ও অমীমাংসিত বিষয়ের নিরসন করা।

এম এ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম