কিশোর-তরুণদের ধূমপানের নেশামুক্ত রাখতে হবে
ড. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালনে এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘Protect Childreen from Tobacco Industry Interfearence’. প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে-‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ ও অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ, শিশু-কিশোর-তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। আর বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশ বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এ কারণেই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পণের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! ঝুঁকিপূর্ণ এজন্যই যে, অল্প বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান ও তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরও একটা অংশ রয়েছে, যারা এ গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এ বদভ্যাস রয়েছে, যা একটি অশনিসংকেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত Global School Based Student Health Survey-2014 গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
শৈশব-কৈশোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়-যে সময়ে তারা নিজেকে গড়তে শেখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন ও আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এ সময়ে সে কোনো ভুল করে বসে বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তাহলে তার পুরো জীবনটাই মূল্যহীন, বৃথা হয়ে যায়। তাই এ সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেজন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেটা করতে পারেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা। আর এরাই যদি অকারণে, অযাচিতভাবে বিনোদন মাধ্যমগুলোয় সিগারেট, অ্যালকোহল, মাদকের বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম রসাতলে যাবে। আইডলরা সচেতনভাবেই যদি শিশু-কিশোরদের মগজে ‘নেশার ইনজেকশন’ পুশ করতে থাকেন, তাহলে এর ফলাফল আরও ভয়াবহ হতে পার। তখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে আসা আমাদের মতো লোকদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কারণ আমি ১০ জনকে তামাকের নেশা ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করছি, কিন্তু তারা ১০০ জনকে এ নেশায় উৎসাহিত করছে! এতে আমাদের প্রচেষ্টা অনেকটা সমুদ্রে বালতি দিয়ে পানি সেচার মতো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা অনেক বেশি। তারা সন্তানকে এ ব্যাপারে কথা বলবেন, সাবধান করবেন।
ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ বেড়ে যাচ্ছে। মূলত রেস্টুরেন্ট মালিকদের সুবিধা দিয়ে সেগুলো তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। সেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসা প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। লক্ষ করলে দেখবেন, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট কোম্পানির কৌশলী বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৫ অনুসারে, তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও সিগারেট কোম্পানিগুলো যা করছে, তা রীতিমতো আইনের লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ!
তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে এটি ছড়িয়ে পড়ছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। মূলত, কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি দেশে সুকৌশলে ই-সিগারেট বাজারজাত করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। বিজ্ঞানের গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেটের বিপণন ও ব্যবহার বাড়ছে। উঠতি বয়সিদের মধ্যে ফ্যাশন হিসাবে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ, ই-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে, যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আর্কষণের মূল কারণ। টিসিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেটের দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে শুধু তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য। সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণা হলো ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর। বস্তুত আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এবং ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক (বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহারে দেহে ২৫টির বেশি প্রাণঘাতী রোগ হয়, যার মধ্যে ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার অন্যতম। দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং কয়েক লাখ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে তামাকের কারণে। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা গেছে, ৩৫.৫ শতাংশ বা ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ (৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫.২ শতাংশ নারী) তামাক সেবন করে। ১৮ শতাংশ বা ১ কোটি ৯২ লাখ মানুষ (পুরুষ ৩৬.২ শতাংশ ও নারী ০.৮ শতাংশ) ধূমপান করে এবং ২০.৬ শতাংশ বা ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ (পুরুষ ১৬.২ শতাংশ ও নারী ২৪.৮ শতাংশ) ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাড়ি, গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলে এ সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ১৫ বছরের কম বয়সি ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আশঙ্কাজনক তথ্য হলো, এর মধ্যে ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন অসুখে ভোগে। অর্থাৎ তামাকের কারণে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোররা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে, যাতে নিজের ভুলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে না পড়ে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আগামী প্রজন্মের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। শিশু-কিশোর, যারা তারুণ্যে পদার্পণ করছে, এ ট্রানজিশন প্রক্রিয়াটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্য জীবনকে মহাজীবনের দিকে পৌঁছে দেয়। তাই তরুণদের প্রতি আমার বার্তা হলো-ভিন্নভাবে চিন্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বিচারের ভার নিজেকেই নিতে হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। এসব মহান গুণের দ্বারা তরুণদের চালিত হতে হবে। নতুন প্রজন্মের প্রতি এ আমার বার্তা।’
রাষ্ট্র ও পরিবারের দিক থেকে তাদের যত্নে কোনো গাফিলতি করা যাবে না। কারণ, তামাক কোম্পানির মতো ধূর্ত বণিকরা আমাদের শিশু-কিশোরদের ধরতে ওত পেতে বসে আছে। তাদের কূটচালে এ বিপুল জনগোষ্ঠী যদি জাতীয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সমস্যায় জর্জরিত হবে রাষ্ট্র। সমস্যা থেকে উত্তরণ ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসাবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির সংশোধনী পাশ করে বাস্তবায়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। তাদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের অপকৌশল প্রতিরোধ করার অঙ্গীকার করছি।
ড. অরূপরতন চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস); সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com
