আওয়ামী লীগের জন্ম ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
ড. মাহবুব উল্লাহ
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশে কোনো বিরোধী রাজনীতি থাকবে বা থাকতে পারে, এ রকমটি ভাবা যাচ্ছিল না। তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের যারা নেতৃবৃন্দ ছিলেন, তারা এমনটিই বলতেন। বিশেষ করে লিয়াকত আলী খান বলতেন, পাকিস্তান একটি শিশু রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা হলে সেটা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করারই শামিল হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা ভিন্নমতের, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক দল তৈরি করা খুব কঠিন কাজ ছিল। মওলানা ভাসানী সেই সময়ে সেই সাহসী কাজটি করেছিলেন এবং তিনি যাদের সঙ্গে পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আমরা উল্লেখ করতে পারি শামসুল হকের কথা। তারপরে শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক। তারা সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক এসব পদে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমার এক ডেনিশ বন্ধু ও গবেষক, যিনি বাংলাদেশে অনেকদিন কাজ করেছেন, বলেছিলেন, দলটি যখন বিরোধী দলে থাকে, তখন তাকে ভালোই লাগে; কিন্তু দলটি যখন ক্ষমতায় যায়, তখন আর পছন্দ হয় না। তার এ বক্তব্যের আলোকেই কিন্তু এই দলটাকে মূল্যায়ন করা যায়।
আওয়ামী লীগ মূলত ক্ষমতার রাজনীতি করেছে। এ রাজনীতি করার জন্য দলটি গণআন্দোলন, ম্যাস মোবিলাইজেশন, এগুলোকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। মুসলিম লীগ সরকারের যে বিরোধিতা করা হয়েছিল, এর ফল হিসাবেই ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রধান দল ছিল আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের চরম পরাজয় হয়েছিল। বিজয়ীদের মধ্যে প্রধান শক্তি ছিল আওয়ামী লীগ, মানে তখনকার আওয়ামী মুসলিম লীগ।
এরপর মওলানা ভাসানী মতভিন্নতার কারণে আলাদা নতুন দল গঠন করেছিলেন। সেই দলের নাম হচ্ছে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই দলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের খুব নামকরা নেতা ও কর্মীবৃন্দ যোগদান করেছিলেন। গঠনের সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যাতে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য দলটির ওপর নানারকম দমন-পীড়ন নেমে আসে।
একই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি, যখন ’৬৬ সালে ৬ দফা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই ৬ দফার যে মূল বাণী, সেটা হচ্ছে একটা লুজ ফেডারেশন গঠন। পাকিস্তান সরকার তা কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের যে মূলনীতি ছিল-পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা, তা থেকে দূরে সরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচিটা উত্থাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই ধরনের কর্মসূচি বেঁচে থাকলে কিছুতেই সমর্থন করতেন না। তিনি একটা কথা বলতেন, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি টিকে আছে দুটি জিনিসের ওপর। একটা হচ্ছে-পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ), আর অন্যটি হচ্ছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যাহোক, তিনি পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির কড়া সমর্থক ছিলেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, আওয়ামী লীগ তার নীতি ও আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
আওয়ামী লীগ ৬ দফা দেওয়ার পর দলটির ওপর চরম দমনপীড়ন নেমে আসে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমদিকে ৬ দফা দেওয়ার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় জনসভা করেছেন এবং সেই জনসভাগুলোয় বিপুল জনসমাগম হয়েছে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই তার রাজনৈতিক প্রচারণা শুরু করেছিলেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিলেন; কিন্তু দেখা গেল যখন দমননীতি নেমে এলো চরমভাবে, তখন আওয়ামী লীগ তেমন কিছু করতে পারল না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসে বাতি জ্বালানোটাও একটা কঠিন ব্যাপার ছিল। এরকম একটা পরিস্থিতি ১৯৬৭-৬৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। পরে উনসত্তরে ছাত্রদের গণআন্দোলন শুরু হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, এ আন্দোলন কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্দোলন ছিল না। ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল এবং তারা বিপুল সাড়া পেয়েছিল। এই সাড়া পাওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে আইয়ুব সরকারের যে চরম দমনপীড়নের নীতি, সেটা কাজ করেছিল। এ আন্দোলন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিঃশর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এরপর আবার নতুন করে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশে একটা নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনটা ১৯৭০ সালে হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হয়, ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনেই বিজয়ী হয়। এবং এটি সম্ভব হয়েছিল ’৬৯-এর আন্দোলনের এবং ওভারঅল স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট, সেটির আলোকে। কিন্তু তারপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে টালবাহানা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ শুরু হয় গণহত্যা। সেই অবস্থা থেকেই কিন্তু পাকিস্তানের যে সংহতি বা রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ থাকার যে সম্ভাবনা, সেটা চিরতরে বিলুপ্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই প্রবাসী সরকারের ব্যাপারে নানারকম পর্যালোচনা হচ্ছে। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা জানতে পারছি। নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। কাজেই সেই সরকারের মূল্যায়ন করার সময় কিন্তু শেষ হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলেন। আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হবে। কিন্তু দেশের সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যা এত তীব্র এবং প্রকট হলো যে, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তিনি গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে এলেন এবং একদলীয় বাকশাল সরকার গঠন করলেন। আজ পর্যন্ত বিষয়টি পরিষ্কার নয়, তিনি কী কারণে, কোন উপলব্ধি থেকে এই একদলীয় সরকার গঠন করেছিলেন। এই একদলীয় সরকার গঠন ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং। ফলে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। পরবর্তীকালে তারা ক্ষমতায় আসে এবং শেষ পর্যায়ে যেটা আমরা লক্ষ করছি, সেটা হচ্ছে গত ১৫ বছর ধরে দলটি একনাগাড়ে ক্ষমতায় আছে। এই সময় যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে কোনো নির্বাচন নয় এবং এটা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখন প্রশ্ন হলো, যে দলের জন্ম হলো গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সেই দল ক্ষমতায় গিয়ে যখন গণতন্ত্রকে ভুলে যায়, তখন আমাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কী করার থাকে! এভাবে যদি তাদের নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে একটা কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হবে। আরও একটা কথা। শ্রেণিগতভাবে আওয়ামী লীগ কাদের দল? পাকিস্তান আমলে আমরা জানতাম, আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের দল। সরকারি চাকুরেদের মধ্যেও দলটির সমর্থন ছিল। পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যখন হলো, দেখা গেল তখনকার সিএসপি অফিসাররাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তার মানে উচ্চতর শ্রেণিগুলোকে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ আত্মস্থ করে নিচ্ছিল। কিন্তু হাল আমলে দেশের অর্থনৈতিক নীতি বা কর্মকাণ্ড যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেভাবে এখানে একটা লুটেরা অলিগার্ক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটছে, তাতে আমরা বুঝতে পারি না, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের দল আওয়ামী লীগের এই অবস্থা হলো কেন। এটা দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক এবং এই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া উচিত ছিল না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
