Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দৃষ্টিপাত

দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই সংকট সমাধানের উপায়

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই সংকট সমাধানের উপায়

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অনেকটা হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে মতান্তর তীব্র হতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের রাজনীতিতে বিরাজমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পদত্যাগ করার কথা বিবেচনা করছেন।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানালে তিনি তার বর্তমান দায়িত্ব থেকে সরে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তবে তিনি মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করার পর দেশে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই চাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হোক।

জাপানের টোকিওতে নিক্কেই ফোরামে দেওয়া এক বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেশের জনগণের ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। ড. ইউনূস বলেন, আগামী বছর জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছে। এমনকি তাদের প্রত্যাশামতো ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা না হলে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে পারেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

এদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কিছু বক্তব্য নিয়েও মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অফিসার অ্যাড্রেসে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, তিনি মনে করেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মতান্তর শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েই নয়; আরও কয়েকটি বিষয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার মনে করছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অন্যতম দাবি হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের হোতাদের বিচার চায় মানুষ। আর বিএনপি মনে করছে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে হবে। ন্যূনতম সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার বলছে, সংস্কারবিহীনভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা হলে পরিস্থিতি আগের মতোই হবে। মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েই সংকট তৈরি হয়েছে।

সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কালো মেঘের ঘনঘটা লক্ষ করা যাচ্ছে। কীভাবে এ সংকট নিরসন করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সৃষ্ট সংকট যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা না যায়, তাহলে জটিলতা শুধু বাড়তেই থাকবে। সেই সুযোগে পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ড. ইউনূস বেশ দক্ষ ও জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে কোনো বাংলাদেশির চেয়ে তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বেশি। কিন্তু তিনি যাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন, তাদের কারও কারও ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। অধিকতর যোগ্যতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা গেলে তা আরও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারত। কোনো কোনো উপদেষ্টা সম্পর্কে বাজারে নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে।

চিকিৎসাশাস্ত্রে দুধরনের পদ্ধতি আছে। একটি হচ্ছে, সাময়িকভাবে ব্যথা নিরাময়ের স্বল্পকালীন পদ্ধতি এবং অন্যটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী নিরাময় পদ্ধতি। অন্তর্বর্তী সরকার হচ্ছে সংকট সমাধানে সাময়িক উপশম পদ্ধতি। সাময়িক সমাধানের পদ্ধতিকে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিতে পরিণত করতে গেলেই সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কখনোই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের পন্থা হতে পারে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখায় বিরাজমান সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সরকারব্যবস্থাই উত্তম পদ্ধতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘস্থায়ী হলে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জটিলতা শুধু বাড়তেই থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদ্ধতি সাময়িক সময়ের জন্য জনপ্রিয় হতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তর্বর্তীকালীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাময়িক জনপ্রিয় সরকার পদ্ধতি হলেও এর কোনো জনভিত্তি নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন রাজনীতিচর্চার মাধ্যমে জনভিত্তি গড়ে তোলে। তারা চাইলেই তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির সমর্থনে বিপুল জনসমাগম ঘটাতে পারে।

আমলাদের আন্তরিক সহায়তা ছাড়া কোনো সরকারই সফল হতে পারে না। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনভিত্তি না থাকার কারণে আমলারা এ সরকারব্যবস্থাকে ভয় পায় না। তারা বরং নানাভাবে অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে থাকে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমলাদের একাংশের অসহযোগিতার বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এ সরকারের কাজের গতি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মন্থর হয়ে পড়েছে। এজন্য মূলত আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতাই দায়ী। বিভিন্ন সেক্টর থেকে আন্দোলন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার আমলে এসব আন্দোলনকারী কোথায় ছিলেন? কেউ তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে পারেন, এতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আন্দোলনের নামে যখন-তখন রাস্তায় নেমে আসা এবং পথচারী ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি। সাধারণত গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে কয়েকদিন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে থাকে। কিন্তু এবার যতই দিন যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। গণ-আন্দোলনোত্তর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকীকরণে পুলিশবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পুলিশবাহিনী তৃণমূল পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে এবং অপরাধীদের সম্পর্কে তারাই সবচেয়ে ভালোভাবে অবহিত থাকে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে পুলিশবাহিনীর সদস্যদের দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করার ফলে তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন। পুলিশবাহিনীর সদস্যদের অনেকেই এখন দূরবর্তী এলাকায় দায়িত্ব পালনে যেতে ভয় পাচ্ছে। পুলিশবহিনী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন ঘটাতে না পারায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও রহস্যজনক কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি হচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টার্গেট কিলিং হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। এদিকে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, দেশের বাইরে পলাতক বাংলাদেশি মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনালদের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার মিশনে দেশে পাঠানো হচ্ছে। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সদস্যদের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হত্যার জন্য তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই নয়, অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তার কোনোটিতেই তেমন একটা গতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে।

এ মুহূর্তে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠানের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার এবং অন্য যেসব স্বল্পমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম আছে তা শেষ করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা যেতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনাসহ যেসব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে, সেগুলো চলমান রেখে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বিভিন্ন সময় বলেছেন, সংস্কার যদি স্বল্প হয়, তাহলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আর যদি সংস্কার কার্যক্রম বড় হয়, তাহলে আগামী বছর জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন যে কোনো মূল্যেই হোক, আগামী বছর জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত আছে। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল চাচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যথায় তারা বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে পারে।

গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা কাজে লাগানো যাবে না। বিগত সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে এই অর্থ ফেরত আনার কাজ সহজ হবে না। সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা না হলে দেশ ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। তাই জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা যেতে পারে। সেটাই হবে আন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ।

প্রফেসর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম