কুরবানি, হজ এবং আমাদের সামাজিক অর্থনীতি
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কুরবানি এলেই বাংলাদেশে একশ্রেণির গরুপ্রেমীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। হজ নিয়েও ওই শ্রেণিটির উদ্বেগের সীমা থাকে না। একই সঙ্গে হজে না গিয়ে জনকল্যাণে ওই অর্থ ব্যয় করার জন্য তারা বেশ জোরালোভাবে নসিহত করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, দেশে ও দেশের বাইরে শপিং কিংবা প্রমোদভ্রমণ নিয়ে কোনো কথা নেই তাদের। ক্রমশ মহল্লার অলিগলিতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া ফাস্টফুডের দোকান, রেস্টুরেন্টে বিফ, মাটন বা চিকেনের বিভিন্ন আইটেম নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিংবা যারা ভেজ, তারাও তো প্রাণহানির কারণ। উদ্ভিদ হোক, প্রাণী হোক, সবারই প্রাণ আছে। আর মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে অন্যের প্রাণ নিতেই হবে। প্রাণ নেওয়ার সময় গরু হয়তো হাম্বা করবে, শাক-পাতা শব্দ করতে পারে না বলে নীরব থাকবে। কিন্তু প্রাণহানি ঘটবেই।
মুসলিমদের কিংবা তাদের উৎসবের বিরুদ্ধে এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। এ দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ। আর সংখ্যালঘু হিসাবে নির্যাতনের শিকার দাবি করা গ্রুপটি সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিশ্বে সম্ভবত এমন নজির আর নেই। বাংলাদেশের অনেক সমস্যার উৎস এখানেই নিহিত রয়েছে। ঠিক এ কারণেই দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন উৎসব হিসাবে অভিহিত করার পাশাপাশি সাধারণ মিলাদ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক কাজ হিসাবে চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এর ফল ভালো হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না।
বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে ঈদ, হজ বা কুরবানি নিছক কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটাকে গরু জবাইয়ের মচ্ছব হিসাবে না দেখে বরং আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ এবং ইতিহাসের আলোকে দেখতে হবে। এসবের সঙ্গে মিশে আছে এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। এবং তা অনেক দিনের।
গরু কুরবানির কথাই ধরা যাক। এদেশের সামাজিক-অর্থনীতিতে এর ভূমিকা কিন্তু কম নয়। পশুপালন যেমন এর মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে, একেবারে গরিব মানুষ এর কল্যাণেই বছরে একবার হলেও গোশত খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু স্রেফ ঈদের কয়েকদিনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ে, তাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কুরবানির পরিসর যত বাড়ছে, গরিব মানুষের নানাভাবে উপকার লাভের হারও বাড়ছে। হ্যাঁ, নানা বিচ্যুতি আছে। সেগুলো দূর করার জন্য আলেম সমাজও চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কুরবানি কেবল অর্থনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়। মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষ যেমন ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, একইভাবে গরুর গোশত খাওয়ার অধিকারও কিন্তু আদায় করে নিতে হয়েছে। মুন্সীগঞ্জে বাবা আদম, বগুড়ার মীর বোরহান, সিলেটের শেখ বোরহান উদ্দিনের কাহিনিগুলোর সঙ্গে মিশে আছে গরু জবাই করার অধিকারের লড়াই। ইতিহাস কিংবা কিংবদন্তি অনুযায়ী, তারা সবাই বিপুল পরাক্রমশালী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসাবে গরু জবাই করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এ মানুষগুলো ওই সময় ছাগল বা অন্য কোনো কিছু জবাই করার বদলে গরু জবাইয়ের মতো লড়াইয়ে নেমেছিলেন কেন? কিংবা শাসকরাই বা গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে এত কঠোর হলেন কেন? এমন ইতিহাস কয়টি জাতির আছে?
প্রশ্নটি এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেশটি গরুর গোশত রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। আবার বিভিন্ন অমুসলিম জাতি-উপজাতিও বিনা বাধায় গরুর মাংস খেয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যাটি হয় কেবল মুসলিমদের ক্ষেত্রে। এমনটা কেবল সাম্প্রতিক সময়ের কথা তা নয়। অনেক আগে থেকেই তা চলছে।
আবার গরুর গোশত নিয়ে জাত মারা, জাত যাওয়ার কাহিনির ইতিহাসও প্রাচীন নয়। এমনকি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসেও উঠে এসেছে। তার মামার বংশের একটি শাখার পূর্বপুরুষ অম্বিকা ভট্টাচার্যের মুসলিম হওয়ার কাহিনিও আছে। ওই কাহিনিতেই দেখা যাচ্ছে, ‘বান্ধবপুরের পশ্চিমে মাধাই খালের দুপাশে পাঁচমিশালি গাছের ঘন জঙ্গল। বাঁশঝাড়, ডেউয়া, বেতঝোপ, ভূতের নিবাস ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছ। জায়গায় জায়গায় বুনো কাঁঠাল গাছ, যে গাছ কখনো ফল দেয় না। এমনই এক কাঁঠাল গাছের নিচে আজ ভোর রাতে একটা বকনা গরু জবাই হয়েছে। জবাই করেছেন মাওলানা ইদরিস। ধনু শেখের মানতের গরু। ধনু শেখকে গত বছর কলেরায় ধরেছিল। জীবন যায় যায় অবস্থায় তিনি মানত করেন, যদি এই দফায় প্রাণে বাঁচেন তাহলে গরু শিন্নি দেবেন।
গরু শিন্নি কঠিন বিষয়, জঙ্গলের ভেতর করতে হয়েছে। ধনু শেখ বাড়ির দুজন কামলা এবং তার ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছেন। গরু জবাইয়ের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। চামড়া হাড়গোড় গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। কেউ যেন বুঝতে না পারে। শিন্নির মাংস সবাইকে ভাগ করে দেওয়া নিয়ম। ধনু শেখ নিজে এই কাজটি করছেন। মুসলমান ঘর হিসাব করে করে মাংস ভাগ করছেন। পদ্ম পাতায় মাংস পুঁটলি করা হচ্ছে। দিনের মধ্যেই বাড়ি বাড়ি মাংস পৌঁছে যাবে।
মাওলানা ইদরিস একটু দূরে বসেছেন। তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। গোপনে গরু জবেহ করার খবর চাপা থাকবে তার এ রকম মনে হচ্ছে না। সামনে মহাবিপদ।’
সিআইএর সাবেক পরিচালক গ্রাহাম ই ফুলার তার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম’ বইতে দেখিয়েছেন, আরব দুনিয়ার অংশ এবং একই ইসলামে বিশ্বাসী হয়েও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশের লোকজন ধর্মীয় শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হওয়ার কারণ তাদের ভিন্নতা প্রকাশের মাধ্যম। একই ভাষা ও ধর্মের হয়েও ভিন্নতার আশ্রয় নেওয়াটা ছিল তাদের প্রতিরোধের হাতিয়ার। প্রতিরোধ সংগ্রামের হাতিয়ার কোন দেশে কী হবে, তা আগেভাগে নির্ধারিত হয়? এ দেশ কাকতালীয়ভাবে স্বাধীন হয়নি। ইতিহাসের নানা পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ ছিল অনিবার্য পরিণতি।
তাছাড়া মৌসুমি কসাইদের আয়, গরুর হাটকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও কম হয় না। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন জোরদার হওয়ার সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলোও বিবেচনায় রাখা উচিত।
বাংলাদেশে এমন আয়োজন করে কুরবানির প্রধান কারণ সম্ভবত এ ইতিহাসই। তাছাড়া এদেশের বেশিরভাগ মুসলিম হানাফি মাজহাবের অনুসারী। এ মাজহাব অনুযায়ী কুরবানি ওয়াজিব। অন্য প্রধান মাজহাবগুলোতে তা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ওয়াজিব হওয়ার কারণে কুরবানির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এবং সম্ভবত বাড়তেই থাকবে। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, কুরবানি ঈদের মতো এত পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজের উৎসব সারা পৃথিবীতে আর একটাও সম্ভবত নেই। ধনী-গরিব, সমাজের প্রতিটি স্তরের সব মানুষকে এত সুন্দর করে অন্য কোনো উৎসব কি এভাবে গাঁথতে পারে?
হজ কি কেবলই মক্কায় যাওয়ার ধর্মীয় বিষয়? কোনোভাবেই নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে লোকটি জীবনে কখনো ঢাকা পর্যন্ত আসেননি, তিনিও আর্থিকভাবে সাবলম্বী হলে হজে যেতে চান। এর মাধ্যমে তিনি আসলে নিজের জন্য কোয়ালিটি সময় ব্যয় করছেন। সারাটি জীবন তিনি হয়তো কাটিয়েছেন মা-বাবা কিংবা সন্তানদের পরিচর্যায়। এবার ওইসব থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন। নিজের জন্য ব্যয় করার মতো কিছু সঞ্চয়ও এখন তার হয়েছে। তিনি কি এখন শপিং করে কিংবা প্রমোদভ্রমণ গিয়ে অর্থ ব্যয় করবেন? তিনি শৈশব থেকে যে স্থানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আসছেন, সেখানে গিয়ে তিনি নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে চান। মক্কা, মদিনা, হেরা পাহাড়ের গুহার নাম তিনি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছেন। সেখানে ছুটে যাওয়ার আকুতি তার মধ্যে থাকাটা স্বাভাবিক। সেখানে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে তিনি তৃপ্তি পেতে পারেন। ওই সফরকে কেন্দ্র করেই তার বাকি জীবন স্বস্তিতে কাটতে পারে। শেষ জীবনে এই তৃপ্তিই তাকে সবচেয়ে বেশি শান্তি দিতে পারে। শপিং বা চিকিৎসার জন্য যদি ভারত, সিঙ্গাপুর বা অন্য কোথাও যাওয়া কোনো সমস্যা না হয়, তবে মানসিক শান্তির খোঁজে কেউ যদি হজ করেন, তবে জটিলতা কোথায়?
একটি জাতির বিকাশিত হওয়ার নানা পর্যায় থাকে। স্বকীয়তাকে ধারণ করার পর্যায়ে প্রধান প্রতিপক্ষ কে, তা অনেক সময়ই অবচেতন মনেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর তা নানাভাবে প্রকাশ পায়। লড়াই যখন থাকে না, কিংবা প্রতিপক্ষ যখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, তখন সমীকরণ অনেকভাবেই বদলে যায়। এ কারণেই মিশরে বিভিন্ন মূর্তি (মিশরের মূর্তিগুলোর নাক ভাঙার কাজটি হয়েছে ইসলাম ধর্ম প্রচারের অনেক আগে। সম্ভবত খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকদের কারণে) কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় গরু নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় ঘোষিত গরুখেকো কিরেন রিজিজু প্রবল প্রতাপে থাকতে পারলেও বাড়ির ফ্রিজে গরুর গোশত থাকার সন্দেহে (যদিও পরে প্রমাণিত হয়েছিল, তা গরুর গোশত ছিল না) আখলাকদের কেন পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তার জবাবও এর মধ্যে আছে।
কিন্তু বাংলাদেশে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকায়, একটির অপরটির ওপর জয়ী হওয়ার চেষ্টা করতে থাকায় এখানকার অবস্থা ভিন্ন। কোনো একদিন এই বিবাদের নিরসন হলে মিসর, ইন্দোনেশিয়ার মতো অবস্থা এখানেও হতে পারে। আর এই বিরোধ কোনো এক পক্ষ দূর করতে পারবে না। উভয় পক্ষকেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে সমাধানের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। শুভবুদ্ধির উদয় হলে কোনো সমস্যাই থাকবে না।
এসব বিবেচনা করেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন : ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mdhasansharif@gmail.com

