ভাস্কো দা গামার ভারতযাত্রা : এক অভিশপ্ত সভ্যতার সূচনা
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পর্তুগিজ জলদস্যু ভাস্কো দা গামা ১৪৯৭ সালের আজকের দিনে তথা ৮ জুলাই লিসবন থেকে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার নৌপথ ‘আবিষ্কার’। আবিষ্কার বলাটা ভুল হবে। আরও আগে থেকে অনেকেই পথটি চিনত। কেবল ইউরোপিয়ানদেরই জানা ছিল না। আরব নাবিকদের সহায়তায় ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষে আসার পথটি খুঁজে পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমে ইউরোপিয়ানরা পথটির সন্ধান পায়। সুয়েজ খাল চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত এ পথেই ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ওই সময় পর্যন্ত এটিই ছিল দীর্ঘতম নৌযাত্রা। ক্রুসেডের সময় থেকে চলতে থাকা খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে সংঘাত নতুন মাত্রায় নিয়ে যান তিনি। তিনি তার ছয় বছরব্যাপী দুটি সফরে বেশ কয়েকটি নৌযুদ্ধে অংশ নেন। এগুলো তিনটি মহাদেশের ভাগ্য চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল।
ভাস্কো দা গামার এই ‘আবিষ্কারের’ রেশ ধরেই ইউরোপের অন্যান্য দেশ এখানে চলে আসে। আর এর ফলে নজিরবিহীন ভয়াবহ ধরনের এক ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সাক্ষাৎ পায় পুরো দুনিয়া। আগের সব সাম্রাজ্য ছিল স্থলজ। সংঘবদ্ধ এমন হত্যা, নৃশংসতা, লুটপাট, সভ্যতাবিনাশী কর্মকাণ্ড পৃথিবী কোনোকালেই দেখেনি। তারা আমাদের পরিচিতি পর্যন্ত পালটে দিয়েছে। জলজ এ আপদ পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই তছনছ করে দিয়েছিল। আর এত বছর পর এখনো এর তিক্ত স্বাদ আমাদের গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে ইউরোপিয়ানদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিকভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল নেমে আসে। মুক্ত, স্বাধীন দেশগুলো কয়েকশ বছরের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। নিজস্ব সংস্কৃতি, সামাজিক ব্যবস্থার অধঃপতন ঘটে। পর্তুগিজরা অবশ্য উপমহাদেশে বড় কোনো সাম্রাজ্য গড়তে পারেনি। বিশেষ করে ইংরেজ ও ফরাসিদের থেকে তারা বেশ পিছিয়ে ছিল। তবে লুণ্ঠন, অত্যাচারের দিক থেকে পিছিয়ে ছিল না। তাদের সাম্রাজ্যের পতনের পর তারা ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে উপমহাদেশে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে থাকে। সংক্ষেপে বলা যায়, ভাস্কো দা গামার ভারত আগমন ভারতবর্ষের জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা ছিল, যা বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভাস্কো দা গামার অভিযানের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ থেকে মসলা সংগ্রহ। এই মসলা ওই সময়ে ইউরোপের জন্য খুবই দরকারি পণ্য ছিল। প্রচণ্ড শীতে ফসল ফলত না। আবার গবাদিপশুও মরে যেত। এসব পশু বরফের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হতো। বরফে চাপা দেওয়া হলেও তাতে পচন ধরত। দুঃসহ পরিস্থিতিতে এ খাবারই তাদের খেতে হতো। পচা খাবারের দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে মসলাই ছিল ভরসা। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ থেকে মসলা যেত ইউরোপে। তবে তা যেত মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা হয়ে। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগপথ কনস্টানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) ছিল এদিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উসমানিয়াদের হাতে কনস্টানটিনোপলের পতন হলে বেকায়দায় পড়ে যায় ইউরোপ। মসলার জোগান পুরোপুরি নির্ভর করে উসমানিয়াদের মর্জির ওপর। এটা মেনে নেওয়া তাদের জন্য ছিল কঠিন। এমন প্রেক্ষাপটে শুরু হয় সাগরপথে ভারতবর্ষে যাওয়ার পথ আবিষ্কারের উদ্যোগ।
একইসঙ্গে, এটা কেবল একটি সাধারণ বা নতুন কিছুর অনুসন্ধানই ছিল না। কলম্বাসের যাত্রার মতো এটিও ছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড অভিযানের অংশবিশেষ। মুসলিমদের দমন এবং খ্রিষ্ট বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়া ছিল ঘোষিত উদ্দেশ্যই।
এদিকে আমেরিকা যাওয়ার পথ আবিষ্কারের পর পুরো বিশ্বকে শাসন করতে ইউরোপের দুটি নৌ পরাশক্তি স্পেন ও পর্তুগাল ১৪৯৪ সালে তর্দেসিলা চুক্তিতে সই করে। পোপের আশীর্বাদপুষ্ট এ চুক্তি বিশ্বকে দুটি প্রভাব বলয়ে বিভক্ত করে। এর একটি হলো স্প্যানিশ, অপরটি পর্তুগিজ। অর্থাৎ পোপ এ দুই দেশের হাতে পুরো পৃথিবী তুলে দিলেন। তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবে! কেপ ভার্দে দ্বীপমালার আনুমানিক এক হাজার মাইল পশ্চিমে পশ্চিম আফ্রিকায় ছিল এ বিভক্তিরেখা। এ রেখার পশ্চিম দিকের এলাকা ছিল স্পেনের, পূর্ব দিকের এলাকা ছিল পর্তুগালের।
এ প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় আড়ম্বরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ভাস্কো দা গামার। যাত্রা অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করার জন্য এক চৌমাথার মোড়ে গির্জায় নিজের মন্ত্রীদের সঙ্গে সিংহাসনে বসেছিলেন পর্তুগালের রাজা আর রানি। তাদের সামনে ঝুলছিল একটা পর্দা। গির্জার বিশপ ভাস্কো ডা গামার অভিযানের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করছিলেন তখন। প্রার্থনা শেষ হতেই পর্দার বাইরে এলেন পর্তুগালের রাজা অ্যামানুয়েল। এক পর্যায়ে অভিযানের তিন জাহাজের তিন কমান্ডার হাঁটু মুড়ে বসে অভিবাদন জানান রাজাকে।
লিসবন থেকে যাত্রা করার পর ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালের ২০ মে তার নৌবহরসহ দক্ষিণ ভারতের কালিকটের কাছাকাছি থাকা কাপ্পাডুতে এসে উপস্থিত হন। ভারতবর্ষে এসে গেলেন তিনি। এ ভ্রমণের মাধ্যমে এশিয়া ও ইউরোপ পানিপথে সংযুক্ত হলো। পাশাপাশি আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর যুক্ত হয়ে গেল।
ওই এলাকার রাজা ছিলেন জমোরিন। ভাস্কো দা গামা স্বভাবসুলভ তোয়াজ করার জন্যই প্রথম সাক্ষাতে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। যে কোনো মূল্যে ভারতবর্ষের সঙ্গে মসলা বাণিজ্য করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদ জর্জ এম টোলে লিখেছেন, ‘ভাস্কো ডা গামা জমোরিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি মহান, সবচেয়ে শক্তিশালী রাজাদের একজন আপনি। সবাই আপনার পায়ের তলায়। পর্তুগালের রাজা আপনার মহান কীর্তির কথা শুনেছেন। আপনার বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য আমার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনি যদি চান তাহলে আরও জাহাজ আসবে সেখান থেকে আর আপনার মহত্ত্বের কাহিনি জেনে তারা দেশে ফিরে যাবে। আমাদের সম্পর্কের ফলে কালিকটের বাণিজ্যও বাড়বে।’
এ আবেদনে বেশ খুশিই হয়েছিলেন রাজা। তাছাড়া বাণিজ্য হলে রাজ্যে অর্থের সমাগম হবে। এতে দেশ সমৃদ্ধ হবে। এ নগদ লাভের আশাতেই দীর্ঘকালীন ক্ষতির শিকার হয়েছিল ভারতবর্ষ। ঔপনিবেশিকরা সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়েছিল।
এ আবিষ্কারকে দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল পর্তুগাল। ১৪৯৯ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল সিনেস শহরটি ভাস্কো দা গামাকে পুরস্কার হিসাবে প্রদান করেন। পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জন ভাস্কো দা গামাকে ভারতের ‘ভাইসরয়’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাছাড়া ভারতের পশ্চিম উপকূলের কলোনিগুলোর শাসনকর্তাও ছিলেন তিনি। তবে খুব বেশিদিন তিনি নতুন দায়িত্ব উপভোগ করতে পারেননি। ১৫২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভাস্কো দা গামা মারা যান। কোচিনের সান্তা আন্তোনিও, পরে সেইন্ট ফ্রান্সিসে কবর দেওয়া হয় তাকে। ১৫৩৯ সালে তার লাশ পর্তুগালে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্থানীয় রাজা জমোরিনের সঙ্গে ভাস্কো দা গামার কথোপকথন থেকেও বোঝা যায়, ইউরোপের যে কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে সমৃদ্ধ ছিল কালিকট। ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশও ছিল সমৃদ্ধ। এ সফরের রেশ ধরে পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশও ভারতবর্ষে আসতে থাকে। বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের আশায় এলেও তাদের লক্ষ্য সেখানেই সীমিত থাকেনি। অন্যসব বিভাগেও ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয়রা কিন্তু শুরু থেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ভাস্কো দা গামার উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজা ছিলেন হিন্দু। তবে মুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। আর মুসলিম বণিকরা আগে থেকেই খ্রিষ্টান শক্তিগুলোর আগ্রাসী মনোভাব সম্পর্কে জানতেন। রাজাও পরে বুঝতে পেরেছিলেন। ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে একটু দেরিই হয়ে গেছে।
এই বাংলাও তাদের নির্মমতা থেকে রেহাই পায়নি। ‘হার্মাদদের’ (স্প্যানিশ আর্মাডা থেকে হার্মাদ) অত্যাচারের কাহিনি এখনো কান পাতলে শোনা যায়। ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো বাংলায় এসেছিল পর্তুগিজরা। পর্তুগিজ জলদস্যুরা ঘরবাড়ি পেতেছিল চট্টগ্রাম, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ, বরিশাল ইত্যাদি উপকূলীয় অঞ্চলে। এসব অঞ্চল সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় বিভিন্ন নৌযানে আক্রমণের সুবিধা ছিল বেশি। ঝটিকা হামলা করে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটি নিত তারা। তাদের হামলার কারণে উপকূলের অনেক এলাকা বিরান হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু শুধু ধন-সম্পদ নয়, পর্তুগিজদের লুটপাটের শিকার হয়েছিলেন বাংলার হাজার হাজার নারী। কখনো কোনো বাড়িতে হানা দিয়ে, কিংবা নদীর কূলে ডিঙি নৌকা নিয়ে নারীদের অপহরণ করত তারা। নিদারুণ নির্যাতন ও লাঞ্ছনার পর সেই নারীদের ক্রীতদাসী হিসাবে বিক্রি করা হতো আরাকানে।
পর্তুগিজদের রেশ ধরে আসা ওলন্দাজ (নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী), ফরাসি ও ইংরেজদের আগমন ঘটে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই পুরো উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর মাধ্যমে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়, যা স্থায়ী হয় ১৯০ বছর। পুরো সময়টিই ভারতবর্ষের সম্পদের লুণ্ঠনের ইতিহাস। বিশ্বের সেরা অর্থনীতি সবচেয়ে বিধ্বস্ত, সবচেয়ে গরিব দেশে পরিণত হয়। আর এ সবকিছুর সূচনা করেছিলেন এ জলদস্যু খলনায়ক।
মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক

