Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নতুন সাইবার অধ্যাদেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

Icon

সাকিব আনোয়ার

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন সাইবার অধ্যাদেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

প্রতীকী ছবি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা থেকে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রতিটি আইন তৈরি করা হয়েছিল, জনগণের কণ্ঠরোধ এবং বিরোধী মত দমনের উদ্দেশ্যে। হাজার হাজার মানুষকে এ কালো আইনের আওতায় গ্রেফতার করে অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হয়েছে। ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদ কারা নির্যাতনে মারা যান।

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইন কেতাবি নাম যেভাবেই পরিবর্তন করা হোক না কেন, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত আইনগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিবার এই আইন সংশোধনের নামে বিরোধী মত এবং জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণের আরও শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের আন্দোলনের পরিক্রমায় ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা স্বৈরাচার মুক্ত নতুন সম্ভাবনার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যাশা ছিল এ জনবিরোধী আইনের সংশোধন। অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রত্যাশাকে সামনে রেখে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ বাতিল করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করেছে। এ অধ্যাদেশ কি জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছে? নিঃসন্দেহে এ অধ্যাদেশ পূর্ববর্তী কালো আইনের অনেক বিতর্কিত ধারা এবং শাস্তির বিধান সংশোধন করেছে, অনেক ধারার অস্পষ্টতা দূর করার চেষ্টা করেছে, কিছু ধারা সংযোজন করেছে, নতুন কিছু অপরাধ চিহ্নিত করে শাস্তির বিধান করেছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করতে বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ করে ২৫ বার খসড়া পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষেত্রেই এই অধ্যাদেশ প্রত্যাশার পারদ স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪ বাদ পড়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ধারাগুলোয় নিষ্পন্নাধীন কোনো মামলা বা অন্য কার্যধারা ও তদন্ত বাতিল হবে এবং কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া এসব ধারায় আদালত বা ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত দণ্ড ও জরিমানা বাতিল হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায় হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এসব ধারাকে কুখ্যাত বলা হলেও নতুন অধ্যাদেশে এসব ধারার কিছু বিধান রাখা হয়েছে, যা নতুন করে জনগণের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর ৩৫ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি পুলিশ মনে করে যে, কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীনে অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাহলে তাকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে। আগের আইনেও পুলিশের এ বিতর্কিত ক্ষমতা ছিল। এ অধ্যাদেশে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা অনেক সংকুচিত করে ফেলায় বিধানটি আগের মতো উন্মুক্ত নয়। কিন্তু তারপরও এর অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাতসংক্রান্ত ২৮ ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। যেখানে এ সংক্রান্ত মামলা, তদন্ত ও সাজা সবই বাতিল হবে; কিন্তু একই বিধান নতুন অধ্যাদেশের ২৬ ধারায় রাখা হয়েছে। তাহলে একই ধারায় আগে যারা মামলায় পড়েছেন, তারা ভুক্তভোগী হিসাবে প্রতিকার পাচ্ছেন। আবার নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে একই অপরাধে নতুন করে অন্যরা শাস্তি পাবেন।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে ধারাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দায়ের সংক্রান্ত ৩৪ ধারাও রয়েছে; কিন্তু একই বিধান সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর ২৮ ধারায় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও আগের ভুক্তভোগীরা অধ্যাদেশের মাধ্যমে মামলা থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন জীবন পাবেন; কিন্তু নতুনরা দণ্ড পাবেন।

ক্রমবর্ধমান সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, শক্তিশালী ‘জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল’। কিন্তু এ কাউন্সিলও থাকছে সরকারের কর্তৃত্বে। নতুন অধ্যাদেশের আলোকে গঠিত এ কাউন্সিল হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী ও নির্দেশনামূলক প্ল্যাটফর্ম। ২৫ জনের হেভিওয়েট জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিলে ‘তথ্যপ্রযুক্তি বা মানবাধিকারবিষয়ক’ মাত্র দুজন বেসরকারি বিশেষজ্ঞের কথা আছে। এই দু’জনও হবেন সরকার মনোনীত। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কাউন্সিলের কার্যক্রমে সচিবালয় বা দাপ্তরিক সহায়তা প্রদান করবেন জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক। কাউন্সিলের সভায় প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করবেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণে একটি কেতাবি সুরক্ষা কাউন্সিল গঠিত হবে।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত সাইবার সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তা ব্লক বা অপসারণের করার জন্য এজেন্সির মহাপরিচালক বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এতে আরও বলা হয়েছে, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য, উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বাস করে যে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণামূলক বা জাতিগত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, যা সহিংসতা তৈরির উদ্বেগ সৃষ্টি করে বা বিশৃঙ্খলা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা প্রদান করে, তাহলে তা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এখানে, আশঙ্কার জায়গা দুটো। প্রথমত, জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উভয়েই সরকারের অধীনস্থ। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো ব্যক্তি কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হন, তবে তার প্রতিকার পাওয়ার খুব একটা সুযোগ অধ্যাদেশে নেই।

৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার বিধান থেকে শুরু করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর অনেক ভালো দিক রয়েছে। এই আইনে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাইবার প্রতারণাকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সাইবার স্পেসে নারী ও শিশু যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের মাধ্যমে যদি কোনো সাইবার অপরাধ করা হয় সেটাকে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। ভুয়া মামলা প্রি-ট্রায়াল স্টেজেই (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিচারককে। অর্থাৎ চার্জশিটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ভুয়া মামলা হলে বিচারক সঙ্গে সঙ্গে সেটা বাতিল করে দিতে পারবেন।

কিন্তু তারপরও জনগণের কণ্ঠরোধের পুরোনো ধারা থেকে এই অধ্যাদেশও দেশকে বের করে আনতে পারেনি। কয়েকদিন আগে, শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে ফেসবুক কটুক্তির জেরে পুলিশ পরিচয়ে রাস্তা থেকেই তুলে নেওয়া হয় এক স্কুল শিক্ষার্থীকে। থানা থেকে ফোন করে পরিবারকে জানানো হয় গ্রেফতারের খবর। পরদিন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় চালান করা হয় আদালতে। মামলার আগেই তুলে নিয়ে গিয়ে ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করে পুলিশ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই ঘটনা ঘটেছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ জারির পর। নতুন অধ্যাদেশেও প্রায় সব কর্তৃত্ব রাখা হয়েছে সরকারের হাতেই। সুযোগ আছে অপব্যবহারের। ৫৭ ধারা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আইনের অস্পষ্টতাকে কাজে লাগানো হয়েছে বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসাবে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এও অনেক ধারা এবং এসব ধারার অধীনে বিভিন্ন বিধানে অস্পষ্টতা রয়েছে। এ কারণেই প্রশ্ন থেকে যায়, আদৌ কি সুরক্ষা দিতে পারবে এ অধ্যাদেশ? জনগণের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি নিশ্চিত করা যাবে?

সাকিব আনোয়ার : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম