Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ফারসি থেকে কলকাতীয় উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ

মোহাম্মদ হাসান শরীফ

মোহাম্মদ হাসান শরীফ

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফারসি থেকে কলকাতীয় উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পাঠের অন্যতম সূত্র হলো, ফারসি বইপুস্তক ও দলিল-দস্তাবেজ। মুসলিম শাসনামলকে কাগজের যুগও বলেন কেউ কেউ। এখানকার মুসলিম শাসকরা মুদ্রণযন্ত্র এড়িয়ে গিয়ে বড় ধরনের একটি ভুল করলেও বইপত্র লেখার কাজে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন।

ইতিহাস চর্চাও হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমাদের ইতিহাসের জন্য এগুলো অনন্য সম্পদ। তবে এটিই স্বার্থান্বেষী একটি দল বিকৃতভাবে প্রচার ও প্রকাশ করে পুরো ইতিহাসকেই বদলে দিতে চাইছে। এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়নি। কয়েকটি পর্যায়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। প্রথমত, সামগ্রিক অনুবাদ হয়নি। খণ্ডিত অনুবাদের কারণে অনুবাদকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী খণ্ডিত ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অংশগুলো বাদ দিয়েছে।

ফলে ওই আমলের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি পাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, ভুল অনুবাদ হয়েছে। এটাও অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। এর ফলে মুসলিম আমল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিমদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র ছিল এটি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইতিহাস এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার আশঙ্কাও রয়েছে। এসব ইতিহাস প্রকাশ পেলে ইতিহাসের গতিধারাও পালটে যেতে পারে।

ইংরেজ আমলের সূচনাতে কাজটি শুরু হলেও কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বুদ্ধিজীবীদের’ হাত ধরে সেটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ তালিকায় যেমন আছেন সাধারণ অনেকে, আবার যদুনাথ সরকারের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম শাসনামলকে বিকৃত করেছেন বা করছেন।

ইংরেজরা বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজটি শুরু করেছিল। মুসলিম শাসকদের অপসারণ করে তারা ক্ষমতায় এসেছিল। এ কারণে তারা মুসলিম শাসনামলকে ভয়াবহ আমল হিসাবে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। এ আমলকে যত নৃশংসভাবে তুলে ধরা যাবে, তাদের শাসনের যৌক্তিকতা ততই প্রকট হবে বলে তারা মনে করত। তাদের আরেকটি লক্ষ্য ছিল। তা হলো, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন আদায়। তারা ইতিহাসকে এমনভাবে প্রকাশ ও প্রচার করেছিল, যার ফলে মনে হতে পারে যে, মুসলিম শাসনামল ছিল পুরোপুরি হিন্দুবিদ্বেষী। ফলে তাদের এখন উচিত ইংরেজ শাসনকে মুক্তির পথ হিসাবে গ্রহণ করা; এ শাসনব্যবস্থার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া। তাদের এ উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছিল।

এ কাজে ইংরেজ এবং তাদের এখানকার দোসররা ওই আমলের ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছিল। মুসলিম শাসনামলে সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। ফলে দরবারি সবকিছু ফারসিতেই লেখা হয়েছে। ফারসিতে লেখা ওইসব বইপুস্তক অনুবাদ, সম্পাদনার নামে হয়েছে ইতিহাস বিকৃতি। অবশ্য, সত্য কিছু দিন হয়তো চেপে রাখা যায়। চিরদিন তা করা যায় না। বর্তমানে বিষয়টির দিকে অনেক ইতিহাসবেত্তাই নজর দিয়েছেন। রমিলা থাপারের মতো ভারতীয় ইতিহাসবেত্তার পাশাপাশি রিচার্ড এম ইটন, অড্রি ট্রুসকের মতো পাশ্চাত্যের ইতিহাসবেত্তারাও আছেন এ তালিকায়।

অনুবাদের নামে ইংরেজ আমলের শুরু থেকে ফরাসি দলিল-দস্তাবেজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দেওয়া, বিকৃত করার কাজটি করা হয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহভাবে। এ ব্যাপারে নিউ জার্সির নিউয়র্কের রাটজার্স ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক সহকারী অধ্যাপক অড্রি ট্রুসকের মন্তব্য গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি যদুনাথ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। অথচ আওরঙ্গজেবের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন এ যদুনাথ সরকারই। যদুনাথ সরকার নিজে যেমন লিখেছেন, আবার আওরঙ্গজেবসংক্রান্ত বিভিন্ন বইপত্র অনুবাদও করেছেন। ট্রুসকে আরও বলেছেন, ‘আমরা সবাই যদুনাথ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেও তার বিশ্লেষণ ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ এবং অনেক সময় তাতে ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতার অভাব দেখা যায়। যারা যদুনাথ সরকারের পদ্ধতি ও কৃতিত্ব নিয়ে চিন্তা করতে চান, তাদের উচিত হবে দিপেশ চক্রবর্তীর দি কলিং অব হিস্টরি : স্যার যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিস এম্পায়ার অব ট্রুথ (শিকাগো, ২০১৫) বিবেচনা করা।’

তিনি তার আওরঙ্গজেব : দি ম্যান অ্যান্ড দি মিথ গ্রন্থে আরও বলেন, “জনপ্রিয়তার কারণে আমি যদুনাথ সরকারের মাইসির-ই আলমগিরির অনুবাদের কথা উল্লেখ করেছি। তবে পাঠকদের সতর্ক থাকতে হবে যে, যদুনাথের অনুবাদটি অসম্পূর্ণ, এতে ভুল রয়েছে (এই অনুবাদ নিয়ে আরও কিছু তথ্যের জন্য টিলম্যান কুলকের ‘অ্যা মোগল মুনসি অ্যাট ওয়ার্ক’ [ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, পিএইচডি থিসিস, ২০১৬], ১০-১৫, ২০-২২ দেখা যেতে পারে)”।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, তিনি আওরঙ্গজেবের ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদুনাথের অনেক কিছু বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস (কলকাতা, ১৯১৭) প্রলুব্ধ সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। এতে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে টুকরা টুকরা অনেক রসালো কাহিনি আছে। এতে অবশ্য অনেক ভুল তথ্যও রয়েছে। যদুনাথ সরকারও তা স্বীকার করেছেন, কিছু কিছু পাদটীকায় কয়েকটি ঘটনার সত্য ভাষ্যও উল্লেখ করেছেন। আমি যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করেছি, আওরঙ্গজেবের কথিত দ্বিতীয় উইল (দেখুন, অ্যানিডোটেস, ৫১-৫৫) এবং এ জাতীয় অনেক সম্ভাব্য বানোয়াট ভাষ্য পুরোপুরি বাদ দিয়েছি।’

আরেকটি ভয়াবহ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে পরিভাষা নিয়ে। ওই আমলের রচনাকৌশল হিসাবে ব্যবহার করা পরিভাষাগুলো আক্ষরিক অনুবাদ করার মাধ্যমে ওই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলায় ইসলামের বিকাশের কারণ নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত রিচার্ড এম ইটন জানিয়েছেন, “সম্ভবত ভারতবর্ষে ‘ইসলামী’ বিজয়ের বর্ণনাসংক্রান্ত প্রাথমিক ফারসি ভাষ্যগুলোর মাত্রাতিরিক্ত আক্ষরিক অনুবাদ থেকে এসব বিভ্রান্তির সৃষ্টি। ইউহানান ফ্রিডম্যানের মতে, এসব ভাষ্যে প্রায়ই দ্ব্যর্থবোধক কিছু বাক্য, যেমন ‘তারা ইসলামে দাখিল হলো,’ (ইতাত-ই ইসলাম নুমুদান্দ) বা ‘তারা ইসলামের অধীনে এলো,’ (দার-ইতাত-ই ইসলাম ইমাদান্দ) দেখা যায়। এখানে ‘ইসলাম’ বলতে বোঝানো হতে পারে ধর্ম, মুসলিম রাষ্ট্র বা ‘ইসলামের সেনাবাহিনী।’ কিন্তু এ ধরনের বাক্যের প্রাসঙ্গিক পঠনে তথা মুসলিম রাষ্ট্র বা ইসলামি সেনাবাহিনীই গ্রহণযোগ্য। সাধারণভাবে শেষের দুটি ব্যাখ্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ হিসাবে বিশেষভাবে বলা যায়, এসব সূত্র প্রায়ই ইন্দো-তুর্কি সেনাবাহিনীকে লস্কর-ই-ইসলাম বা ‘ইসলামের সেনাবাহিনী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, লস্কর-ই-তুরকান বা ‘তুর্কি সেনাবাহিনী’ হিসাবে নয়। অন্য কথায়, এর মাধ্যমে তারা ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। আরও সহজভাবে বলা যায়, এসব লেখার মাধ্যমে ইসলামি বিশ্বাসের প্রতি নয়, বরং তার সামরিক শক্তির কাছে মানুষকে আনুগত্য প্রকাশ করতে বলা হতো।”

ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে অনেক সময় হিন্দু-মুসলিম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মত প্রকাশ করা হলেও বাংলায় কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বুদ্ধিজীবীরা’ সর্বাত্মকভাবে একদেশদর্শী ইতিহাস প্রচার করে গেছেন। এ মত সমর্থন করেছেন ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা রমিলা থাপার। রমিলা থাপার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্থানের তুলনায় অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমবিদ্বেষী ইতিহাস সবচেয়ে বেশি প্রচার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বাংলার ইতিহাসগুলোতে ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাসকে ভিত্তি করে মুসলিমদের সম্পর্কে গৎবাঁধা তথ্য প্রদান করা হয়েছে, ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের চেয়ে ইসলামের ইতিহাস হিসাবেই বেশি করে তুলে ধরা হয়। কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। এ ব্যাপারে আগেই মহারাষ্ট্র ও অন্য কিছু জায়গার ইতিহাসবিদদের লেখালেখির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলার ওপর ব্রিটিশ ছাপ ছিল ব্যাপক ও অব্যাহত।’

এমন প্রেক্ষাপটে ফারসি কিতাবগুলো নতুন করে অনুবাদ করার কাজটি দ্রুত করতে হবে। ফারসি গ্রন্থগুলোর ইংরেজি অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ করার কথা বলা হচ্ছে না। বরং সরাসরি মূল ফারসি থেকে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরা অনুবাদগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এসব ইতিহাস পড়ে যারা ইতিহাস রচনা করছেন, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিকৃত হচ্ছে। বর্তমানে ইতিহাস নিয়ে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগটি ব্যবহার করা উচিত।

মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম