গণতান্ত্রিক সন্ধিক্ষণ : চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও আগামীর পথচলা
ব্রি. জেনারেল (অব.) এইচআরএম রোকন উদ্দিন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতার পর অন্যতম নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন। এর পরপরই নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি নির্ণায়ক মোড়ে দাঁড়িয়ে-যেখানে নেওয়া সিদ্ধান্তই ঠিক করবে দেশ একটি স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে রূপ নেবে নাকি আবার স্বৈরতান্ত্রিকতার চক্রে পড়ে যাবে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো
১. নিরাপত্তা খাতের দায়মুক্তি ও জননিরাপত্তা : ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শত শত মানুষ নিহত হয়। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সংস্কার এখনো অসম্পূর্ণ। এগুলো যদি জবাবদিহির আওতায় না আনা হয়, আবারও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
২. নির্বাচনি রোডম্যাপের অনিশ্চয়তা : অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি দিয়েছে। কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো কি থাকবে? নির্বাচন কমিশন কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে? সব দল কি অবাধ অংশ নিতে পারবে? প্রধান দলগুলোর মাঝে মতপার্থক্যের কি অবসান হবে? এ প্রশ্নগুলো সমাধান না হলে নির্বাচন বর্জন বা সহিংসতার ঝুঁকি থেকেই যাবে।
৩. রাজনৈতিক মেরূকরণ ও দলীয় বিভাজন : বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছে। অপরদিকে ছাত্রনেতা ও ইসলামপন্থিরা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিসহ নতুন রাজনৈতিক দল গড়েছে। এতে জোট রাজনীতি জটিল হয়ে উঠছে, আর আস্থার সংকট বাড়ছে।
৪. আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : সমালোচিত ২০২৩ সাইবার সিকিউরিটি আইন আংশিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এখনো নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত। শক্তিশালী আইনি সুরক্ষা না থাকলে গণতন্ত্রে আস্থা জন্মাবে না।
৫. সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও উগ্রবাদ : বিপ্লব-পরবর্তী সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে উত্তেজনা থাকলেও বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর কয়েকটি রাজনৈতিক হামলা ছাড়া তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ভারত ইসলামি মৌলবাদ ও উগ্রবাদের বয়ান তৈরি করে আবার বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
৬. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা : অর্থনীতি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল ব্যাংক খাত, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বিনিয়োগের ঘাটতি ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। আইএমএফ, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা থাকলেও দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ ছাড়া স্থিতিশীলতা আসবে না।
৭. বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য : ২০২৪-এর পরিবর্তনের সময়ে সেনাবাহিনী মধ্যস্থতার ভূমিকা নেয়। এখন প্রশ্ন হলো, সংবেদনশীল সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনী কি বেসামরিক কর্তৃত্বের অধীন থাকবে?
সম্ভাবনার জানালা
১. যুব ও নাগরিক শক্তির উত্থান : ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করেছে যুবশক্তিই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। তাদের সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্তি নতুন নেতৃত্ব ও বহুত্ববাদী মূল্যবোধ আনতে পারে, যদি তারা দলীয় রাজনীতির কবলে না পড়ে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুযোগ : অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। জুলাই ঘোষণা-এর মাধ্যমে একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে। যদি তা আইনে পরিণত হয়, তবে বাংলাদেশে সত্যিকারের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রতিষ্ঠিত হবে।
৩. ডিজিটাল অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা : সাইবার সিকিউরিটি আইনের কড়াকড়ি শিথিলের উদ্যোগ এবং ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতির প্রস্তাব নাগরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।
৪. জবাবদিহি ও সম্পদ পুনরুদ্ধার : দুর্নীতি তদন্ত, ব্যাংক খাতের অডিট এবং বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক আস্থার জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
৫. বৈদেশিক সহায়তা : আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা অর্থনীতিকে সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে। সঠিকভাবে কাজে লাগালে এটি রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সময় ও সুযোগ তৈরি করতে পারে।
আগামী ৬-১২ মাসে নজর রাখার বিষয়
১. নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও কাঠামো : বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন মূলত নির্ভর করছে নির্বাচনের ওপর। জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হলে নির্বাচনের কাঠামো নির্ধারণ করা জরুরি।
২. নিরাপত্তা খাতের জবাবদিহি : ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী দমনপীড়নে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, অসংখ্য নিরীহ নাগরিক গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য এখন প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত ও দোষীদের বিচার। শুধু তাই নয়, পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি, যাতে তারা আর কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না হয়।
৩. আইনের শাসনে অগ্রগতি : গণতন্ত্রের প্রাণ হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে বহু নাগরিক, সাংবাদিক ও কর্মী হয়রানির শিকার হয়েছে। তাই দ্রুত নতুন আইন কার্যকর করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪. অর্থনৈতিক সংস্কার : অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত, আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গুর। আগামী মাসগুলোয় প্রয়োজন হবে, ব্যাংক খাতের স্বচ্ছ অডিট রিপোর্ট প্রকাশ, প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
৫. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর দাঁড়ানো। আগামী মাসগুলোয় সরকারের দায়িত্ব হবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। এতে কেবল দেশীয় সম্প্রীতিই জোরদার হবে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, যদি সরকার আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না এবং বাংলাদেশ সত্যিই একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হবে।
সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ এখন একটি সংঘাতপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে। যদি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়, নির্বাচন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয় এবং বেসামরিক কর্তৃত্ব সুসংহত থাকে, তবে বাংলাদেশ অবশেষে দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়তে পারবে। অন্যদিকে যদি সংস্কার স্থবির হয়, নির্বাচন বিলম্বিত বা কারচুপিপূর্ণ হয়, কিংবা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়ে যায়, তাহলে দেশ আবারও স্বৈরতন্ত্রের চক্রে ফিরে যেতে পারে।
ব্রি. জেনারেল (অব.) এইচআরএম রোকন উদ্দিন, পিএসসি : সাবেক সামরিক কূটনীতিক, গবেষক ও লেখক
