Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

সৌরবিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ

Icon

সুরাইয়া আক্তার

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আধুনিক পৃথিবীর সভ্যতা এবং অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ঘরের অন্ধকার দূর করা থেকে শুরু করে মহাকাশ অভিযান পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে আলোকশক্তি ও তাপশক্তি সরবরাহ, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি চালনা, যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করা, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। মানবজীবনে চব্বিশ ঘণ্টাই বিদ্যুৎশক্তির একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যায়। আর সেই বিদ্যুৎ যদি সহজলভ্য হয়, তবে তা যে কোনো দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর। সে ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ হতে পারে আশার আলো।

সূর্যের আলো থেকে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে সৌরশক্তি বলা হয়। সৌরশক্তি ব্যবহার করে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তাই সৌরবিদ্যুৎ। সৌরবিদ্যুতের আবিষ্কারক ধরা হয় ফরাসি বিজ্ঞানী এডমন্ড বেকেরেলকে। তিনিই প্রথম ১৮৩৯ সালে ফটোভোলটাইক প্রভাব আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন, আলোর উপস্থিতিতে কিছু পদার্থ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। ১৯৮১ সালে চার্লস ফ্রিটস প্রথম বাণিজ্যিক সৌরকোষ তৈরি করেন এবং ১৯৫৪ সালে বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা প্রথম কার্যকরী সিলিকন সৌরকোষ তৈরি করেন। সূর্যের আলো থেকে সরাসরি ফটোভোলটাইক প্যানেল ব্যবহার করে বা পরোক্ষভাবে ঘনীভূত সৌরশক্তি ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যথোপযুক্ত উচ্চ কম্পাংকের সূর্যের আলো যখন সৌর প্যানেলের ওপর ফেলা হয়, তখন সেখান থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। নিঃসৃত ইলেকট্রন প্রবাহিত হওয়ার ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি হয়। আবার লেন্স বা আয়নার মাধ্যমে সূর্যের আলোকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে তাপশক্তি তৈরি করা হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

এ মহাবিশ্বের বেশিরভাগ এলাকা প্লাজমা দিয়ে গঠিত। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলীর প্লাজমার মধ্যে থার্মোনিউক্লীয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফিউশন সংঘটিত হচ্ছে এবং অফুরন্ত শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। সূর্যের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা ৬,০০০ কেলভিন এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১.৫x১০৭ কেলভিন। সূর্য সর্বক্ষণই তার তাপ, আলো ও অন্যান্য শক্তি বিকিরণের আকারে বিচ্ছুরণ করা সত্ত্বেও সময়ের সঙ্গে সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কোনো হ্রাস পরিলক্ষিত হয় না। আসলে সূর্যের অভ্যন্তরের প্রচণ্ড উত্তাপে স্বনির্ভর থার্মোনিউক্লীয় বিক্রিয়া হয়, যা সূর্যের এ অফুরন্ত শক্তির উৎস। এ শক্তি কয়লা, গ্যাস ইত্যাদি অনবায়নযোগ্য শক্তির মতো শেষ হবে না। সূর্যের এ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ, উন্নত এবং বিশ্বমানের করা সম্ভব।

সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলো থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সৌর প্যানেল হলো সিলিকনভিত্তিক ফটোভোলটাইক কোষ দিয়ে তৈরি, যা সূর্যালোককে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে। সৌর প্যানেলের মূল উপাদান সিলিকন বালি থেকে তৈরি হয়। সিলিকন গলিয়ে স্ফটিক ইনগট তৈরি করা হয়, যা পরে পাতলা ওয়েফার এ কাটা হয়। ওয়েফারগুলোতে ফসফরাস বা বোরনের মতো উপাদান মিশিয়ে ডোপায়ন বা ডোপিং করা হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওয়েফারের ইলেকট্রনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহায্য করে। কোষগুলোর ওপর একটি অ্যান্টি রিফ্লেক্টিভ কোট দেওয়া হয়, যাতে বেশি সূর্যালোক কোষে প্রবেশ করতে পারে। পরে কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করে একটি মডিউল তৈরি করা হয় এবং কোষগুলো একটি কাচের স্তরের ওপর বসানো হয়। সৌর প্যানেলের ওপরের স্তর টেম্পারড গ্লাস দিয়ে তৈরি যা প্যানেলের সৌর কোষগুলোকে বাইরের ধুলোবালি, বৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এ গ্লাসটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও টেকসই হয়। পরিশেষে এর চারপাশে একটি অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেম যুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশের বালি সাধারণত ইলেকট্রনিক গ্রেড সিলিকন তৈরির উপযোগী নয়। কারণ ইলেকট্রনিক গ্রেড সিলিকন তৈরির জন্য অতি বিশুদ্ধ সিলিকা বালি প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে নেই। তাই এটি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তা ছাড়া সৌর প্যানেল তৈরি করার অন্য উপাদানগুলোও বিদেশ থেকে আনতে হয়। তবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উৎস সূর্যালোক বাংলাদেশে সারা বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে উচ্চ সৌর বিকিরণ স্তর রয়েছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী।

বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুতের সহায়তা দিন দিন বাড়ছে। অনাবাদি জমিতে স্থাপিত তিস্তা সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি দেশের জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, যা গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সহায়তা করে। দেশের প্রথম ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুলনপুরে অবস্থিত। এটিও জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েই চলছে। এ বাড়তি চাহিদা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পূরণ করা যেতে পারে। আমাদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সৌরবিদ্যুতের সুবিধা হলো একবার সোলার প্যানেল স্থাপন করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো ঘাটতি হবে না। কোনো বাড়তি বিলও দিতে হবে না। বাংলাদেশে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য প্রচুর জায়গা রয়েছে। নদী বিধৌত চরাঞ্চল, অব্যবহৃত জমি এমনকি পানির উপরে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সম্ভব। বাংলাদেশের শহরগুলোতে রয়েছে অসংখ্য উঁচু ভবন। এসব ভবনের ছাদ হতে পারে একেকটি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র। গ্রামীণ এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে সৌর প্যানেল স্থাপন করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায় এবং বিদ্যুৎ খরচ কমানো সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ ব্যক্তিগত চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে।

পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানি হিসাবে সারা বিশ্বে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সৌরবিদ্যুৎ অন্যতম ভরসা হতে পারে। কয়লা, গ্যাস ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসাবে সৌরশক্তি কাজে লাগানো যায়। যেহেতু বাংলাদেশে সারা বছর প্রচুর সূর্যালোক পাওয়া যায়, তাই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও তা অত্যন্ত সহায়ক। বর্তমানে সোলার প্যানেলের দামও কমছে। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য সৌরবিদ্যুৎ অপরিহার্য।

প্রাবন্ধিক ও প্রভাষক (পদার্থবিজ্ঞান), বিক্রমপুর আদর্শ কলেজ, মুন্সীগঞ্জ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম