Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ও বাংলাদেশের শ্রমবাজার

Icon

আরমীন আমীন ঐশী

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মরুভূমিতে যারা ঘাম ঝরায় তারা জানে প্রতি ফোঁটা ঘাম একেকটা স্বপ্নের দানা। বাংলাদেশের লাখো প্রবাসী শ্রমিক সেই মরুর বুকে নিজেদের স্বপ্ন বুনেছে-কেউ সন্তানের পড়ালেখার জন্য, কেউ অসুস্থ মায়ের ওষুধ কেনার জন্য, কেউ ভাঙা ঘরে নতুন চাল দেওয়ার আশায়। কিন্তু আজ সেই মরুতে ঝড় উঠেছে। যুদ্ধ, সংঘাত আর কূটনৈতিক উত্তেজনায় তাদের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। যাদের রেমিট্যান্সে দেশ চলে, আজ তারাই দেশে ফিরছে খালি হাতে, চোখে জল আর বুক ভরা আশা নিয়ে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান কর্মসংস্থানের জন্য। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন-এ দেশগুলোই বাংলাদেশি শ্রমবাজারের প্রধান গন্তব্য। দীর্ঘদিন ধরেই এ দেশগুলো বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের মূল উৎস হয়ে রয়েছে। ২০২৪ সালেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৭০ শতাংশ এসেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজনৈতিক সংঘাত, অভ্যন্তরীণ সংস্কার, যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এ শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর হার কমেছে ১৮ শতাংশ আর ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে কমে হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ভিসা জটিলতা এবং কোটার কারণে কুয়েতে শ্রমিক পাঠানোর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশেষ করে ইসরাইল ও গাজার সংঘর্ষের পর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আসে, সেই সঙ্গে নতুন শ্রমিক নিয়োগেও কোনো অগ্রগতি নেই বরং ২০২৪ সালের শেষ দিকে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ হারিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরে এসেছেন।

ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা, ইয়েমেন যুদ্ধ, সিরিয়ার অস্থিরতা আর গাজার সংঘর্ষ পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ এখন কাজে বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ কম দিচ্ছে এবং স্থানীয় শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক এখনো কাজে অদক্ষ। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতি থাকায় শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। এছাড়া বৈধ প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে অনেক শ্রমিক কাজের জন্য বাইরের দেশে যায়, যা তাদের ঝুঁকিতে ফেলছে।

বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় বিকল্প শ্রমবাজার তৈরি করতে হবে এবং তা বিস্তারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো দরকার। প্রবাসীরা কাজ হারালে সরকারি ও এনজিও উদ্যোগে সহায়তা তহবিল গঠন করা এবং দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনরুদ্ধার কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি রেমিট্যান্সের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও আমাদের পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি ঠিক থাকলে এ সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। আজ যে মরুতে ঝড় উঠেছে, কাল হয়তো সেই মরুতেই নতুন করে স্বপ্নের বীজ বোনা যাবে। শুধু দক্ষতা আর নীতিগত সাহসের দরকার। সরকার, বেসরকারি খাত এবং জনগণ সবাই মিলে এগিয়ে এলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়।

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম