Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ

Icon

নূরজাহান নীরা

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শীতকালের কথা বলতেই যেসব জিনিসের কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে খেজুরের রস অন্যতম। শীত মানেই যেন খেজুরের রস। কনকনে শীতের সকালে এক গ্লাস খেজুরের রসের তৃষ্ণা যেন বাঙালির আজন্ম ধারায় মিশে আছে। খেজুর রসের পিঠা-পায়েস ছাড়া যেন শীতকাল অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গ্রামীণ জনপদ রসের ম ম গন্ধে ছেয়ে থাকে শীতের সময়টায়। রোদ পেলে রসে গাঁজন তৈরি হয়, রস টক ও ঝাঁজাল হয়ে যায়। তাই কুয়াশা থাকতেই রস সংগ্রহ করতে হয়। রোদ বাড়ার আগেই খাওয়া হয় কাঁচা রস।

রস অল্প জ্বালিয়ে তাতে ভেজানো হয় চিতই পিঠা, করা হয় রসের পায়েস। রস জ্বালিয়ে বানানো হয় গুড়। রস ঘন হতে শুরু হলে সেই রস তুলে তা দিয়ে মুড়ি, খই ও চিড়ার মোয়া বানানো হয়। খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা বানানো হয়। শীতের সকালে রসে ভেজা রসচিতই বা গরম গরম ভাপা পিঠা শীতের সকালের ক্লান্তি দূর করে মনকে রাঙিয়ে দেয়। এ খেজুরের রস হলো খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রস। শীত পড়তে শুরু করলেই গাছ থেকে রস বের হওয়া শুরু হয়। তাই শীত আসার আগেই হেমন্তের শুরু থেকে গাছিরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। শীতকালে গ্রামের এ দৃশ্যগুলোও বেশ মনোরম। খেজুরের রস খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। খেজুরের রসপান করলে শরীর সতেজ হয়ে ওঠে, ক্লান্তি দূর হয়। খেজুর রসকে প্রকৃতির এনার্জি ড্রিংকও বলা হয়। এতে ১৫-২০ শতাংশ দ্রবীভূত শর্করা থাকে। এ রসে লৌহ বা আয়রন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হলে এতে আয়রন প্রচুর বেড়ে যায়। বাংলাদেশে খেজুর রস ও খেজুর গুড়ের পিঠা খাওয়া বেশ প্রচলিত, তাই জনগোষ্ঠীর মোটামুটি এক-পঞ্চমাংশ শীতকালে রক্ত স্বল্পতার হাত থেকে রক্ষা পায়। পেশির স্বাভাবিক কার্যকারিতা সচল রাখতে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং ক্লান্তি দূর করে ম্যাগনেসিয়াম, যা খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে থাকে। খেজুর রসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়াম। এটি হাড় ও পেশি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাড়ের প্রধান উপাদান ক্যালসিয়ামের অভাব দূর করে এ খেজুর রস। খেজুর রসে বিটামিন বি-৩ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে; যা জীবনী শক্তিকে সতেজ করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। রসের মিষ্টি অশোধিত চিনি। এটি ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যায়; ফলে দেহে চর্বি কম জমে। কিন্তু সাধারণ চিনি দ্রুত রক্তে মেশে, তাই চিনির খুব ভালো বিকল্প হতে পারে খেজুরের রস। প্রচুর ফাইবার বা আঁশ থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে, অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে।

গুণে ও স্বাদে ভরপুর গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সেই রসের গাছ এখন আগের মতো নেই। সারা গ্রাম ঘুরে হাতেগোনা কিছু গাছের দেখা মেলে। তাতে যা রস পাওয়া যায়, তা গাছিরা বিক্রি করেন অনেক দামে। তা না হলে গাছিরও পোষায় না। আর এ বাড়তি দামে সবাই রস কিনে খেতে পারে না। গ্রামের অধিকাংশ খেজুর গাছ চলে গেছে ইটের ভাটায়। অভাবে পড়ে অনেকে রসপূর্ণ গাছগুলো নামমাত্র টাকায় বিক্রি করে। এখন তাই খেজুর গাছের দেখাই মেলে না তেমন। খেজুর রস ও গুড়ের জন্য এক সময় যশোর জেলার সুনাম ছিল। এখন সে সুনাম অনুযায়ী গুড় যশোর জেলায় উৎপাদন হয় না। আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে এখনই সচেতন হতে হবে। রোপণ করতে হবে প্রচুর খেজুর গাছ। যেহেতু এ গাছ অল্প জায়গায় বেড়ে উঠতে পারে, তাই বসতবাড়ির আশপাশেই লাগানো যায়। কৃষিজমির আইলে লাগানো যায়। অল্প যত্নে, অল্প খরচে, অল্প জায়গায় বেড়ে ওঠা এ গাছের উপকারিতা অনেক। খেজুরের পাতাও নানা কাজে ব্যবহার করা যায়। খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি বোনা যায়, বেড়া দেওয়া যায়, এ পাতা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পও বানানো যায়। এ শীত মৌসুম শেষে যে খেজুর আসবে তা থেকেই চারা সংগ্রহ করে তা রোপণ করা যেতে পারে। তাহলে আবারও খেজুরের রসে ভরে উঠবে গ্রামবাংলা।

চিকিৎসক ও লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম