Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বাধ্যতামূলক হোক শারীরিক শিক্ষা

Icon

মোহাম্মদ রায়হান হোসাইন

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে প্রায় সব কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলের বাটন চেপে। এক দেশে বসে হাজার হাজার মাইল দূরের অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে খুব সহজেই। ফলে জীবনযাপন হয়েছে সহজ থেকে সহজতর। আমরা বলতেই পারি, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে আমরা চলছি সুপার ফাস্ট স্পিডে। এ তো গেল প্রযুক্তির সুবিধা বা ইতিবাচক দিক। কিন্তু মুদ্রার এপিঠের পাশাপাশি ওপিঠও আছে। যেমন, প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার বাংলাদেশের সর্বত্রই কিশোর থেকে যুবকদের ভয়ানকভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্ত করেছে। বিশেষ করে মোবাইল গেমের আসক্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ৮-১০ জনের সংঘবদ্ধ দলকে পাবজি, ফ্রি-ফায়ার ইত্যাদি গেম খেলতে দেখা যায় মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে। যে মাঠে এক সময় চলত নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সেই মাঠ এখন ফাঁকা। এতে একদিকে যেমন প্রতিদিন মূল্যবান সময় তাদের নষ্ট হচ্ছে, তেমনি কিশোর-যুবকরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়। চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, শুক্রাণু কমে যাওয়া, ঘুম কম হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদির মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় তারা পতিত হচ্ছে। পাশাপাশি নানা ধরনের অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এ মোবাইল গেমসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অনলাইন জুয়া, যে জুয়ার অর্থ সংগ্রহ করতে অনেক সময় কিশোর-যুবকরাই জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে। যে অপরাধ পরবর্তীকালে তাদের বড় অপরাধের দিকে ধাবিত করছে। যার বড় উদাহরণ, ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান। শারীরিক পরিশ্রম না করার জন্য তারা একদিকে যেমন শারীরিক সক্ষমতা হারাচ্ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবেও দুর্বল হচ্ছে। এতে করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পতিত হচ্ছে হুমকির মুখে। ফলে আমরা বললেই পারি, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমাদের জীবনমান বৃদ্ধি পেলেও এ প্রযুক্তির প্রভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও বাড়ছে।

প্রযুক্তি আমাদের বাহ্যিক জীবন সুন্দর করলেও নৈতিকতার স্খলন ঘটাচ্ছে, ঘটাচ্ছে আচরণগত পরিবর্তনও। ফলে এ পরিস্থিতিতে এসে বোধহয় আমাদের একটু থামতে হবে! কেননা প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে আমাদের শারীরিক অক্ষমতা বাড়ছে। সবকিছু প্রযুক্তির ছোঁয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সম্পন্ন করার ফলে আমাদের মধ্যে শারীরিক কঠোর পরিশ্রম করার প্রয়োজন ও তাগিদ-উভয়ই কমে যাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন রোগের দেখা মিলছে প্রতিনিয়ত। শারীরিক পরিশ্রম না করায় ‘ইমিউন সিস্টেম’ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। যার বড় প্রমাণ আমরা ২০১৯ সালে শুরু হওয়া মহামারি করোনার মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। যে মহামারিতে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর অন্যতম কারণের মধ্যে চিকিৎসকরা আমাদের শরীরে ‘ইমিউন সিস্টেম’ বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। ‘ইমিউন সিস্টেম’ ভালো রাখার গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো শারীরিক পরিশ্রম। যার অভাবে শরীর বিভিন্ন ভাইরাসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য ব্যাকরণ, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, কিংবা মানসিক দক্ষতা অধ্যয়নের লড়াই চলছে। এতে শিক্ষার্থীরা কয়েকটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করলেও তাদের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার যে প্রয়োজন, সেটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের প্রয়োজন একাধিক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় সমৃদ্ধ পাঠ্য বিষয়ের। যে বিষয় শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার শিক্ষা দেবে। পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ সব বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্য হিসাবে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। শারীরিক শিক্ষা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। সমাজে কীভাবে একজন সুনাগরিক কিংবা একজন দক্ষ নেতা হয়ে ওঠা যায়, সেই শিক্ষা দেয় শারীরিক শিক্ষা।

আধুনিক শারীরিক শিক্ষার জনক জার্মান স্কুল শিক্ষক ও বিশ্বখ্যাত জিমন্যাস্ট জোহান ফ্রেডরিখ লুডউইক জন (১৭৭৮-১৮৫২) প্রথম পাঠ্য বিষয় হিসাবে শারীরিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য তিনি তাদের মধ্যে শারীরিক শিক্ষার জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর জোর দেন। জার্মান সরকারও তার বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে। পরবর্তীকালে জনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম স্কুলের পাঠ্য বিষয় হিসাবে শারীরিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরই পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও শারীরিক শিক্ষা পাঠের প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে শারীরিক শিক্ষা আজ একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমা দেশগুলো শারীরিক শিক্ষার যে সুফল পাচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখলেই। বাংলাদেশেও বিষয় হিসাবে শারীরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। যার মধ্যে দুটি কারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কিংবা শরীরচর্চায় শিক্ষার্থীরা অংশ নেবে। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এতে শারীরিক সক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি মানসিক সুস্থতা ও সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। যার ইতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার্থীদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি কমবে। এতে করে দেশ পাবে সুস্থ ও সবল জাতি।

দ্বিতীয়ত, সামরিক প্রশিক্ষণের বিকল্প হিসাবে শারীরিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। আমরা জানি, প্রাচীনকালে যুদ্ধ জয়ের জন্য সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শরীরচর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমানে আমাদের যুবসমাজকে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষার্থীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার আলোচনা চলছে, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তবে সেনাবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণের বিকল্প হিসাবে শারীরিক শিক্ষা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এতে দেশ পাবে শক্তিশালী জাতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। উপরোক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেই আমরা বুঝতে পারি, শিক্ষাব্যবস্থায় শারীরিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক শিক্ষা একদিকে যেমন শিশুর মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখবে, তেমনি রাখবে রোগমুক্ত।

প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম