এআই কি ফ্যাক্ট চেকিংয়ে সাহায্য করতে পারে
ড. শাহ জে মিয়া
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকের আলোচনায় আমরা ফ্যাক্ট চেকিং বা সত্যতা যাচাইকরণের গুরুত্ব এবং কীভাবে সেটা যাচাই করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করব। ফ্যাক্ট চেকিং হলো যে কোনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়বস্তু, প্রতিবেদন বা বিবৃতির নির্ভুলতা ও সত্যতা যাচাই করার একটি প্রক্রিয়া। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন ধাপ ও কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে। কোনো সংবাদ বা তথ্য প্রকাশের আগে কিংবা পরে এটি করা যেতে পারে। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ফ্যাক্ট চেকিং দুই ধরনের হতে পারে : অভ্যন্তরীণ, যা প্রকাশকরা ভুল তথ্য প্রকাশ রোধ করার জন্য নিজেরা করে থাকেন; এবং বাহ্যিক, যেখানে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা উৎপাদিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে সত্যতা যাচাইয়ের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের বা যে কাউকে এমন ভুল ধারণাগুলো সংশোধন করতে সাহায্য করা, যা সমাজকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনের সময় ভুয়া বিষয়বস্তু বা খবর রাজনীতিকদের বিভ্রান্ত করতে পারে। কিন্তু ফ্যাক্ট চেকিং স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্য ধারণা তৈরির জন্য সত্য অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এটি সাধারণত সংশোধনী বা ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া বা অভিজাতদের কম নির্ভুল দাবির ভিড়ে চাপা পড়ে যাওয়া সত্যকে সামনে আনে। তাই আমি মনে করি, রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা বা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট চেকিং আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আসুন ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাক। উইকিপিডিয়া এবং কলিন ডিকির তথ্যমতে, এর গুরুত্ব অনেক আগে থেকেই স্বীকৃত। ১৮ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস প্রতিষ্ঠার সময় সংক্ষিপ্ত ও সত্য তথ্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯১২ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের রাল্ফ পুলিৎজার ‘ব্যুরো অব অ্যাকিউরেসি অ্যান্ড ফেয়ার প্লে’ প্রতিষ্ঠা করেন। হেনরি লুস এবং তার টাইম ম্যাগাজিন (যার প্রকৃত নাম ছিল ‘ফ্যাক্টস’) এবং দ্য নিউ ইয়র্কারের বিখ্যাত ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে অনলাইন স্টার্টআপগুলোর কারণে মূলধারার মিডিয়া বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বড় ধরনের অর্থনৈতিক হুমকির মুখে পড়েছে। ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পলিটিফ্যাক্ট, ফ্যাক্টচেক.অর্গ এবং ওয়াশিংটন পোস্টের ফ্যাক্ট চেকার তাদের মূল্যায়নে ব্যাপকভাবে একমত পোষণ করে। তবে ২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, বিভিন্ন সংস্থার যাচাই করা বিবৃতিগুলোর মধ্যে খুব কমই মিল থাকে। পলিটিফ্যাক্ট এবং ওয়াশিংটন পোস্টের শত শত রিপোর্ট তুলনা করে দেখা গেছে মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা একই বিবৃতি যাচাই করেছে, তবে সেই ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের রেটিংয়ের মিল ছিল প্রায় ৯২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রবৃদ্ধি ২০১৬ সালের দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত হয়, বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ব্রেক্সিট গণভোটের মতো প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর পর। এ ঘটনাগুলো অপপ্রচার (disinformation) এবং ভুয়া খবরের বিপদকে সামনে নিয়ে আসে (Vinhas & Bastos, 2022)। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম প্রসারিত হয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে গুগল পরিচালিত ডেটাবেস ‘ClaimReview'-এ সারা বিশ্বের ফ্যাক্ট-চেকারদের দ্বারা যাচাই করা প্রায় ৩ লাখ দাবি জমা হয়েছে।
উইকিপিডিয়া তথ্যমতে ফ্যাক্ট চেকিং ‘অ্যান্টি হক’ (Ante hoc) হতে পারে, যার লক্ষ্য হলো ভুয়া বিষয়বস্তু বা ত্রুটিগুলো প্রকাশ করার আগেই চিহ্নিত করা, যাতে সেগুলো সংশোধন বা বাতিল করা যায়। অথবা এটি ‘পোস্ট হক’ (Post hoc) হতে পারে, যা প্রকাশের পর ভুলের লিখিত প্রতিবেদন বা ভিজ্যুয়াল মেট্রিক (যেমন: পলিটিফ্যাক্টের রেটিং) প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উভয়ভাবেই কাজ করছে। স্বাধীন সংস্থাগুলোর দ্বারা ‘পোস্ট হক’ ফ্যাক্ট চেকিং মূলত ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকায় এটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। বিভিন্ন সংস্থার বিষয়বস্তু নির্বাচনের প্রবণতা ভিন্ন হতে পারে; যেমন কেউ হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন যে সত্য তা প্রমাণ করতে আগ্রহী, আবার কেউ হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন যে ভুয়া, তা প্রমাণ করতে আগ্রহী।
আসুন এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফ্যাক্ট চেকিং সম্পর্কে জানি। বোজকুর্ট (Bozkurt, 2025) একটি চমৎকার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন এআই কীভাবে ফ্যাক্ট চেকিংয়ে সাহায্য করতে পারে। এখানে দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে : কোনটি সত্য সংবাদ হিসাবে গণ্য হবে তা নির্ধারণ করা এবং নজিরবিহীন গতিতে ছড়িয়ে পড়া অপপ্রচার বা ডিসইনফরমেশন মোকাবিলা করা। উভয় সমস্যা সমাধানের জন্য এআইয়ের সঙ্গে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করে আমরা প্রয়োজনভিত্তিক সমাধান তৈরি করতে পারি। এলএলএম হলো একধরনের জেনারেটিভ এআই (GenAI), যা মানুষের মতো আউটপুট তৈরি করার জন্য প্রচুর ইন্টারনেট ডেটার ওপর প্রশিক্ষিত। এটি যেমন দ্রুত বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা তৈরি করে অপপ্রচারের বিস্তার ঘটাতে পারে, তেমনি এর উন্নত সক্ষমতা ব্যবহার করে অপপ্রচার শনাক্ত, প্রতিরোধ এবং বন্ধও করা সম্ভব।
আমি আমার আগের নিবন্ধে ‘ডিজইনফরমেশন’ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল তথ্য নিয়ে লিখেছি। এটি নতুন কিছু নয়, তবে সোশ্যাল মিডিয়া এর বিস্তারের গতি ও পরিধি আমূল বদলে দিয়েছে। ফেসবুক এবং এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো নাগরিকদের তথ্য গ্রহণের পদ্ধতি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এগুলো এমন একটি নিয়ন্ত্রণহীন স্থান তৈরি করেছে যেখানে অপপ্রচার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতার মতো এখানে কোনো ‘গেটকিপার’ বা সম্পাদকীয় নজরদারি নেই। এর ফলে ‘রেট্রোঅ্যাক্টিভ গেটকিপিং’ বা প্রকাশ-পরবর্তী যাচাইকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক প্রমাণগুলো বলছে যে, ফ্যাক্ট চেকিং সত্যিই কার্যকর। প্রাথমিক গবেষণায় কিছুটা সন্দেহ ছিল এবং মনে করা হতো যে, ভুল শুধরে দিলেও মানুষের বিশ্বাস বদলায় না, বা কখনো কখনো ‘ব্যাকফায়ার ইফেক্ট’ (সংশোধন উলটো ভুল বিশ্বাসকে শক্তিশালী করা) ঘটে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে, ফ্যাক্ট চেকিং মানুষের বিশ্বাসের নির্ভুলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে। মেটা (Meta) ইউকে পার্লামেন্টে সাউথপোর্ট দাঙ্গার সময় অপপ্রচার রোধে ফ্যাক্ট চেকারদের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
আজকের ডিজিটাল সমাজব্যবস্থায় ফ্যাক্ট চেকাররা প্রায়ই ভুয়া বিষয়বস্তু শনাক্ত করতে দেরি করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই যেমন নজিরবিহীন মাত্রায় অপপ্রচার তৈরি করতে পারে, তেমনই এটি প্রতিরোধের সরঞ্জামও সরবরাহ করে। এলএলএম ফ্যাক্ট চেকারদের কাজের বিভিন্ন ধাপে সহায়তা করতে পারে, যেমন-চেক করার মতো দাবি শনাক্ত করা, আগে চেক করা দাবি খুঁজে বের করা, ব্যাখ্যা তৈরি করা এবং বহুভাষিক সহায়তা দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, ‘FactBot' স্নোপস (Snopes)-এর ৩০ বছরের আর্কাইভ রিয়েল-টাইমে অনুসন্ধান করে ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এটি স্বচ্ছতা এবং উৎস যাচাইকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। এটি দেখায় যে, এআই মানুষের দক্ষতার বিকল্প নয়, বরং সহায়ক।
যা হোক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে আমি বলতে চাই, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিএনপির জন্য ফ্যাক্ট চেকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি বাংলাদেশে বসবাসরত সব গোষ্ঠী, ধর্ম ও উপজাতিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করে। এটি একটি আধুনিক রাজনৈতিক দল, যা জাতির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি, স্থায়িত্ব এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি মেটাতে একটি বৈশ্বিক ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম। এ জরুরি বিষয়টির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপির উচিত যত দ্রুত সম্ভব আরও সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমি মনে করি, ফ্যাক্ট চেকিং একটি দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষেত্র, যা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ক্রমাগত অভিযোজিত হচ্ছে। জেনারেটিভ এআই’র উত্থান নতুন হুমকি সৃষ্টি করলেও এটি ফ্যাক্ট চেকারদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর হাতিয়ারও তুলে দিচ্ছে। আমার মতে, এ জেনারেটিভ এআইর প্রকৃত ব্যবহার হলো ফ্যাক্ট চেকারদের কাজে সহায়তা করা, গতি বাড়ানো এবং তাদের কাজের মান ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করা।
ড. শাহ জে মিয়া : প্রফেসর অব বিজনেস এনালিটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড এআই, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া; বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বহির্বিশ্বে শহীদ জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী পেশাজীবী এক্সপার্টিজ গ্রুপের সদস্য
