সংস্কৃতি চর্চাকে উপেক্ষা নয়
অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের এক প্রান্তে সম্প্রতি কিছু সৃষ্টিশীল উদ্যোগ অনেকেরই নজর কেড়েছে। বাগেরহাটে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় এক শিক্ষার্থী প্ল্যাটফরম। ভার্চুয়াল এ মঞ্চের কর্মপরিসরও নানা ব্যঞ্জনায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সহশিক্ষা কার্যক্রমের এ প্রাণছোঁয়া প্রদর্শনী বিবর্ণ তারুণ্যের নিস্তরঙ্গ স্রোতে প্রাণের যে স্পন্দন ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে হয়তো কোনো সংশয় নেই। বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা, কুইজ, কবিতা আবৃত্তি, গান, লোকনৃত্য- সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অবলীলায় বিচরণ করেছে।
হঠাৎ হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। শুধু শত শত শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নয়, তাদের বাহারি নিবেদন সবার মনোযোগ আদায় করে নিয়েছে। ভাবনার নতুন দিগন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় যুক্ত থেকেছেন প্রজাতন্ত্রের সচিব থেকে শুরু করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত। আর শিশু-কিশোরদের মানসপটে উঁকি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ। বাঙালির এ নিশ্চিন্ত আশ্রয়গুলো তারুণ্যের ছোঁয়ায় আরও প্রাণবন্ত, আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিয়েছিল।
আর যখন এমন আয়োজনের অংশীদার হন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. মশিউর রহমান, ড. আতিউর রহমান বা কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব; বলতে দ্বিধা নেই, মফস্বলের এ অনুষ্ঠানগুলো তখন গুণে, মানে, কৌলীন্যে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে যায়, ঘুচে যায় মনের মালিন্য; শুদ্ধ সংস্কৃতির মুগ্ধ আবেশে ভরে ওঠে মন-প্রাণ।
এই তো সেদিন স্কুলে নববর্ষ ছিল জীবনেরই উদ্যাপন। রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী পালিত হয়েছে মহাসমারোহে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছিল উৎসবময়। ছেলেমেয়েদের নানারকম পারফর্ম করতে হতো। কল্পনার স্রোতে পাখা মেলত হাজার প্রজাপতি। একজন সহপাঠীর স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার ইচ্ছা যে নির্মল হাস্যরসের খোরাক হয়েছিল, তা আজও ভুলতে পারি না। আমাদের হেড স্যার আমার এক বন্ধুকে বলেছিলেন- তোমার গানটি যথেষ্ট উপভোগ্য হবে; তবে আইটেমটা একটু বদল করতে হবে। কৌতুকের ইভেন্টে তোমাকে জায়গা দিয়ে দেব।
এসব নির্দোষ রসবোধ বিষণ্ন মুহূর্তে আজও শক্তি জুগিয়ে চলে, যন্ত্র সভ্যতায় ক্ষত-বিক্ষত নাগরিক মন ক্ষণিকের জন্য হলেও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, পাড়ায় পাড়ায় দেখেছি থিয়েটার মঞ্চস্থ হতে; চলত নাটক, গান, কবিতা- সংস্কৃতির কত ব্যঞ্জনা। গ্রামে দেখেছি যাত্রাপালা, রামায়ণ, কবিগান, জারি, সারি- লোকজ ঐতিহ্যের বিচিত্র পসরা। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ- গ্রামে চাঁদা তুলে যাত্রাগানের আয়োজন হতো। মাসের পর মাস ধরে চলত রিহারসাল। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু যেন উধাও হতে বসেছে।
কারা যেন ফিসফিস করে বলছে, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এ ভূষণগুলো নাকি বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রগল্ভতা। বৈশাখী মেলার আসর বসাতে মানা। লোকায়ত সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী সব প্রদর্শনীই আজ প্রায় ব্রাত্য। স্কুল-কলেজে রবীন্দ্র-নজরুল স্মরণে রাষ্ট্রের তাগিদ স্পষ্ট। কিন্তু তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ কম। হয়তো চাহিদাটাকেই বদলে ফেলা হচ্ছে। নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগতভাবে আমাদের যে বৈশিষ্ট্য, ভূ-প্রকৃতি বা ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের যে মানসিক গড়ন, সেখানেও রূপান্তর ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে- বোঝা যায়। আর সবকিছুই হচ্ছে কখনও জাতীয়তা, কখনও আদর্শ বা কখনও ধর্মের মোড়কে।
গাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপের মানুষ সবসময়ই ধর্মপরায়ণ। জনপদের হাজার বছরের ঐতিহ্য সে সত্যেরই প্রমাণ দেয়। যুগসিদ্ধ মানবিকতাবোধ, বহুত্ব ও সহিষ্ণুতার ধারণার মাঝেই বাঙালির শক্তিময়তা নিহিত। সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে সময়ের সঙ্গে। হয়তো মূল্যবোধেরও বিবর্তন ঘটে কালের স্রোতে। এও ঠিক- মূল্যবোধের অবক্ষয় সাংস্কৃতিক চেতনাকে দুর্বল করে, অসুস্থ করে তোলে সমাজমনকে।
কিন্তু আজ যে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ আমাদের মনোজগৎ দখল করতে মরিয়া, সেখানে ধর্মের শুদ্ধ অনুশীলনের জায়গা ভীষণ সংকীর্ণ; বরং লোভ, হিংসা ও অনৈতিকতার দাপটে তা বিপন্ন। ফেলে আসা অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে মিলিয়ে নিলেই পরিস্থিতিটা একটু আন্দাজ করা যাবে।
জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কিংবা শিশুখাদ্যে ভেজাল, রোগ শনাক্তে টেস্ট জালিয়াতি, নারীর প্রতি সহিংসতা, দুর্নীতির সর্বনাশা বিস্তার- মনে হচ্ছে প্রতিদিনই যেন আমরা অতীতকে ছাপিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। উপাসনালয় বা পবিত্র স্থানের নামে জমি দখল- ক্রমবর্ধমান লালসাকে তৃপ্ত করতে কোনো ছলই যেন আর অবশিষ্ট থাকছে না। অর্থাৎ যে কোনো সুবিধাজনক পরিচয়ের আড়ালে ক্ষমতা ও সম্পদ দখলের নিকৃষ্ট কৌশলই এখন দুর্বৃত্তায়িত সমাজের প্রধান অবলম্বন।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন একটা সামাজিক আবহে আমরা নিয়ত জারিত হচ্ছি, যেখানে কালোত্তীর্ণ নীতিবোধ বা ন্যায্যতা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। সভ্য ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিকশিত হওয়ার পথে নৈতিকতার এ সংকট নিশ্চয়ই একটা বাধা। ভাবতে অবাক লাগে- যে দেশের মাটি লাখো শহীদের রক্তে ভেজা, অজস্র ত্যাগের গরিমায় মহিমান্বিত- দেশপ্রেম সে পবিত্র মাটিতে এখন দুর্লভ মানবিক প্রপঞ্চ। পরিস্থিতি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, জীবনের সবকিছুই সেখানে মুনাফার মানদণ্ডে নির্ধারিত। মানসম্পন্ন শিক্ষা বলতে আমরা মনেপ্রাণে যে সহজলভ্য পথের সন্ধান করি, সেখানে সম্পদ আহরণই মুখ্য। সে কারণে মানবিক উৎকর্ষ সাধনের জরুরি বিষয় ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল সার্জন বা ব্যবসায়ী- কে কত তাড়াতাড়ি অর্থ বা প্রতিপত্তি লাভ করতে পারঙ্গম- পেশাগত সে সুযোগ ও দক্ষতাই এখন শিক্ষার বাজারমূল্যের মাপকাঠি। টাকা আয়ের জন্য যেমন কষ্ট করার দরকার নেই, তেমনি ডিগ্রি অর্জনের জন্যও সাধনার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। যে কোনো উপায়ে সম্পদ অর্জনই লক্ষ্য। উপলক্ষ যাই হোক, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ সেখানে গৌণ। সে-ই সফল; যার টাকা আছে, ঐশ্বর্য আছে, ক্ষমতা আছে। জীবনের ধারণাটাই আজ বদলে গেছে।
পার্থিব এ জীবনের সব ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্বের বাসনা। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি- সর্বত্রই। অলীক এ লক্ষ্য অর্জনই সংকল্প। অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মত্ত এ সমাজ। লোভের এ জাঁতাকলে পিষ্ট আকাঙ্ক্ষার সিঁড়ি। লক্ষ্য পরিষ্কার- রাতারাতি সাফল্যের চূড়া। সন্তানকে প্রথম হতেই হবে। লড়াইয়ের সব ময়দানে বিজয় স্তম্ভ থাকবে তারই দখলে। খেলাধুলায় কিংবা পড়াশোনায়- সবখানে। এ বিজয় সন্তানের জন্য নয়, সমাজের জন্যও নয়, স্রেফ পিতা-মাতার সামাজিক মর্যাদার জন্য। মিথ্যা সম্মানের মোহে অসুস্থ, আচ্ছন্ন এ সমাজ। অথচ এভাবে অবলীলায় ধ্বংস হচ্ছে নিষ্পাপ শৈশব, নষ্ট হচ্ছে প্রমত্ত কৈশোর; মুছে যাচ্ছে দুর্দান্ত তারুণ্য। থাকছে শুধু লড়াই। অন্তহীন প্রতিযোগিতা। বিপন্ন ভবিষ্যৎ। বিভীষিকার মুখে শুধু শিশু নয়, গোটা সমাজ।
যৌথ পরিবারের সংস্কৃতিও এ পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামোতে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পারিবারিক শিক্ষার সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত পরিসরও আজ সংকুচিত। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা শিশুর মানসিক বিকাশের পথে দেয়াল তুলছে। একাকিত্ব শিশুর মনোজগতে এক ধরনের অসহায়ত্বের বোধ তৈরি করে। মনস্তাত্ত্বিক এ শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় নানা অসুখ। নিরানন্দময় এ নিঃসঙ্গতায় বেড়ে ওঠে আত্মমগ্নতা, এমনকি হিংসার বীজও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাড়া, মহল্লা- কোথাও আজ খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই।
অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট আসক্তিই এদের অনিবার্য পরিণতি। এমন বৈরী, সমাজবিমুখ পরিবেশে শিশুর মানসিক উত্তরণ স্বাভাবিক হয় না। সনাতন মূল্যবোধগুলো ভেঙে পড়ে। আত্মকেন্দ্রিকতা এতটাই তীব্র ও আত্মঘাতী হয়ে ওঠে যে, বড় হয়ে সন্তান বাবা-মাকেই বোঝা মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমেই ঠাঁই হয় মা-বাবার। আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষা তাদের কাছেই ফিরে আসে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে।
দেখা যায়, সে শিশু বা কিশোর সমাজের দায়কেও অগ্রাহ্য করে। মাদকাসক্তি, পারিবারিক সহিংসতা, এমনকি নানা অপরাধমূলক অপতৎপরতার সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সংশ্লিষ্টতা এমনই মনোজাগতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে।
ছেলেবেলার কথা বেশ মনে আছে। শিক্ষক, অভিভাবক, এমনকি পরিচিত রাজনীতিককে দেখলেও আমরা ভক্তি, শ্রদ্ধা বা এক ধরনের সংকোচে চুপ্সে গেছি। নিজেদের সংযত করেছি। বসে থাকলে উঠে দাঁড়িয়েছি। এমনকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আমরা বাইরে কেন তার জবাব দিয়েছি। তারাও কুশল জেনেছেন, কখনও শাসনও করেছেন। এ অনানুষ্ঠানিক তদারকি প্রক্রিয়া সে সময় সমাজের ওপর যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। একবার চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তার সহানুভূতি ও শিষ্টাচারে শুধু সান্ত্বনা পেয়েছি তা নয়, আপ্লুতও হয়েছিলাম। কিন্তু এক সপ্তাহ পর আমার বন্ধুরা আমাকে খেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমার। তৎকালীন সেই দাপুটে নেতার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। সবার সামনেই তিনি আমাকে তিরস্কার করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
তাৎক্ষণিকভাবে অপমানবোধ করলেও তাদের সে সময়ের দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতা এখনও আমাকে অতীতচারী করে তোলে। আর করোনাকালের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সে অভিজ্ঞতাকে কিছুতেই মেলাতে পারি না। স্বাস্থ্যবিধি এখন নেতা মানেন না, কর্মী মানেন না, এমনকি সরকারি কর্মচারীও না। সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখন আইন অমান্য করাই ফ্যাশন, স্টাইল। যিনি মেনে চলেন, তিনি ভীরু, আনস্মার্ট। কেউ কেউ বলে ফেলেন- হতভাগার জীবনের ওপর বেশি মায়া। মাস্ক পরা যেন জবরদস্তির কাছে করুণ সমর্পণ, যেমন একসময় হেলমেট পরাতেও একই দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। আশ্চর্য শোনালেও সত্যি- পরীক্ষায় প্রতারণা করে পাস করাতেও ‘গ্ল্যামার’ ছিল একসময়।
আরও একটা পরিবর্তন মনকে ভীষণ পীড়িত করে। মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, মানবিকবোধ বা সমাজবদ্ধতার দায় যেন সমাজ থেকেই আজ নির্বাসিত। একদিকে লোভ-হিংসার যেমন বাড়-বাড়ন্ত, অন্যদিকে পাশবিক বর্বরতাও যেন সভ্যতার সব প্রকরণ চূর্ণ করে চলেছে আপন খেয়ালে। আর এসব অপরাধের মুখে মানুষের ব্যাখ্যাতীত নীরবতা, সীমাহীন ঔদাস্য মানব চরিত্রের আরও একটি রহস্যময় অংশকে অনাবৃত করছে। সমাজতাত্ত্বিকরা হয়তো বলবেন- নিষ্ক্রিয় সহিষ্ণুতা। চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও আমরা নিরাসক্ত, নির্বিকার।
বেগমগঞ্জের দুই শতাধিক গ্রামবাসী গৃহবধূর নির্যাতন দেখেছে, বুয়েটে রাতে আবরার, প্রকাশ্য দিবালোকে দীপ হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে শত শত ছাত্র-জনতা, মাদ্রাসায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে নুসরাতকে, লালমনিরহাটে জুয়েল, মুরাদনগরে নিরীহ সংখ্যালঘুর বাড়িঘর জালিয়ে দেয়া হয়েছে বর্বরের উল্লাসে। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী এই বিবর্ণ সময়। মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অসহায় বানিয়েই এমন পাশবিকতার নজির তৈরি করা হয়েছে। যে নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিপর্যস্ত করে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড জয় করে নিয়েছে, সে জাতির চরিত্রে কীভাবে এমন নতজানু পরাজয়ের বার্তা লুকিয়ে থাকে নিরাপদে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।
অনস্বীকার্য যে, সমৃদ্ধির চিহ্ন আজ চারপাশে। এমনকি করোনাকালেও দেশের অর্থনীতি রুখে দাঁড়িয়েছে। সহনশীলতার প্রমাণ দিয়েছে। দেশে-বিদেশে এ সক্ষমতা তারিফ কুড়িয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া কিছু নজিরবিহীন অপরাধের চিত্র সবাইকে হতবাক করেছে। সময়টাকে অস্থির বলেই মনে হচ্ছে। ঘটনা পরম্পরা ও প্রবণতার মধ্যে সংঘটিত ও পরিকল্পিত অপরাধের চরিত্র ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যেমন কঠিন, তেমনি রাষ্ট্রও এর দায় উপেক্ষা করতে পারে না। ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে যে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল, সেখানে সুশাসনের অনুপস্থিতি কিংবা মৌলবাদের বিস্তার- কোনোটাই কাম্য হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের লালিত দর্শনের সঙ্গে আপসেরও কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সংস্কৃতির রুগ্ণ ও অসুস্থ পরিসরকে আবার জীবন্ত করে তুলতে হবে
। করোনাকালের বিষণ্নতাকে ছাপিয়ে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সংস্কৃতি চর্চার যে ক্যানভাস উন্মুক্ত করেছে, ভাষা-বিতর্ক-বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে যুক্তিশীলতা ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার যে উদ্ভাবনী কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে, তা গোটা দেশের কাছেই একটা স্বস্তিকর বার্তা পৌঁছে দেবে- এমন প্রত্যাশা রাখতেই পারি।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ
principalffmmc@gmail.com
