বৃক্ষ পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন
ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২২-এর উদ্বোধন করেছেন। তিনি দেশবাসীর প্রতি জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২২ সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতির পিতার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার দেশে বিদ্যমান বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করেছে। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশ করার পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বৃক্ষ আমাদের অনেক কিছু দিয়ে জীবন রক্ষা করে। পৃথিবীর পরিবেশকে শীতল রাখে। গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্র, ওষুধসহ আরও অনেক কিছুই আমরা সৃষ্টিকর্তার মহান দান বৃক্ষ থেকে পাই। কোনো দেশের ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার হলেও আমাদের দেশে তা নেই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাছ কেটে সবুজ বনভূমি উজাড় করছি। পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে অবশ্যই বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। পৃথিবীর সবুজায়ন নিশ্চিত করতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। বৃক্ষরোপণকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। বৃক্ষের কাছে আমরা সর্বদাই নির্ভরশীল। বৃক্ষবিহীন পৃথিবীকে এক মুহূর্তও মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের পৃথিবী হিসাবে কল্পনা করা যায় না। বৃক্ষবিহীন পৃথিবী হলো উত্তপ্ত মরুময় প্রাণহীন এক স্থান। আমরা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে যে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকি, এর জোগানদাতা হলো বৃক্ষ। একেকটি গাছ হলো অক্সিজেনের ভান্ডার, একটি অক্সিজেন ট্যাংক।
বৃক্ষ কত সুন্দর ফুল দেয়। ফুলের সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে, নয়ন জুড়ায় এবং ফুলের সুবাস আমাদের মোহিত করে। সুস্বাদু ফল আমাদের পরম তৃপ্তি দেয়। বৃক্ষে পাখি বসে গান গায়। পাখির গান আমাদের প্রাণে দোল দিয়ে যায়। যে ঘরে অন্তত একটি সবুজ বৃক্ষ রয়েছে, সে ঘর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। আমাদের প্রতিবছর পরিকল্পনা করে বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করতে হবে। একটি বৃক্ষ রোপণ করলে পরবর্তী সময়ে তার যত্ন নিতে হবে, যাতে একটি চারা থেকে পরবর্তী সময়ে আমরা ফুল, ফল ও কাঠের জোগান পাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, বৃক্ষ পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন, বৃক্ষরোপণে বাঁচবে সবার জীবন। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষা করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণ বিরাট অবদান রাখতে পারে। বৃক্ষরোপণের অর্থনৈতিক মূল্যও অনেক। ফুলের চারা রোপণের মাধ্যমে যেমন সৌন্দর্যপিপাসুদের চাহিদা মেটানো যায়; আবার বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ অনেককে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। ফলদবৃক্ষ যেমন অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আবার ফল থেকে আমাদের খাদ্য চাহিদা ও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদাও অনেকটা পূরণ করতে পারি।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের জরিপে জানা যায়, দেশের বৃক্ষসম্পদ Gross National Income (GNI)-এ ১.২৯ শতাংশ অবদান রাখছে। সংগৃহীত বৃক্ষসম্পদের অর্থনৈতিক মূল্য ২০১৭-১৮ সালের Gross Domestic product (GDP) এর ৩.১১ শতাংশ। বৃক্ষ ও বনজসম্পদ সামগ্রী সংগ্রহকারীদের প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী-এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৃক্ষ থেকে আমরা ভেষজ ওষুধ পেতে পারি, যা জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বৃক্ষের সবকিছুই আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বৃক্ষের সঙ্গে মানুষসহ সব প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে সম্পর্ক চির বন্ধনে আবদ্ধ। শুধু তাই নয়, বৃক্ষ মানবজীবনের জন্য এক মহৎ উদাহরণ। বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন, ফুল, ফল দিয়ে এবং নিজের কাঠ দিয়ে একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। সমগ্র জীবন বৃক্ষ শুধু দিয়েই যায়; কিন্তু বিনিময়ে নিজে কিছু নেয় না। মানবজীবনের জন্য এর চেয়ে আর মহৎ উদাহরণ কী হতে পারে। তাই বলা যায়, বৃক্ষ মানবজীবন ও পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমাদের সর্বত্রই সবুজে ভরে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাসাবাড়ি, ছাদ, বাড়ির আশপাশ, রাস্তার দুই পাশ-যেখানেই আমরা খালি জায়গা পাই না কেন, সেখানে আমরা বৃক্ষরোপণ করব। যেখানে মাটি খুঁড়ে বৃক্ষরোপণ করা সম্ভব নয়, সেখানে টবে যে ধরনের বৃক্ষরোপণ করা সম্ভব, তাই করব। প্রয়োজনে বৃক্ষরোপণের অভিযানে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণকে কাজে লাগিয়ে সর্বত্রই সবুজে ভরে দেব। শহরে নিজগৃহের আশপাশে, বাড়ির ছাদে এবং বেলকনিতে টবে গাছ লাগাতে পারি। লাগাতে পারি গন্ধরাজ, বেলি, জিনিয়া, শিউলি, নয়নতারা, ঘৃতকুমারী, রজনিগন্ধা, স্নেক প্ল্যান্ট, মানি প্ল্যান্ট, গোলাপসহ নানা জাতের ফুল। ফলদবৃক্ষের মধ্যে গ্রামের বাগানে বেশি করে আম, কাঁঠাল, পেয়ারাগাছ লাগাতে পারি। বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বছর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ‘বৃক্ষপ্রাণে প্রকৃতি-প্রতিবেশ, আগামী প্রজন্মের টেকসই বাংলাদেশ’ যে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত।
লাখো বছর আগে পৃথিবীর প্রায় ষাট শতাংশই অরণ্যাবৃত ছিল। জলবায়ুর পরিবর্তন, হিমশৈলের চলন এবং মানুষের কার্যকলাপের জন্য বিপুল অরণ্য ভূমি নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে মানুষের নির্দয়ভাবে গাছ কাটার জন্য বনাঞ্চল ধ্বংসের পথে। বর্তমানে পৃথিবীর বনভূমি পুড়ছে, যা পৃথিবী ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয়। তারপরও আমরা বৃক্ষরোপণের পরিবর্তে নির্বিচারে বৃক্ষ কেটে ধ্বংস করছি। এ কারণে পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। এ সংকট থেকে রক্ষা পেতে হলে অধিক হারে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র বৃক্ষরোপণ করতে হবে। গাছ আমাদের ছায়া দেয়, নানা ধরনের ফল দেয়, রান্নার জন্য আমাদের জ্বালানি হিসাবে কাঠ দেয়, আসবাবপত্র, দরজা, জানালা, নৌকা, বৈদ্যুতিক খাম এবং রেলওয়ে পাটাতনের জন্য আমাদের কাঠ দিয়ে থাকে। বৃক্ষ আমাদের রাবারেরও জোগান দেয়। গাছপালা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন উৎপন্ন করে। পর্যাপ্ত গাছপালা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ঘটায় এবং খরা রোধ করে। রাস্তার পাশের গাছপালা ভূমি ক্ষয় আর উপকূলবর্তী গাছপালা জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করে। তালগাছ আমাদের বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। তাই বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়ন বর্তমান পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সমগ্র বনভূমির আয়তন হচ্ছে ৪.০৬ বিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে কেবল রাশিয়াতেই বনভূমির আয়তন হচ্ছে ৮১৫ মিলিয়ন হেক্টর, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল; মোট বনভূমির আয়তন ৪৯৭ মিলিয়ন হেক্টর; এর পরপরই আছে কানাডায় ৩৪৭, যুক্তরাষ্ট্রে ৩১০, চীনে ২২০, অস্ট্রেলিয়ায় ১৩৪ , কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ১২৬, ইন্দোনেশিয়ার ৯২, পেরুতে ৭২ এবং ভারতে ৭২ মিলিয়ন হেক্টর। ওই দেশের নামগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে একটি জিনিস খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে-পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে বনভূমি নেই। একটি দেশে মোট ভূমির ২৫ শতাংশ থাকার প্রয়োজন হলেও বেশির ভাগ দেশেই তা নেই। তাই যেসব দেশে বনভূমির পরিমাণ কম রয়েছে, সেসব দেশে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য মানুষকে বেশি করে গাছ লাগতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণ, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে কার্বন ডাইঅক্সাইড আটকে পড়া থেকে রক্ষা পাওয়া, নগর সভ্যতায় বৃক্ষের শীতল স্নিগ্ধতা ফিরিয়ে আনায় বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। বৃক্ষ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সুস্থ, সুন্দর, সুবিন্যস্ত পরিবেশের ক্ষেত্রে রয়েছে এর বিরাট সহায়ক ভূমিকা। জনজীবনে গাছের ভূমিকা আশীর্বাদস্বরূপ। বিপন্ন পরিবেশকে বাঁচাতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য বৃক্ষ অনিবার্য। বৃক্ষ মানবজীবনের এমন এক বন্ধু, যার কোনো বিকল্প নেই। আসুন, আমরা প্রত্যেকে বেশি বেশি করে গাছ লাগাই ও গাছের যত্ন নেই।
ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ; কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
