Logo
Logo
×

বাতায়ন

উন্নয়নের বড় বাধা দুর্নীতি

Icon

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উন্নয়নের বড় বাধা দুর্নীতি

দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি, যা একটি অপরাধ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির কারণে এর সুফল জনগণ সঠিকভাবে পাচ্ছে না। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদে বলা হয়েছে, দুর্নীতি সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকির সৃষ্টি করে। প্রশাসনিক সংস্কার, সুশীল সমাজ গঠন এবং ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বর্তমানে দুর্নীতি শুধু সরকারি অফিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। মানুষ কেবল অভাবের তাড়নায় দুর্নীতি করে, এটি সত্য নয়। অনেক বিত্তশালী কর্মকর্তাও আরও বেশি অর্থসম্পদ অর্জনের জন্য দুর্নীতি করে। রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রতিটি পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষ কম-বেশি দুর্নীতি করে। যত দিন যাচ্ছে, দুর্নীতির ব্যাপকতা ততই বাড়ছে। যতদূর জানা যায়, সরকারি যেসব অফিসে সরাসরি জনসাধারণের যাতায়াত রয়েছে, সেসব অফিসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। যেমন-ভূমি রেজিস্ট্রেশন, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি, হিসাবরক্ষণ, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস-শুল্ক, থানা-পুলিশ এবং রাজউক ও মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স ইত্যাদি অফিসে সেবাদাতা ও গ্রহিতা উভয়েই দুর্নীতি করছে। এমনকি ব্যবসার ক্ষেত্রে ওজনে কম দেওয়ার প্রবণতা, খাদ্য ও ব্যবহৃত দ্রব্যাদিতে ভেজাল দেওয়া এবং কর ও ভ্যাট ফাঁকি তো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিকভাবে পাঠদান না করানো, হাসপাতালে অতিরিক্ত ফি আদায় বা অপ্রয়োজনীয় ও ভুল চিকিৎসা, ব্যাংকের টাকা আÍসাৎ, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকঋণ গ্রহণ ও মানি লন্ডারিং করে বিদেশে অর্থ পাচার ইত্যাদি অন্যায়-অপরাধের কথা অহরহ শোনা যায়। আমাদের দেশে দুর্নীতির বিস্তার অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। এটি একজনের মধ্য থেকে অন্যজনের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে দুর্নীতির প্রকোপ আগে থেকেই তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ সাল থেকেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন বক্তৃতায় দেশের দুর্নীতি, অতিমুনাফাখোরি ও টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-কালোবাজারি ইত্যাদি বিষয়ে তার কষ্ট ও হতাশার চিত্র ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সামরিক শাসনামলে দুর্নীতি আরও বেশি ডালপালা বিস্তার করে।

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য ১৯৫৩ সালে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে কমিশনের জন্য প্রণীত আইনে দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের অধিক্ষেত্র বিস্মৃত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জনবল ও অফিসের বিস্তার ঘটেনি। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে সারা দেশে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সারা দেশের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণও দুদকের কাছে নেই। এটা দুদকের একটি দুর্বলতার দিক বলা যায়।

দুর্নীতির কারণে মানুষের নীতি-নৈতিকতাবোধ নষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি দেশের সামাজিক পরিবেশ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নষ্ট করে। দেশে বৈষম্য বাড়ায়। সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে আমজনতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো উপাচার্য নিয়োগ-বাণিজ্য ও পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ বা পদোন্নতি না দিয়ে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দিচ্ছেন। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। উন্নয়নের পর্যায়ে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এসব তদারকি করার যেন কেউ নেই। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিষয়টি যেমন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতির বিষয়টিও কারও অজানা নয়। এমন বেপরোয়া দুর্নীতি মোটেও কাম্য নয়।

আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে শুদ্ধতা, নৈতিকতা, সত্যবাদিতা ও সততা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা করেন। এ নীতি কার্যকর হলে দেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আর রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিয়োজিত রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবার সদিচ্ছা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা কঠিন নয়। ইতোমধ্যে আইডিবি, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও নীতি-নির্ধারকরা দুর্নীতি হ্রাস করার বিষয়ে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) বিভিন্ন সময়ে সভা, সেমিনার ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।

দুর্নীতি নির্মূলে, বিশেষ করে দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে, লোভী ও অসৎ ব্যক্তিদের বয়কট করতে হবে। দেশে সর্বস্তরে লাগামহীন দুর্নীতি যেমন রয়েছে, তেমনি এর বিপরীতে সৎ, দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিও সমাজে রয়েছে। চাঁদাবাজি, ঘুস, অতিমুনাফাখোরি, নিয়োগ-বাণিজ্য ও অবৈধভাবে পদোন্নতি দেওয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অফিসে সেবামূলক কাজ ঘুসের বিনিময়ে হলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি হিসাবে জেল-জরিমানাসহ তাদের নিুপদে পদায়ন করা যেতে পারে। আগামীতে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর করে তুলতে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করে সৎ ও যোগ্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের যথাস্থানে পদায়ন করতে হবে। যে কোনো মূল্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধ করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের যথাস্থানে বসিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং জনগণকেও এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটনই হোক আগামী দিনের মূল লক্ষ্য।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

 

দুর্নীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম