Logo
Logo
×

বাতায়ন

অসুরবিনাশিনী মা দুর্গা :- ড.অরূপ রতন চৌ ধু রী

Icon

বাতায়ন

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অসুরবিনাশিনী মা দুর্গা :- ড.অরূপ রতন  চৌ ধু রী

দুর্গা নামের ব্যাখ্যা হলো-‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘœনাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্র“নাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন , রোগ, পাপ ও ভয়-শত্র“র হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। যে দেবী অগম্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না, তিনিই মা দুর্গা। চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবতাদের হৃ তরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনি মা দুর্গা।

দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সব দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিণী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবীমূর্তি। এ দেবীই হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যশক্তি মহামায়া অসুর কুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন।

সরকারি বা জাতীয়ভাবে এ উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিসাবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎকালের বার্ষিক মহাউৎসব হিসাবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এ উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ তাই বসন্তকালের এ উৎসবকে বাসন্তীপূজা বা অকালবোধনও বলা হয়।

মা দুর্গার দশ হাত রয়েছে বলেই তাকে দশভুজা বলা হয়। তিনটি চোখ এজন্য তাকে ত্রিনয়নী বলা হয়। মা দুর্গা দেবীর ডানদিকের পাঁচ হাতে রয়েছে যথাক্রমে-ত্রিশুল, খক্ষ, চক্র, বান ও শক্তি নামক অস্ত্র। বাঁদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলো যথাক্রমে শঙ্খ, ঢাল, ঘণ্টা, অঙ্কুশ ও পাখা। এ সবকিছুই দ–র্গা দেবীর অসীম শক্তি ও গুণের প্রতীক। দশদিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধŸ অধ-এ দশদিক থেকে মা দুর্গার দশটি হাত, যাকে বলা হয় দশপ্রহরণী। দেবী দুর্গা এ দশপ্রহর দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। অন্যদিকে মানবজাতির অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য দেবীকে দশ প্রহরণধারিণী বলা হয়ে থাকে।

রামায়ণে রামচন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে মা দুর্গাদেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন, অন্যদিকে মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধারম্ভের আগে জয় নিশ্চিত করার জন্য দুর্গাপূজার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মহামায়া দুর্গারূপে দুর্ধর্ষ অসুররাজ/মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তার ফলে অসুরদের অত্যাচার থেকে দেবগণ মুক্ত হয়েছিলেন, ফিরে পেয়েছিলেন তার স্বর্গরাজ্য।

শ্রীরামচন্দ্র রাবন বধ করার জন্য দেবীর আরাধনায় বসেছিলেন। তখন ছিল শরৎকাল। দেবতাদের নিদ্রার সময় নিদ্রাভঙ্গ করতে রামচন্দ্র অকাল বোধন করলেন। আর সেজন্যই এ পূজাকে তখন অনেকেই অকালবোধন হিসাবে উলে­খ করেন। এ বোধন হচ্ছে জাগরণ। ষষ্ঠী পূজার সময় সন্ধ্যায় বিল্ব বৃক্ষমূলে দেবীবন্দনার উদ্দেশ্যে যে বিশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় সেটাকেই বলা হয় বোধন। দুর্গাপূজায় বোধন ছাড়া দেবীপূজা পরিপূর্ণ হয় না। চৈত্র মাসের বসন্তকালে অকাল বোধনের আগে বসন্তকালে দেবীর পূজা হতো, এ কারণেই দেবী বাসন্তীরূপে পরিচিত।

অসুরবিনাশিনী মাকে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেওয়া হয়-‘হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো’। তোমার আগমনে এ পৃথিবীকে ধন্য করো। কলুষতামুক্ত করো। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ করো পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে। মা দুর্গা দেবী কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও অষ্টভুজা, আবার কোথাও দশভুজা বা অষ্টাদশভুজারূপে বর্ণিত, পূজিতা ও বন্দিতা। চণ্ডীতে দুর্গার সহস্রভুজা মূর্তির উলে­খও করা আছে। দুর্গা কখনো লগ্না, কখনো বা রাজরাজেশ্বরীরূপে অধিষ্ঠত হন। মহাকালীদেবীর তামসী মূর্তি, মহাস্বরস্বতী দেবীর সাত্বিকী মূর্তি, মহাল²ী দেবীর রাজসী মূর্তি, সবই মা দুর্গা। অন্নপুর্ণা, মনসা, ষষ্ঠী, শীতলা, সুবচনী, গন্ধেশ্বরী-এসব একই মহাপ্রকৃতির। শ্রীরামচন্দ্র যখন পূজা দিতে গিয়ে দেখলেন, আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন, সীতা উদ্ধারও হবে না, তখন নিরুপায় রামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন, কেননা রামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা রামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা ১০ হাতে ১০ অস্ত্রে সুসজ্জিত, তার ১০ হাত ১০ দিক রক্ষার প্রতীক। মূলে তিনি এক পরমবিদ্যা স্বরূপিণী, যিনি সর্বভুতের প্রাণরূপী মহাদিব্য মূর্তি মা ও জগৎ মঙ্গলময়ী দুর্গা।

দুর্গা যেন সব জগতের প্রতীক। তিনি জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মহামায়ার স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে-তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস, তার অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তার শক্তিতেই আমার শক্তিমান। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তারই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাকেই লাভ করার চেষ্টা করি।

হিন্দু শাস্ত্র মতে, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্র“র হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। দুর্গার শাস্ত্রীয় স্বরূপ হলো : তিনি শাশ্বত, মহাকাল ও সনাতনী, তিনিই নিয়তি ও নিয়ন্তা। দুর্গার এই গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু দেবী মাত্র নন, তিনি ঈশ্বর।

মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবিভর্‚তা, এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য, বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (স্বরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (ল²ী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তু লাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। পুরোনো শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ব বৃক্ষে বা বিল্ব শাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে, সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা, কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়, একেই বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়, যার নাম ‘সন্ধিপূজা’।

পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয় ও মনকে একাগ্র করার ও শুদ্ধ করার প্রয়াস পাই। আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হলে মা আমাদের হৃ দয়ে প্রকাশিত হন, আমরা আমাদের আনন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করি। মা স্বরণাগত সন্তানকে দশ হাতে সতত সর্বপ্রতিক‚লতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন এবং পরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।

মা দুর্গা জগৎজুড়ে আছেন। আমরা আজ আমাদের দুর্গা মাকে বরণ করব, তার পূজা করে স্মরণ করব আর কামনা করব মা যেন আমাদের বিপথ থেকে সবসময় রক্ষা করেন। আমরা সবাই যেন সবার সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসতে পারি, সবার দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতে পারি। দুর্গাপূজার আনন্দ যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি। আমাদের মধ্যে হিংসা, হানাহানি সব বিভেদ ভুলে গিয়ে আমরা সবাই যেন একে অপরের বন্ধু হতে পারি। তবেই দেবী দুর্গতিনাশিনী আমাদের মাঝে আসবেন, অসুরকে নাশ করবেন, আমরা সবাই শান্তি ফিরে পাব। মাতৃরূপিণী মহাশক্তির শরণাপন্ন হলে মা সন্তানের জন্য কল্যাণকর সব কিছুই পরিপূর্ণ করেন।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস-মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা

prof.arupratanchoudhury@yahoo.comy

অসুরবিনাশিনী সরকারি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম