Logo
Logo
×

বাতায়ন

ওষুধ দিয়ে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব নয়

Icon

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওষুধ দিয়ে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব নয়

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৯.১ শতাংশ অর্থাৎ ৮৪ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। অপুষ্টিতে আক্রান্ত এসব মানুষের ৮০ শতাংশ শিশু ও মহিলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। এসব দেশে প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সি প্রায় ৮৫ লাখ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। লাখ লাখ শিশু নামমাত্র বেঁচে থাকলেও উপবাসের কারণে কোনো না কোনো সময় এদের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত, অপুষ্টি প্রতিহত করা না গেলে বাড়ন্ত শিশুদের যে কোনো সময় শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপুষ্টির কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বয়োবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা ও প্রক্রিয়া গর্ভাবস্থায় শুরু হতে পারে। মা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগলে গর্ভজাত সন্তানের শারীরিক ও মানসিক গঠনে বিঘ্ন ঘটে। মানুষের মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ গঠন হয় মাতৃগর্ভে এবং জন্মের ২ বছরের মধ্যে। সেজন্য মা অপুষ্টিতে ভুগলে গর্ভজাত এবং দুগ্ধজাত সন্তানের মগজ অপরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জন্মের সময় এক-তৃতীয়াংশ শিশুর গড় ওজন আড়াই কিলোগ্রামের কম থাকে। এ কম ওজন পরবর্তীকালে শিশুর জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। এসব শিশু প্রতিনিয়তই রোগে আক্রান্ত হয় এবং স্বাভাবিক ওজনের শিশুদের তুলনায় এদের মৃত্যুর হার চারগুণ বেশি। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ কারণে এরা ঘনঘন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। রোগে ভোগে বেশিদিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সহজে এসব রোগ জটিল আকার ধারণ করে। অন্যদিকে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শিশুদের পুষ্টি বিশোষণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করে না বলে খাওয়ার পর শিশু বমি করে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা ডায়রিয়ায় ভোগে বেশি, মারাও যায় বেশি।

অপুষ্টি চরম অভিশাপ। এ অভিশাপের মূল শিকার তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। অপুষ্টির মূল কারণ প্রধানত দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণে সুষম খাদ্য গ্রহণে অক্ষম হলে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। সুস্থ-সবল জীবনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চর্বি, আমিষ, শর্করাজাতীয় খাবারসহ পর্যাপ্ত ভিটামিন, খনিজপদার্থ, বিশুদ্ধ পানি ও আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্টি হয় অপুষ্টি, অপুষ্টির কারণে নানা রোগ এবং রোগ হলেই ওষুধ কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো। দারিদ্র্য সামনে রেখে তারা ওষুধের ফাঁদ পাতে। ফর্মুলা মোতাবেক দরিদ্রদের চিকিৎসায় তারা হরেক রকম ওষুধ বাজারে ছাড়ে। অপুষ্টির সঙ্গে ওষুধের সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকার করুক আর নাইবা করুক, বিশ্বজুড়েই ওষুধ কোম্পানিগুলো উল্লিখিত ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে অপুষ্টিকে রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে তার প্রতিকারে শত-সহস্র ওষুধ উদ্ভাবন, উৎপাদন এবং সফলভাবে বাজারজাত করে শত-সহস্র কোটি টাকা উপার্জন করে।

দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে কোনো ওষুধ নেই। ব্যবসা, মুনাফা আর মূল্যবোধ সব সময় একে অপরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে। অপুষ্টির প্রধান উপসর্গ হলো-খাবারে অরুচি, বয়োবৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা, অপরিপূর্ণ মস্তিষ্ক গঠন, ক্লান্তি, দুর্বলতা, অবসন্নতা, বমি ও ডায়রিয়া। অসৎ মুনাফালোভী ওষুধ কোম্পানিগুলো জনগণের অজ্ঞতা আর সরলতার সুযোগ নিয়ে শঠতার মাধ্যমে প্রতিটি উপসর্গকে একেকটি রোগ হিসাবে আখ্যায়িত করে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় শত-সহস্র ওষুধ বাজারে ছাড়ে। ফলে ওষুধের বাজার ভিটামিন, টনিক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্ষুধাবৃদ্ধিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, এনজাইম, হজমিকারক, বয়োবৃদ্ধিকারক স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধে প্লাবিত হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কারণে বা খাদ্যের অভাবে সৃষ্ট অপুষ্টিজনিত সমস্যা কীভাবে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবিত ফর্মুলা দিয়ে সমাধান সম্ভব এ কথাটি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কখনোই গুরুত্বসহ ভেবে দেখেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণত ভিটামিন শরীরের বিভিন্ন মেটাবলিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে অসহায় দরিদ্র মানুষটি দিন-দিনান্তে একবেলা খাবার জোটাতে পারে না, তার শরীরে নামিদামি টনিক ভিটামিন যত পরিমাণেই প্রয়োগ করা হোক না কেন, আর্থিক ক্ষতি ছাড়া কাজের কাজ খুব বেশি কিছু হয় না। আর যারা সুষম খাবার খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন, তারা কখনো ভিটামিন-টনিক গ্রহণ করেন বলে আমার জানা নেই। যারা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় টনিক-ভিটামিন উদ্ভাবন করে বাজারে ছাড়েন এবং যেসব চিকিৎসক এসব ছাইভস্ম ব্যবস্থাপত্রে লেখেন, তারা কি কখনো এসব খেয়ে তাদের অপুষ্টি দূর করেছেন?

মানুষ বেশি হারে এবং বেশি পরিমাণে ওষুধ গ্রহণ করলে বুঝতে হবে তার রোগ বেশি। বাংলাদেশে ওষুধের বাজার বিশাল বলে আমরা গর্ব করি। তার অর্থ এই নয় কি, জাতি হিসাবে আমরা বেশি সুস্থ নই এবং সুস্থতা অর্জনের জন্য আমাদের এত বেশি ওষুধের প্রয়োজন হচ্ছে। যে দেশের মানুষ দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগানোর জন্য প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করছে, সে দেশে এত বিশাল ওষুধের বাজার কি শুধু গর্বের ব্যাপার? চিন্তার কি কোনো কারণ নেই?

শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দা কোনো রোগ নয়। এটি একটি ক্ষণস্থায়ী উপসর্গ। ক্ষুধামন্দা বা ক্ষুধাহীনতার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগের পূর্বে এর কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শিশুদের বেলায় যেসব কারণে ক্ষুধামন্দা বা খাওয়ার অনীহা সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে রয়েছে অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, খাদ্য বিশোষণে বিঘ্ন ঘটা, হৃদরোগ, রেনাল ফেলিউর, প্রদাহ, জেনেটিক ডিসঅর্ডার, ক্যানসার ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে যতই ক্ষুধা উদ্দীপক প্রয়োগ করা হোক না কেন, ফল হবে মূলত শূন্য।

ক্ষুধা উদ্দীপক হিসাবে অ্যানাবলিক স্টেরয়েডের ব্যবহারও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বয়োবৃদ্ধির জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার কোনো সময়ই নিরাপদ ও যুক্তিসংগত নয়। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যানাবলিক স্টেরয়েডের ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ এতে স্বাভাবিক বয়সের আগেই শিশুদের হাড়ের গঠন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতে স্টেরয়েড প্রমোশনের জন্য ব্যবহৃত একটি স্লোগান হলো-A life full of fun and frolic। অনেকেই প্রশ্ন করেন, শরীরের অ্যানাবলি স্টেরয়েড প্রয়োগ কী ধরনের ফান অ্যান্ড ফ্রোলিক? নৈতিকতাবিবর্জিত এ ধরনের স্লোগান অজ্ঞতার সুযোগে কাউকে না কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারলেও সমাজের প্রতিবাদী বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের খুশি করতে পারে না।

ওষুধ কোম্পানিগুলোর অবদানকে আমি কখনো খাটো করে দেখি না। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বাজারে না আনলে আমাদের রোগ-বিমারিতে ভুগতে হতো বা মৃত্যুবরণ করতে হতো। মানবতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে যারা এ চিকিৎসাসেবা ও ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন, তাদের আমরা সশ্রদ্ধ সালাম ও ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু মানবতা, সততা ও নিষ্ঠা বর্জন করে শুধু ব্যবসার খাতিরে যারা মানুষের গলা কাটে, সেসব মুনাফালোভী দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে আমাদের যত অভিযোগ ও প্রতিবাদ। নিচের অপতৎপরতাগুলো সম্পর্কে পড়লে বুঝতে পারবেন, কারা এসব মুনাফালোভী দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী।

ওষুধ কোম্পানিগুলোর খুব চমকপ্রদ ও লাভজনক টার্গেট হলো শিশু ও বৃদ্ধ। শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই চঞ্চলমতি হয়। অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীলতার কারণে এরা কোনো কিছুতেই বেশিক্ষণ পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ কারণে পরীক্ষার ফলাফলও ভালো হয় না। বয়সের কারণে বৃদ্ধদের স্মৃতিশক্তি আংশিক হলেও লোপ পায়, কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় এবং এরা প্রায়ই অবসন্নতায় ভোগে। এগুলোকে রোগ হিসাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। এ নিয়ে ভেবে ঘুম হারাম করার কোনো কারণ নেই। তাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোরই লাভ বেশি। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞান বলুক আর নাই বা বলুক, ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে উল্লিখিত উপসর্গগুলো নিঃসন্দেহে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং এসব উপসর্গকে এরা রোগ হিসাবে আখ্যায়িত করতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। তার কারণও আছে। এসব উপসর্গকে রোগ হিসাবে আখ্যায়িত না করা হলে ওষুধ উদ্ভাবন, উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন কোনো মতেই সম্ভব নয়। ওষুধ ব্যবসায় ম্যানিপুলেশনের সুযোগ কম নয়।

স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। সুস্বাস্থ্যের জন্য অর্থ ব্যয়ে কারও কার্পণ্য নেই। অসুস্থতা মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে। এ দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। ওষুধ কোম্পানিগুলো মানুষকে ধারণা দিয়ে থাকে, There is pill for every ill, যার অর্থ দাঁড়ায়-প্রতিটি রোগেরই ওষুধ রয়েছে। আর তাই তো বিশ্বজুড়ে শত-সহস্র কোটি টাকার ভিটামিন, টনিক, হজমিকারক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, স্টেরয়েড বা অন্যান্য লাইফস্টাইল ওষুধ বিক্রি হয়, যেখানে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের অভাবে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়তই লাখ লাখ লোক মারা যাচ্ছেন বা অসুস্থতায় ভুগছেন। সুস্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিনের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। শরীরের মেটাবলিক কর্মকাণ্ডের জন্য অতি সামান্য পরিমাণ ভিটামিন প্রয়োজন। এ নগণ্য পরিমাণ ভিটামিন সরবরাহ করার জন্য দৈনন্দিন জীবনের খাদ্যসামগ্রীই যথেষ্ট। একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ দৈনন্দিন জীবনে সুষম খাদ্য থেকে যে পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজদ্রব্য পায়, তার চেয়ে বেশি ভিটামিন বা খনিজ শরীরের জন্য প্রয়োজন নেই। ওষুধ কোম্পানিগুলোর যুক্তি-গরিবরা সুষম খাবার খেতে পায় না বলে তাদের ভিটামিন খাওয়া উচিত। আমি বলি-যারা সুষম খাবার খেতে পায় না, তাদের ভিটামিনের প্রয়োজনটা কি? ভিটামিনের কাজ হলো-চর্বি, শর্করা, আমিষসমৃদ্ধ সুষম খাবারের মেটাবলিজম বা রাসায়নিক রূপান্তর। এসব বিজ্ঞানের কথা, তাই সাধারণ মানুষ বোঝে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো এ অজ্ঞতাকে মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তাদের অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে যায়। তবে অপুষ্টি ও রোগের কারণে শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সেই ঘাটতি বাড়তি পরিমাণ ভিটামিন প্রয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব বলে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত খাদ্যসমাগ্রী থেকে পুষ্টি ঘাটতি পূরণই চিকিৎসাবিজ্ঞানের আসল ও মূল লক্ষ্য। অনুন্নত বিশ্বে অপুষ্টির সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো উদ্ঘাটন এবং তার সংশোধনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে ওষুধ কোম্পানিগুলো এবং তাদের সহায়ক শক্তিগুলো এ সুযোগ নিয়ে অপুষ্টিকে রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে অপুষ্টি ও ভিটামিন ঘাটতি প্রতিকারে চিকিৎসার ওপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত বিশ্বে অপুষ্টি বা ভিটামিন ঘাটতি খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। অনুন্নত বিশ্বে যে হারে অপুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়, সে হারে তার প্রকৃত প্রতিকারে উদ্যোগ দেখা যায় না। অপুষ্টি প্রতিকারে ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনে সাধারণ মানুষ তেমন কোনো ফলাফল পায় না। লাভ যা হয় তা শুধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের। এ প্রসঙ্গে দ্য আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন, দ্য আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন, দ্য আমেরিকান সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, স্বাস্থ্যবান শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের উচিত খাদ্যদ্রব্য থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করা। ওষুধ আকারে বিক্রি হওয়া ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিবর্তে খাদ্যদ্রব্য থেকে প্রাপ্ত সেসব উপাদান তুলনামূলক নিরাপদ।

ওষুধ দিয়ে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব নয়। ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত সমস্যা দূরীকরণে প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার। বিশ্বে খাদ্যের সংকট নেই। সমস্যা রয়েছে সুষম বণ্টনে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা বা উৎপাদন বিষয়ক প্রযুক্তির কোনো খুঁত বা সীমাবদ্ধতা নেই। সমস্যা হলো, বিশ্বের প্রত্যেক ব্যক্তি সময়মতো পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। অনুন্নত বিশ্বে এটি এক মারাত্মক সমস্যা হিসাবে বিরাজমান। অনুন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অপুষ্টির অভিশাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম নয়। সমাজে অপুষ্টি বিতাড়নে এগিয়ে আসতে হবে সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনকে। মুনাফাখোর ব্যবসায়ী মহল থেকে যারা অপুষ্টিকে মূলধন করে ব্যবসা করে, তাদের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের। আমাদের মনে রাখা উচিত, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিশুদের হাম, যক্ষ্মা, কাশি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ সংকট সমাধানে মাতৃদুগ্ধ পানে উৎসাহিত করাসহ মায়ের সুস্বাস্থ্যের প্রতিও নজর দেওয়া আবশ্যক। এক সময় ভাবা হতো, শুধু খাদ্যের অভাবেই মানুষ অপুষ্টি ও রোগে ভোগে। বর্তমান যুগে অপুষ্টি ও রোগের সৃষ্টির বহুবিধ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। বস্তুত বসবাসের ক্ষতিকর পরিবেশ, মাতৃদুগ্ধ পান না করা এবং সংক্রামক রোগও অপুষ্টির জন্য দায়ী। বিশ্বে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব, যদি বছরে প্রতিটি শিশুর পেছনে মাত্র ১ ডলার ব্যয় করা যায়। এ পরিসংখ্যান ইউনিসেফের। নীতিনির্ধারক ও সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন, আমাদের দেশে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের ক্ষেত্রে অপুষ্টি এখনো সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

drmuniruddin@gmail.com

অপুষ্টি বিশ্ব স্বাস্থ্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম