গণতন্ত্রের জন্য ৫৪ বছরের সংগ্রাম
মেজর (অব.) মনজুর কাদের
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গণতন্ত্র অর্জনের জন্য ১৯৬৯-এ ছাত্রদের নেতৃত্বে ১১ দফা দাবি আদায়ের জন্য গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, যার সূত্র ধরে ১৯৭১-এ আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটে এবং যা স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার, কিন্তু তা হয়নি। ১৯৯০ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, কিন্তু গণতন্ত্র সে সময়েও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভারত, মিয়ানমারের মাঝখানে এবং কার্যত নেপাল ও চীনের পাশে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে তিন দিক থেকে ঘিরে আছে ভারত, যাকে এ সুবিধা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত রাজনীতিবিদরা।
অবস্থানগত সুবিধা
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে এবং কার্যত কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং নেপালের প্রতিবেশী হয়ে আছে। নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের বিভক্ত করেছে মাত্র ১৬ মাইল ব্যবধানের চিকেন নেক। এ সরু এলাকার মধ্য দিয়ে সেভেন সিস্টারে (উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্য) চলাচল করতে হয় সামরিক-বেসামরিক লোকজন ও তাদের যানবাহনগুলোকে। দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, যার বিশেষ সামরিক গুরুত্ব রয়েছে।
চীন তার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করে বাংলাদেশ সীমান্তের অদূর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে বাংলাদেশের দক্ষিণের পুরো এলাকায় একটি দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরের অবস্থা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে পরাশক্তিগুলোর রাজনীতির খেলার কারণে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সব সময় জটিল হয়ে থেকেছে। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে গাঁটছড়া সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত, সেখানেই দেশটি ক্ষান্ত হয়নি; ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েতের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করে এবং একই বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। এর ফলে দ্রুত বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়।
ভারতের প্রশান্তি
কী প্রশান্তি তখন ভারতের। দেশটি পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত এবং দ্বিখণ্ডিত করতে পেরেছে, সোভিয়েতের আনুকূল্যে থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে, সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসাবে রক্ষীবাহিনী গঠন করেছে, একক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য ইন্ধন জুগিয়েছে, ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করার জন্য শেখ মুজিবকে সরাসরি উৎসাহ দিয়েছে, সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে শেখ মুজিবকে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল কায়েম করিয়েছে, চারটি সরকারি পত্রিকা বাদে অন্যসব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে, নিশ্চিন্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য মদদ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
অপরদিকে মার্কিনসমর্থিত পাকিস্তানের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র বসে থাকেনি। দেশটি বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দেশ, কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীনের সঙ্গে ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক চুক্তি করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভারতের সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে।
স্নায়ুযুদ্ধের কবলে বাংলাদেশ
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে (১৯৪৬-৯১) যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে বাংলাদেশ স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদের উত্থান থেকে মুক্তি লাভ করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি সেনা অভ্যুত্থান না হতো তাহলে কী হতো?
গণতন্ত্রের কবর রচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে বিনা ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেনা অভ্যুত্থানের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে আজীবন প্রেসিডেন্ট রাখার কথা বলা হয়। পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি পাশ করে এক সময় সিকিমের মতো বাংলাদেশকে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার এক গণবিরোধী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সিকিমের লেন্দুপ দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন মুজিব, কারও কিছু বলার থাকত না, যেমন সিকিমবাসীর বলার কিছু ছিল না, এখনো নেই।
ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি : উদ্বিগ্ন চীন ও যুক্তরাষ্ট্র
ভারতের এ সম্প্রসারণবাদী নীতির কারণে সোভিয়েতবিরোধী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। এ কারণেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট (যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে দেওয়া সর্বশেষ দেশের স্বীকৃতিগুলোর মধ্যে একটি) অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার ১৫ দিন পর।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট এবং নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যা ভারত ভালোভাবে নেয়নি। এর পরিণতিতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্টরা জিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
পরাশক্তিগুলোর খেলায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন নিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ভারত?ও সেই সরকারকে সমর্থন দেয়। প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক প্রশাসক এরশাদ প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
স্নায়ুযুদ্ধকালে বাংলাদেশের তৎকালীন সামরিক এবং আধাসামরিক সরকার এমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে থেকে শাসন চালিয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুবছর আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব স্তিমিত হতে থাকে। প্রতিযোগিতা না থাকায় একক বিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্রও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলো থেকে হাত গুটিয়ে নিতে থাকে।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম
দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে তিনদলীয় জোট (বিএনপি+আওয়ামী লীগ+ বামজোট এবং জামায়াতে ইসলামী) ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজয়ী হয়। এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্র হত্যার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
টুইন টাওয়ার ধ্বংস : আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র শুরু
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত করলে এবং সামরিক হেডকোয়ার্টার্স পেন্টাগনে হামলা করলে যুক্তরাষ্ট্র মূলত মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে War on Terror ঘোষণা করে। এ সময় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির সমন্বয়ে গঠিত চারদলীয় জোট সরকার পড়ে যায় বিপদে। ভারত এ সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট সরকারে থাকায় বিএনপি ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদদ দিচ্ছে। শুরু হয়ে যায় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির আরেকটি ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে চারদলীয় জোট ২০০৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে পরাজিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতির নাটাই চলে যায় ভারতের হাতে। এরপর সম্মিলিত বিরোধী দলের আন্দোলনের মাধ্যমে কোনোভাবেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বাণিজ্য যুদ্ধ (নতুন স্নায়ুযুদ্ধ)
২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ (নতুন স্নায়ুযুদ্ধ) শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী বঙ্গোপসাগরের তীরের বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে সামরিক জোট কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা সামরিক জোট ‘কোয়াড’ গঠন করে ভারতের সামনে যুক্তরাষ্ট্র কোয়াডের মুলা ঝুলিয়ে দেয়। মার্কিন স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক মূল্য আছে, বিশেষ করে তার ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে যা ভারত বুঝতে ব্যর্থ হয়। ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে; কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
‘তুমি আমি আর ডামি’ নির্বাচন
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জানুয়ারি ৭, ২০২৪-এ ভারতের প্রেসক্রিপশনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ‘তুমি আমি আর ডামি’ মার্কা নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করে। গণতন্ত্র চূড়ান্তভাবে নির্বাসিত হয়। শেখ হাসিনা ভারতের ওপর ভরসা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিষোদগার করতে থাকেন। হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রকে খেপিয়ে চীন, রাশিয়া এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে আজীবন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে থাকেন।
বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানিয়ে শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। অভ্যন্তরীণ চরম অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে ক্ষমতার শূন্যতা বাইডেন প্রশাসনকে এমন একজন নেতা আনার সুযোগ করে দেয়, যিনি মার্কিন সরকারের সঙ্গে আরও ভালোভাবে সহযোগিতা করতে পারেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন উপকারী, তেমনই নতুন ক্ষমতাসীন শাসকের জন্য বিরাট কূটনৈতিক অর্জন হিসাবে গণ্য হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দেয়, তারা হাসিনা রেজিমের পরিবর্তন চায়। তবে বিরোধী দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এ মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং যোগাযোগ রক্ষাকারী গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ছক এঁকে ফেলে। রাস্তায় নেমে পড়েন অচেনা-অজানা ছাত্রনেতারা। শেখ হাসিনার পতনের জন্য একদফা দাবি পেশ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
দাবানল জ্বলার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ
একটি দাবানলে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। ছাত্ররা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আবির্ভূত হয়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের মধ্যভাগে দাবানলের সৃষ্টি করে এবং সেই দাবানলে ছারখার হয়ে যায় শেখ হাসিনার তখতেতাউস। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান তার আদি ঠিকানা ভারতে। ছাত্রদের প্রস্তাবমতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন।
ভারত হতবিহ্বল হয়ে পড়ে
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ড. ইউনূসকে ভারতের সরকার এবং গণমাধ্যম তীব্রভাবে আক্রমণ শুরু করে। এমনভাবে দেশটি প্রচারণা চালায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের পরাজয় হলে বাংলাদেশে ড. ইউনূস সরকার উলটে যাবে; কিন্তু তা হয়নি। ভারতের নেতারা চরম অস্থিরতা ও হতাশায় পড়ে যান।
চীনের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থনকারী চীনা পর্যবেক্ষকরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক মূল্যবোধ ও চেতনা দ্রুত ‘পুনর্বিন্যাস’ করার ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে পারে, যাতে তাদের সমর্থিত অংশীদার তৈরি করা যায়, যা পশ্চিমা মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। চীন আশঙ্কা করছে, এরূপ অবস্থা এ অঞ্চলে তার মূল কৌশলগত স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
চীনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা জানেন, বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী একটি দেশ, যেটি বঙ্গোপসাগরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কাজেই মার্কিন স্বার্থের জন্য তার বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক মূল্য আছে, বিশেষ করে তার ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ওপর তার রাজনৈতিক প্রভাব শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র : নতুন সন্ধিক্ষণে
গত বছরের গণ-অভ্যুত্থান কি শুধু ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সরিয়ে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, নাকি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বসমর্থিত নতুন এক বন্দোবস্ত কায়েম করা। তবে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। এখানে পুরোনো প্রশ্ন আবার নতুন করে সামনে আসে : পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন নিয়ে ভাবে, নাকি দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান তাদের কাছে মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হবে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ উপযোগী হয়ে উঠছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
সংস্কার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি। বারবার এ শক্তি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বাধা দিয়েছে। বাংলাদেশের সব সংসদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে দেশটি আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচন বিতর্কিত করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে পরাজিত এ আধিপত্যবাদী শক্তি এখন যথাযথ সংস্কার ছাড়াই দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে চলেছে, অথচ গত ২০ বছর দেশটি আওয়ামী লীগের মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। এ কারণেই রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভরসাস্থল
জাতির এ ক্রান্তিকালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দিতে এবং ‘ঐক্য বজায় রাখার’ ডাক দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন এর আগে আসেনি।
আশঙ্কা
ধৈর্য ধারণ না করে সব বিষয়ে তাড়াহুড়ো করলে স্বার্থের সংঘাতে জাতীয় ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরতে পারে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অতীতের মতো বিকল্প পথ খুঁজতে থাকবে এবং এর ফাঁকফোকর দিয়ে আধিপত্যবাদী শক্তি আবারও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়বে, যার কারণে দেশের মধ্যে এক চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য
