অরণ্যের ডাক রোমাঞ্চকর অনুভূতি
লেখা ও ছবি : আবু আফজাল সালেহ
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অনেক দিন পর বন্ধু মিথুনের সঙ্গে দেখা হলো। বলল, চলো আমরা শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বেড়াতে যাই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম লাউয়াছড়া যাব। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় এ জাতীয় উদ্যান। রাতের গাড়িতে উঠে পড়লাম। ভোরে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে মিরপুর দিয়ে রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের রাস্তা। একটু পার হলেই শ্রীমঙ্গল সীমানায় স্বাগত জানাবে ‘চায়ের দেশে স্বাগতম’ বলে।
শ্রীমঙ্গল চার রাস্তা থেকে ভানুগাছমুখী রোড। শহরের রেলগেট পেরোতেই বিজিবি ক্যান্টিন। মায়াবী দুপাশ। শহর পেরিয়েই ফিনলে চা-বাগান। তার আগেই শ্রীমঙ্গল ৭১-এর বধ্যভূমি। ঝলমলে চা-বাগান। সবুজের মধ্য দিয়ে ৩ কিমি. যেতেই ডান পাশে রাস্তা দেখিয়ে দেবে চা-রিসার্স কেন্দ্রের আঁকাবাঁকা রাস্তা। পাখির ওড়াউড়ি, শ্রমিকের চা-পাতা তোলার দৃশ্য। বেশির ভাগ শ্রমিকই নারী। পাহাড়ি মেয়েদের চা-পাতা তোলার দৃশ্য মুগ্ধ করবেই। চা-বাগানের অবারিত সবুজ আর আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে সামান্য যেতেই বাম পাশে চা মিউজিয়াম।
কিছুদূর যেতেই পাঁচতারকা নিবাস ‘গ্রান্ড সুলতান’। চা-বাগান আর সবুজের মধ্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। আরও কিলো তিন গেলেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মাথার ওপর বানরের লাফালাফি-দাপাদাপি আর নিচে লেজ তুলে যাওয়া হনুমান এবং বিভিন্ন পাখির কলতানে নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে গেলে মনে রোমাঞ্চ জাগাবে।
৫০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের ভেতর। কিছু পর্যটক দেখলাম ফল ও ডাবের পানি পান করছে। দুপাশে গাছগাছালি ও পাখপাখালি। বয়ে চলেছে লাল রাস্তা। পাশেই মাঝে-মধ্যে ঝিড়ি সৌন্দর্য দেখা মিলছে। কিছুদূর যেতেই রেললাইন। সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। মাঝে-মধ্যে ট্রেনের হুইসেল! কী সুন্দর, মায়াবী রেল। এখানে সাত কালারের চা উপভোগ করতে পারবেন। পাহাড়ের গা বেয়ে একটু ওপরে এ চা-ঘর। পাশেই ছোট্ট একটি দোকান। হস্তশিল্পসহ খেলনা পাবেন। বাচ্চারা কিনে আনন্দ পাবে। রেলিং বেয়ে নিচে নেমেই রেললাইনঘেঁষে সাইনবোর্ড। অস্কার বিজয়ী একটি সিনেমার শুটিং হয়েছিল বলে লেখা আছে। রেলপথের ডানে-বাঁয়ে গিয়ে চা-বাগান থেকে ট্রেন যাওয়ার ছবি তুলতে মজাই।
ঘন বনাঞ্চল, সূর্যের আলো সবসময় পৌঁছায় না। হঠাৎ মিথুন বলল, ওই যে দেখুন, চশমাপরা হনুমান। চারদিকে বাহারি রঙের প্রজাপতি। উঁচু গাছে ঝুলছে অজানা সাপ। লতা বা পাতায় জড়িয়ে। কী রোমাঞ্চকর! থেকে থেকে পাখির ডাক। ঝিঁঝির শব্দ বন মাতিয়ে রেখেছে। রঙিন ঝরাপাতা বিছানো পথ বেয়ে বনপথে আমরা চলেছি। এদিক-ওদিকে কিশোর-কিশোরীর দলও পর্যটকদের আনাগোনা। সকালের দিকে বিভিন্ন পাখির ডাক প্রবেশপথ থেকেই শোনা যাবে। পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখপাখালি ও বিভিন্ন প্রাণী গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়ে।
সূর্য ঢুকে পড়েছে গভীর অরণ্যের ফাঁক দিয়ে-কী রোমাঞ্চকর, কী থ্রিলার! নিরিবিলি প্রায় জনমানবশূন্য এমন দৃশ্য ঘনঘন দেখা যাবে।
হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল। তড়িঘড়ি করে রেলপথের কাছাকাছি। হেলে-দুলে ট্রেন চলছে। ট্রেনে বেশ কয়েকবার সিলেটে যাতায়াত করেছি এ বন দিয়েই। চা-বাগান, অন্ধকার এ অরণ্যেও বাঁশবাগান আর সবুজে মোড়া দুপাশের পথ বেয়ে যেতে কতই রোমাঞ্চ লাগে, তা বলে বোঝানো যাবে না! এরই মধ্যে সাত কালারের ঐতিহ্যবাহী চায়ের স্বাদ ও নাশতা সেরে নিলাম। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের চলাচলও দেখলাম। শ্রীমঙ্গল ও একটু দূরে বিভিন্ন রিসোর্টে থাকতে পারেন। সবুজমোড়া রিসোর্টে থাকতে রোমাঞ্চ হবে।
বনের ভেতর বয়ে চলেছে ঢাকা-সিলেট রেলপথ
এরপর শ্রীমঙ্গল হয়ে ঢাকা। একদিনের এ ভ্রমণ স্মৃতিপটে থাকবে বহুদিন। চুম্বকময়তা আছে এ বনে। মায়াবী ভরা আশপাশ। তাই, ডাকছে আমায় বারেবারে...। ভ্রমণ শেষে বন্ধু মিথুনের কথাই মনে হলো, ফরেস্টে আছে মায়াবী চুম্বক, আছে থ্রিলার!
যাওয়া-আসা : ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে মৌলভীবাজারগামী বাসে শ্রীমঙ্গল নামতে হবে। ট্রেনে এলে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নেমে পড়ুন।
থাকা ও খাওয়া : থাকা ও খাওয়ার জন্য শ্রীমঙ্গলে হোটেল ও রিসোর্ট আছে। বাজেট অনুযায়ী যে কোনো হোটেলে রাতযাপন ও খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। পানসী হোটেলে (শ্রীমঙ্গল থেকে যাত্রার শুরুতেই) বিভিন্ন রকমের ভর্তার স্বাদ নিতে পারেন।
সতর্কতা : বন-পাহাড়ে ট্রাকিং বা হাঁটতে হলে স্যান্ডেল নিয়ে এলে আরামদায়ক হবে। সাপ ও বিষাক্ত প্রাণী থেকে সতর্ক থাকতে হবে। হোটেলগুলোতে দামদর করে নিতে হবে। অনেক হোটেল/রিসোর্টে থাকা-খাওয়ার জন্য অত্যধিক ব্যয় করতে হয়। তাই পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করুন। একদিন থাকলে তো অত হিসাব না করলেও চলে!
লোকাল আনারস মানে শ্রীমঙ্গলের আনারস। স্বাদ নিতে ভুলবেন না। শ্রীমঙ্গল যাবেন আর এখানকার আনারসের স্বাদ নেবেন না, তাই কী হয়! পর্যটকদের জন্য সাত রঙের চা বনের ভেতরেই পাওয়া যাবে।
দুধারে সবুজ চায়ের নৈসর্গিক দৃশ্য
বনের ভেতর গাছের গায়ে খোদাইকরা প্রেমিকের চিহ্ন-চলার পথে ভালোবাসা বিছান। লম্বা গাছে কপোত-কপোতীর সংকেত চিহ্ন।
অরণ্যের মধ্যখান দিয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথ। এ পথ যদি শেষ না হয়... তবে কেমন হতো!
