ভ্রমণ
হরিরামপুরের পদ্মার চর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য
মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গন্তব্য কুশিয়ারচর। জায়গাটা মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলায়। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ বরাবরের মতো এবারও গতানুগতিক পথে না গিয়ে, সাভার নামাবাজার ব্রিজ পার হয়ে ফোর্ডনগর, আড়ালিয়া, খড়ারচরের মায়াবি সড়ক পথটাকেই বেছে নিই। এতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার অতিরিক্ত মোটরসাইকেল রাইড করতে হলেও, ভ্রমণে মিলবে অনেক কিছুরই বাড়তি পাওনা। আঁকা-বাঁকা সরু চকচকে পিচঢালা সড়কে ছুটছি। দুপাশে বিস্তর ফসলি জমি।
কাঁচা-পাকা ফসলের ম ম ঘ্রাণ। জমি থেকে সড়কের উচ্চতা কোথাও কোথাও ১৪-১৫ ফিট। সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার। মোচড় ঘুরতে গিয়ে নয়া আতঙ্ক অটোর সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তো আর কথাই নেই। সোজা গিয়া খাদে। যে কারণে হেড়ে গলায় মন খুলে গান ধরতেও পারছিলাম না। তা যাই হোক, ভরা সন্ধ্যায় রাইডটা জমে উঠছে বেশ। যেতে যেতে কাংশা ব্রিজ পার হয়ে সিঙ্গাইর বাজারে ব্রেক। গরম গরম চিতই পিঠা আর হাঁসের সিদ্ধ ডিম একচোট পেটে পুরে আবারো বাইক স্টার্ট।
ধীরে ধীরে আতঙ্কশূন্য [ব্যাটারিচালিত যানবাহন] হয়ে পড়ল পথঘাট। সেই সুযোগে ফাঁকা সড়কে মারো টান। মারতে মারতে বাস্তা বাজার হয়ে তেলতেলে নয়া পাটুরিয়া সড়কে। প্রশস্ত সড়ক পেয়ে স্পিড কিছুটা বাড়িয়ে দিই।
যেতে যেতে মিতোরা ব্রিজের আগে একটি টি-স্টলের নাম দেখেই মারলাম ব্রেক। এক মগ মালাই চায়ের সঙ্গে একটুকরো নানরুটি চুবিয়ে খেতেই মনটা ভরে গেল। এরপর স্টলের পাশেই থাকা বাহারি মসলার মিষ্টি পান মুখে পুরে সোজা টান। মোটরবাইক ট্যুরে এই একটা মজা।
ইচ্ছা হলেই যেথায় খুশি সেথায় থামিয়ে, ভরপুর সেই জায়গাটার মজা লুফে নিতে পারা। যতই এগোতে থাকি ততই অন্ধকার আর নির্জনতা গ্রাস করতে থাকে। শীত বিদায় নিলেও এ পাশটায় বাতাস এখনো বেশ শীতল। ছুটতে ছুটতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুটঘুটে অন্ধকার এক ব্রিজে থামতে হলো। তিন-চারজনকে আসতে দেখে ভাবলাম ডাকাত কিনা। তারাও এমনটা ভেবেছিল কিনা কে জানে।
সামনাসামনি হতেই মৃদু আলাপচারিতায় পথের নিশানা পরখ করে নেওয়ার ছলে দুচারটা ছবি তুলে নিই। ভেতরে ভেতরে ভয়ে মরি। ওপরে দিয়া ভাব মেরে দ্রুত ভাগি। ভাগতে ভাগতে খেজুর মিঠাইখ্যাত ঝিটকার নয়নাভিরাম সড়কে চলছি। চলতে চলতে পদ্মা পারের কুশিয়ারচর গ্রামে পৌঁছি। রাত তখন দশটার ওপরে। এত রাতে কোথায় কি তাঁবু টানাই। অগত্যা ভ্রমণসঙ্গী জসিমের বিয়াইন বাড়ি আশ্রয় নিই। রাতবিরাতে আমাদের পেয়ে বিয়াইনও বেশ খুশি। জম্পেশ এক আড্ডা জমিয়ে ঘুমের দেশে যাই হারিয়ে। গ্রামের সকাল দেখার নেশায় খুব ভোরেই ঘুম ভাঙে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চলে যাই পদ্মার পাড়ে খেজুরগাছ তলায়। আয়েশ করে বসার জন্য তাঁবু টানাই। ততক্ষণে নাশতা রেডি।
আহ মাটির চুলায় করা পিঠাপুলির কি অমৃত স্বাদ। হ্যামোকে কিছুক্ষণ দোল খাওযার পরে আবারও খানাপিনা শুরু। সঙ্গে এবার হাতে ভাজা মুড়ি। খাওয়ার লোভে ডুবে থাকলে, দুনিয়ার সৌন্দর্য অদেখাই রয়ে যাবে। যাই এবার কুশিয়ারচর গ্রামটা হেঁটে বেড়াই। হাঁটতে হাঁটতে বিশাল এক খেজুর বাগানের দেখা পাই। বাগানটা দেখে বেশ উৎফুল্ল হই। বিলুপ্তপ্রায় খেজুরগাছের আধিক্য দেখে যারপরানই খুশি হই। গ্রামবাসী জানাল নতুন করে আবারও এ চরে খেজুরগাছ বপন করা হয়। নিশ্চিত এটা একটা সুসংবাদ।
চরজুড়ে প্রচুর সবজি খেত। মিষ্টিকুমড়ার ফুটন্ত হলদে ফুলের ওপর সকালের সোনারোদ ঝিকিমিকি খেলে। গ্রামের প্রতিটা বাড়িই যেন একেকটি খামার। গরু, বকরি, হাঁস, মুরগি সবই পোষা হয়। কোনো কোনো বাড়ির পুকুরে মাছ চাষও করা হয়। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে চোখের সামনে দোয়ানো গরুর দুধ, সদ্য বানানো খেজুর মিঠাই খেতেও ভুল করি না। গ্রামের মানুষগুলোও বেশ আন্তরিক।
ঘুরতে ঘুরতে আবারো ফিরে আসি তাঁবুতে। এরই মধ্যে সূর্যের ঝাঁঝালো তেজ চেতিয়ে ওঠে। চোখ পড়ে পশ্চিম দিকে। দৃষ্টির সীমানার মধ্যেই সুনসান নীরব একখণ্ড ভূমি পানির ওপর মাথা উঁচু করে আছে। স্থানীয় জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতেই বলে ওটা ফরিদপুরে পড়ছে। মনে মনে বলি, বেটার কি মাথা খারাপ হইছেনি। কই মানিকগঞ্জ আর কোথায় ফরিদপুর। পরক্ষণেই বি.বাড়িয়া জেলার কথা মনে পড়ে গেল। যার সীমানা নারায়ণগঞ্জ লাগোয়া। তা বাপু যেই জেলায়ই হোক, যেতেই হবে আমাদের।
নদী ঘাটে নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নেই। একদল দাঙ্গালকে উসকে দিলাম মাঝি খুঁজে আনার জন্য। দাঙ্গাল পোলাপান নৌকার মাঝিকে না পাইয়া, মালিককেই সঙ্গে করে নিয়ে এলো। তাহলে আর দেরি কেন। ভাসিয়ে দেওয়া হলো ইঞ্জিন নৌকা। পদ্মার বুকে ভেসে ভেসে উঠি গিয়ে সেই চরে। ওয়াও! কোনো জনমানবের চিহ্ন নাই। নেই কোনো গবাদিপশুর পাল। প্রমত্তা পদ্মার বুকচিরে সদ্য জেগে ওঠা চর। চারদিকে থইথই পানি, মাঝখানে এক টুকরো জমি। সেই জমিরই মাঝে আবার নীলাভ পানির জলাধার।
অনেকটা প্রাকৃতিক লেকসদৃশ্য। চরের তীরে পদ্মা নদীর ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সব মিলিয়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভর করে আছে। সময়ের অভাবে পুরো চরটা হাঁটা হয়নি। তবে টলটলে স্বচ্ছ পানিতে ডুব দিতে কার্পণ্য করিনি। কুশিয়ার চর ঘুরতে গিয়ে বাড়তি পাওনা হিসাবে ভ্রমণ ঝুলিতে যোগ হলো, অচেনা এক নয়নাভিরাম চরের সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে কুশিযারচর ভ্রমণের ষোলোকলায় বুঁদ হয়ে ফেরার পথ ধরি।
চলুন ঘুরে আসি : ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জগামী বাসে/কারে কিংবা মোটরবাইকে। কার/বাইক হলে নিজের ইচ্ছামতো সড়কে যাওয়া যাবে।
থাকা-খাওয়া : পূর্বপরিচিত কেউ থাকলে সুবিধা হবে। নয়তো পদ্মার পাড়ে তাঁবু টানিয়ে রাত যাপনসহ নিজেরা রান্নাবান্না করেও খাওয়া যাবে।
আরও কী দেখা যাবে : হরিরামপুর উপজেলাতেই লেছড়াগঞ্জ নামক আরও একটি নয়নাভিরাম চর রয়েছে। সেখানে দুর্লভ প্রজাতির মাছের দেখা মিলে। এ ছাড়া কুশিয়ারচর গ্রাম থেকে ঢাকা ফেরার সময়, বিখ্যাত খেজুর গুড় পক্রিয়াজাতকরণ গ্রাম ঝিটকাও ঢু দিয়ে আসা যাবে।
সতর্কতা : নিজের গ্রামের মতোই স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াবেন। স্থানীয়দের সঙ্গে ভাব জমিয়ে, খরচের বিনিময়ে পিঠাপুলিও খাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো ধরনের অশ্লীলতা গ্রামবাসী মেনে নেবে না।
ছবি: মুহাম্মদ হানিফ
