ভ্রমণ
মায়ার টানে মায়াদ্বীপ
দেওয়ান সামছুর রহমান
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘বর্ষার শ্রাবণে মেঘনা যখন প্রেমে পড়ে,
রিমঝিম বৃষ্টি নৌকায় মন ভরে।’
বাংলা ক্যালেন্ডারের শ্রাবণ মাস মানেই ভেজা দুপুর, মেঘলা আকাশ, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক ধরনের অচেনা প্রেম। মাঠঘাট, নদী, চর-সব যেন ধুয়ে-মুছে এক নতুন রূপ নেয় এই বর্ষায়। ঠিক এমনই এক বর্ষণমুখর শ্রাবণের সকালে, ১৪৩২ বঙ্গাব্দের ১১ শ্রাবণ, ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ২৬ জুলাই ২০২৫, আমরা পাড়ি দিই মেঘনার বুকে ভেসে থাকা এক স্বপ্নিল স্থান-মায়াদ্বীপে।
সাহিত্যের টানে জলযাত্রা, কবিতা ভাসান, নৌবিহার ও দ্বীপ ভোজন, এতসব বিশেষণে বিশেষিত করা যায় এ ধরনের ভ্রমণকে। সোনারগাঁও সাহিত্য নিকেতনের প্রায় পঁয়ত্রিশ সাহিত্যপ্রেমী, লেখক, পাঠক আর প্রকৃতিপাগল মানুষ-সবাই মিলে এক বিশাল নৌবহর। গন্তব্য একটাই : মেঘনার বিশালতা ছুঁয়ে দেখা, আর কিছুটা সময় প্রকৃতি আর কাব্য একসঙ্গে খুঁজে নেওয়া। ভোরের হালকা রোদে বৈদ্যেরবাজার মুক্তিযোদ্বা কমপ্লেক্স নৌঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ছইওয়ালা নৌকায় যাত্রা শুরু সকাল ৯টায়। নৌকার ভেতরে সকালবেলার নাশতা-পরোটা, ভাজি আর সঙ্গে চা। চারদিকে নদীর পানি, আর নৌকার ছাদে বসে সবার মুখে গল্প আর কবিতার লহর। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা মইসারচর ঘাটে নামলাম। চমৎকার একটা ঘাট, আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেশানো। নদীর মধ্যে বেশ কিছু দূর সামনে টাওয়ারের মতো যেখানে দাঁড়িয়ে মেঘনার সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। এটি কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলায় পড়েছে। ওখান থেকে মায়াদ্বীপ, বাংলাদেশের দ্বিতীয় কক্সবাজার। প্রায় শত বছরের পুরোনো চর নুনেরটেকের একটি অংশ মায়াদ্বীপ।
মায়াদ্বীপ নামকরণ
নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের নাম মায়াদ্বীপ হওয়ার পেছনে রয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, একজন প্রকৃতিপ্রেমী কবি শাহেদ কায়েসের ছুটে চলা ও দুরন্তপনার মতো জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। নুনেরটেক গ্রাম ঘেঁষে মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রজেক্ট করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালে ওই প্রজেক্ট বাতিল করে দেওয়া হয়। নতুন জায়গা ওই চরের তিনটি অংশ-গুচ্ছগ্রাম, সবুজবাগ ও রঘুনারচরকে একত্রে ২০০৭ সালে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কবি শাহেদ কায়েস মায়াদ্বীপ বলে প্রথম ঘোষণা দেন। মূলত ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে শাহেদ কায়েস ওই চরে বেড়াতে যান। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে তিনি বাড়ি ফিরে এসে সেই রাতেই ওই দ্বীপকে নিয়ে (‘মায়াদ্বীপ’) নিয়ে একটি কবিতা লেখেন। একটা কবিতা থেকে একটি স্কুলের জন্ম, একটি বইয়ের প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে একটি চর রক্ষা আন্দোলন ‘মায়াদ্বীপ রক্ষা আন্দোলন।’ আর এভাবেই মায়াদ্বীপের জন্ম।
মায়াদ্বীপ সোনারগাঁও উপজেলার বারদী ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত। সুবিশাল বালুকাময় তটভূমি আর নির্জন বিস্তার দেখে মনে হয় যেন এক টুকরা কক্সবাজার-তবে আরও নিস্তব্ধ, আরও নিবিড়। একে একে আমরা মায়াদ্বীপ ঘাটে নামতে থাকি কবি শাহেদ কায়েস, কবি রহমান মুজিব, শিশু সাহিত্যিক শাহ আলম, সোনারগাঁও সাহিত্য নিকেতনের সভাপতি আসমা আকতারি, সাধারণ সম্পাদক রবিউল হুসাইন, সাহিত্য নিকেতনের উপদেষ্টা ব্যাংকার মতিউর রহমান, মোয়াজ্জেনুল হক, শংকর প্রসাদ, দেওয়ান হাবিবুর রহমান। মোরগপোলাও ছিল দুপুরের মেনু যা নৌকায় সঙ্গে করে আনা হয়েছে। নৌকার ছইয়ের ছায়ায় বসে পা বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু খাওয়া নয়, সঙ্গে ছিল সাহিত্য আড্ডা-কেউ কবিতা পড়ছে, কেউ গল্প বলছে, কেউবা শুধু মেঘনার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ শুনছে প্রকৃতির কবিতা। ফেরার পথে ঐতিহাসিক তুলাতলি বাজারে চা খাওয়া, এরশাদ হোসেন অন্য, আজিবুরসহ মোফাখখার সাগর, মোকাররম সলিল, সেলিম প্রধান, দেওয়ান সামছুর রহমান, নজরুল স্যার, সেইসঙ্গে ভাবিরা তো ছিলই। সবাই বেশ মজা করলাম। বিকালটা ছিল একটু অন্য রকম। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে বালুর চরে, প্রাপ্তবয়স্করাও সময় নিয়ে হাঁটছে নিরিবিলি পাড় ধরে। সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। নদীর ওপারে রাঙা আলোয় ভেসে যাচ্ছে চর, আকাশ, আর আমাদের মনে বাঁধা কিছু স্মৃতি। পথে ট্রলার থামিয়ে রামপুর বাজার পরিদর্শন। হায় হায় রামপুর বাজারে আমাকে রেখে ট্রলার দে ছুট। না, না ফেলে কি আর আসা যায়?
বিদায়, আবার আসব,
সূর্যাস্তের ঠিক আগে নৌকায় চেপে ফেরা শুরু। বুকের ভেতর কেমন যেন টান পড়ে-যেন মায়াদ্বীপ আমাদের টেনে রাখতে চায় আরও কিছুক্ষণ। কিন্তু সময় তো চলে যায়, নদীর মতোই। এ ভ্রমণ শুধু একটা যাত্রা ছিল না, ছিল নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক গড়া। মায়াদ্বীপ শুধু একটি চর নয়, এটি এক অনুভবের নাম। এ শ্রাবণের ভেজা দিনে সেখানে গেলে আপনি শুধু প্রকৃতি দেখবেন না, নিজেকেও নতুন করে চিনবেন।
যেভাবে যাওয়া যাবে : ঢাকার গুলিস্তান থেকে স্বদেশ বা দোয়েল বাসে করে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা। ভাড়া ৬৫ টাকা। ওখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশায় ২০ টাকা দিয়ে বৈদ্যেরবাজার ট্রলার ঘাট, ওখান থেকে নৌকায় করে মায়াদ্বীপ। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা বা বৈদ্যেরবাজার ঘাটে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে পারেন। তবে একা আসার চেয়ে গ্রুপ করে আসলে মজা বেশি, খরচা কম।
