ভ্রমণ
পর্যটকের মন ভরিয়ে দেয় বান্দরবান
লেখা ও ছবি আবু আফজাল সালেহ
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জেলা বান্দরবান। বান্দরবান হচ্ছে শৈল শহর। এ পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সম্প্র্রদায়ের বসবাস। বাঙালি ও বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত। নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, বগা লেকের মতো অসংখ্য ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে এ জেলায়। একমাত্র পাহাড়ি নদী সাঙ্গুর অনুপম দৃশ্য মন জুড়িয়ে দেয়। পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য লুকানো। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। চোখে পড়বে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। যেতে যেতে সুর ভাসে বিভিন্ন উপজাতীয়দের গানে। পাহাড় পেরিয়ে বিভিন্ন লোকেশনে প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোরম লাগে। পাহাড়ের ভাঁজে রং-বেরঙের ফুল দেয় দৃষ্টিসুখ।
মেঘলা ও নীলাচলের মতো নান্দনিক আরও কিছু ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে বান্দরবান শহরের আশপাশেই। ছয় থেকে আট কিলোমিটারের মধ্যেই। পাহাড়ি সাঙ্গু নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে শহরের মধ্য দিয়েই। পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মিলনমেলা বান্দরবান শহর। বাজারে উভয় জনগোষ্ঠীর ভিড়। বেচাকেনাও করে একইসঙ্গে। দারুণ সম্প্রীতির শহর এটি। ফুটপাতের ছোট ছোট বাজারগুলোও চমৎকার দেখতে। রাতে পাহাড়ের ভাঁজে আলো জ্বলে। দূর পাহাড়ে মিটমিট করে। ম্রোদের বাসও শহরের কাছাকাছি; পাহাড়ের খাঁজে।
নীলগিরি : বান্দরবানের চমৎকার একটি স্পট নীলগীরি। শহর থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি প্রায় ৫০ কিমি পথ বেয়ে পাহাড় চূড়ায় এ নান্দনিক স্পট। জনপ্রতি প্রবেশ ফি ৬৫ টাকা। সিএনজি/চাঁদের গাড়ি পার্কিং করতেও গাড়িভেদে ৩০/১০০/৩০০ টাকা চার্জ লাগে।
শহর থেকে সিএনজি করে পারিবারিক ভ্রমণ শুরু করলাম। দুই মেয়েসহ আমরা চারজন। শুরু থেকেই রোমাঞ্চকর যাত্রা। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ রোমাঞ্চ জাগানিয়া। একটু যেতেই মেঘপরিদের খেলা। মেঘের খেলা দেখতেই আমরা ভোরেই বের হয়েছি। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মেঘপরিরা ক্লান্ত হয়ে যায়। খেলা কমিয়ে দিতে থাকে। ফলে আমরা প্রথমেই ৪৭ কিমি দূরের নীলগিরি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পাহাড় মেঘ আর সবুজের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অস্থায়ী বাজার দেখা গেল। পেঁপে, আনারস, কলার আধিক্য দেখলাম। পাহাড়িদের বিচিত্র জীবনযাত্রা উপভোগ করতে করতে ছুটে চললাম গন্তব্যের দিকে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ি শিশুদের হাতনাড়া শুভেচ্ছা। যাওয়ার ডান বা বাঁ দিকে সারি সারি পাহাড়। উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়ে মেঘ আটকে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পাখির কলতান মুগ্ধ করছে। এসব উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের নীলগীরি। টিকিট কেটে প্রবেশ করতেই কী প্রশান্তি! কী নান্দনিক দৃশ্য! আমরা অনেক উঁচুতে। আর মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের নিচে, পাহাড়ে। দূরের সিঁড়ির মতো পাহাড়। আকাঁবাঁকা পথ-কী দারুণ দেখতে!
এবার ফেরার পালা। ২০-২৫ কিমি আসতেই পাহাড়ি সাঙ্গু নদী উঁকি দিচ্ছে। কী মনোলোভা! মিলনছড়ি পর্যন্ত সাঙ্গুর এমন কোমনীয় দৃশ্য মন ভরিয়ে দেবেই। এরপরই চিম্বুক পাহাড়। এখানে থামলাম। ২০ টাকা জনপ্রতি টিকিট কেটে উঠতে থাকলাম চিম্বুক পাহাড়ে। দেশের শীর্ষ পাহাড়ের একটি চিম্বুক। একটু ওপরে উঠতেই চোখ ছানাবড়া। পাহাড় আর পাহাড়! আহা, কী সুন্দর বান্দরবান! চোখ ফেরানো যায় না! যতদূর চোখ যায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ে লুকিয়ে শুভ্র মেঘ। কিছু মেঘমালা ওড়াউড়ি করছে। কী যে শিহরণ জাগানিয়া দৃশ্য! না দেখলে বিশ্বাস করানোই কঠিন!
এরপর রওয়ানা দিলাম শৈলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। শহর থেকে ৮-১০ কিমি দূরের এ ঝরনা। এখানে উপজাতীয়দের ছোট বাজারও আছে। ফলমূল ও পাহাড়ি পোশাক কেনাকাটা করতে পারবেন। কিছু দূর যেতেই সাঙ্গুর অপরূপ দৃশ্য। মিলনছড়ি পুলিশ চেকিং পয়েন্টের কাছে ছবি তুললাম। মনে মনেই বলে উঠলাম, কী সুন্দর, কী সুন্দর! সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতেই যেন আগলে রেখেছে বান্দরবানের এমন সৌন্দর্য। দুপুর ১টা নাগাদ ফিরে এলাম বান্দরবান শহরে। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে ও খাওয়া-দাওয়া করে বেলা ৩টার দিকে নীলাচল ও মেঘলার দিকে যাত্রা করলাম। যাতায়াতের সিএনজি ভাড়া নিল ৮০০ টাকা। বিকালে নীলাচলের অভূতপূর্ব দৃশ্য পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেয়। উপজাতীয়দের জীবনকালচার উপভোগ্য।
নীলগিরি হেলিপ্যাড থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। এ পথটিই বান্দরবান শহরে নিয়ে যাবে।
নীলগিরির সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে পাহাড় ও মেঘের মিতালি। পর্যটনকেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট।
মেঘলা ও নীলাচল : বান্দরবান শহরের কাছাকাছি পর্যটন স্পট নীলাচল। ৫-৬ কিমি দূরের এ স্পট দারুণ ও মনোরম। মেঘলা-বান্দরবান সড়কে চোখে পড়ল আনারসের বাগান। মেঘালয় প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। নানা রকম ফুল। হ্রদে বিভিন্ন রকম জলজ পাখি। ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পাহাড়ের দেওয়াল। হ্রদে নৌভ্রমণ আনন্দকে দ্বিগুণ করে। এ হ্রদের ওপর দিয়ে ক্যাবল কার দেখে দার্জিলিংয়ের ক্যাবল কারের কথাই মনে হয়ে যায়। এখানে থাকার জন্য ব্যবস্থাও আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাহাড়ের দৃশ্য কী চমৎকার।
এরপর যৌথ খামার হয়ে টাইগারপাড়ায়। উঁচু-নিচু কালো পিচের রাস্তা। সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে যায় চান্দের গাড়ি, মোটরবাইক ও যন্ত্রযান। টাইগারপাড়ার প্রায় প্রবেশমুখেই সড়ক প্রবেশ ফি দিতে হয়। চান্দের গাড়িপ্রতি ৬০ টাকা। বাইক বা সিএনজি ৩০ টাকা। এরপর দেখি ন্যাড়া পাহাড়। মাঝেমধ্যে আগুন বা কালো ছাই। পাশের সহযাত্রী বললেন, এগুলোকে বলে জুমচাষ। পাহাড়ের লোকজনের চাষ পদ্ধতি। টাইগারপাড়া দিয়ে নীলাচল যেতে রোমাঞ্চকর আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিচ্ছি। মোড়ে মোড়ে পাহাড়িদের কাঁচা বাড়ি। অল্প পরিমাণ পাকা বাড়িও দেখলাম। পাকা বাড়ির বেশিরভাগই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন দোকান বা পর্যটকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা আছে। এরপর পৌঁছে গেলাম নীলাচল। বান্দরবান থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে।
৫০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া! কী অপরূপ গো তুমি! দার্জিলিংয়ের চেয়ে কম কিসে! ওই দূরের শহর, জুমচাষ, পাহাড়িদের ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে! সবুজ কলাপাতা আর বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে দূরের স্বর্ণমন্দির দেখা যায়। পাহাড়ি রঙিন ফুলে মুগ্ধ হতেই হয়। নিচের দিকে পাহাড়ি পথ যেন পেনসিলে আঁকা ধূসর চিকন বক্রপথ। খেলার মাঠ। পাশ থেকে কেউ কেউ বলছেন, না, এটা জুমচাষ! চারদিকে নীল পাহাড়। যেন শাড়িপরা বান্দরবানের আঁচল; নীল রঙের। মিষ্টি বাতাসে পর্যটকদের চুল ওড়ে। তাদের বিভিন্ন রঙের পোশাকে পাহাড় সেজেছে অন্য রকম। পাহাড়-নারী-ঝরনা-নদী : অপূর্ব সাজ! কী করে ভুলি তোমারে! সুন্দরী বান্দরবান, চোখের ইশারায় ডাকে সব সময়। অপূর্ব বান্দরবান! কী অপরূপ পার্বত্য বান্দরবান জেলা!
সাঙ্গু নদী : দেশের পাহাড়ি নদী সাঙ্গু। এটি পাহাড় উপত্যকা বেয়ে শহরের সেনানিবাসের কাছে অপরূপ দৃশ্য বিলিয়ে আবার পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। নীলগীরি ও চিম্বুক পাহাড় থেকে সাঙ্গু নদী দেখতে চমৎকার। মনে হয় অজানা জগতে ঢুকে পড়েছি।
মিলনছড়ি পুলিশ চেকিং পয়েন্ট থেকে পাহাড়ি নদী সাঙ্গু। থানচি বাজারের কাছে।
উপজাতীয় বাজার : বান্দরবান শহরে দিন-রাতে উপজাতীয় বাজার বসে। এটা মগবাজার নামেই পরিচিত। পাশেই বার্মিজ বাজার। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন রোডসাইডে ছোট-বড় উপজাতীয়দের বাজার বসে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা হয়। যেতে যেতে উপজাতীয়দের অস্থায়ী বাজার। সকালের দিকে নিজস্ব কৃষি দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়।
যাতায়াত : বাসযোগে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে চট্টগ্রাম। ঢাকা-সিলেট-ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনেও চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। এরপর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে এসি-ননএসি বাসে বান্দরবান। ঢাকা থেকে শ্যামলী, ইউনিক, হানিফ, সেন্টমার্টিন পরিবহণসহ বেশ কিছু বাস সকাল-রাতে সরাসরি বান্দরবান যায়। ভাড়া ৮৫০ থেকে শুরু।
থাকা ও খাওয়া : থাকা ও খাওয়ার জন্য বান্দরবানে বিভিন্ন মান ও দামের অনেক হোটেল-রিসোর্ট পাওয়া যাবে। বাসটার্মিনালের কাছেই বেশ কিছু আবাসিক ও খাওয়ার হোটেল পাবেন।
চাঁদের গাড়ি ভাড়া : টার্মিনালের কাছেই নীলগীরি, নীলাচল বা থানচি যাওয়ার সিএনজি, চাঁদের গাড়ি পাওয়া যাবে। ছোট-বড় চাঁদের গাড়ি ৩০০০ টাকা থেকে শুরু। ৫-১৫ জন যাতায়াত করা যাবে। আর ২-৩ জনের জন্য সিএনজি ভাড়া পাওয়া যাবে। ভাড়া কমবেশি দুই হাজার। এ চুক্তি নীলগিরি, মিলনছড়ি, চিম্বুক পাহাড় ও শৈলপ্রপাতের প্যাকেজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নীলাচল, মেঘলা বা শহরের কাছাকাছি ভ্রমণের জন্য কমবেশি হাজারের কাছাকাছি (স্পট-প্রতি) সিএনজি-চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করে নিতে হবে। এক বা দুজন হলে অন্য কোনো পার্টির সঙ্গে শেয়ারে গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। নতুবা খরচ অনেক বেশি পড়বে। এখানে রিজার্ভ ছাড়া গাড়ি পাওয়া যায় না।
