চীন–মার্কিন প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায়, পুনর্গঠিত হচ্ছে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৪ এএম
২০১৮ সালে শুরু হওয়া মার্কিন–চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এখন অনেক দূর এগিয়েছে।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্ব অর্থনীতি আজ যেন এক অদৃশ্য দাবার ছকে সাজানো যেখানে প্রতিটি চালের পেছনে লুকিয়ে আছে কৌশল, ক্ষমতা, আর প্রযুক্তির সূক্ষ্ম রাজনীতি। একদা মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতিতে বাঁধা এই বৈশ্বিক বাজার এখন পরিণত হয়েছে দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব যেন নতুন বিশ্বায়নের ভাষা লিখছে।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া মার্কিন–চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। প্রথমে ছিল শুল্ক আরোপ, পরে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, আর এখন তা রূপ নিয়েছে প্রযুক্তি ও কৌশলগত প্রভাবের প্রতিযোগিতায়।
ওয়াশিংটন আজ চীনের প্রযুক্তি সাম্রাজ্যকে সীমিত করতে মরিয়া—বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।
অন্যদিকে বেইজিং, তার পাল্টা চাল হিসেবে, রেয়ার আর্থ মেটালের রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে—যে খনিজ পদার্থ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল, এমনকি যুদ্ধবিমানও অকেজো।
এই দ্বন্দ্বের জোয়ারে সবচেয়ে বড় রূপান্তর ঘটছে বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলে। দীর্ঘদিন ধরে চীন ছিল বিশ্বের কারখানা, কিন্তু এখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল অবলম্বন করছে। অর্থাৎ তারা উৎপাদন স্থাপন করছে চীনের পাশাপাশি অন্য দেশে, যাতে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে। ফলে বৈশ্বিক শিল্প মানচিত্রে উত্থান ঘটছে ভারত, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের মতো নতুন শক্তির।
বাংলাদেশের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ। পোশাকশিল্পের সাফল্য ইতিমধ্যেই বিশ্বে দেশের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে। এখন সময় এসেছে বৈচিত্র্যময় শিল্পে প্রবেশের ইলেকট্রনিক্স, হালকা প্রকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশকে দেখছেন স্থিতিশীল শ্রমবাজার, প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ব্যয় ও কৌশলগত অবস্থানের দেশ হিসেবে। প্রয়োজন কেবল সুদূরদর্শী নীতি, নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক পরিবেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল দুটি দেশের সংঘাত নয়; এটি নতুন অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্ম। সরবরাহ শৃঙ্খল এখন একক নয়, বহুস্তরীয়; বিশ্বায়ন আর একমুখী নয়, বরং হয়ে উঠছে অঞ্চলভিত্তিক। এই পরিবর্তনের ফলে উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি হবে অধিক স্থিতিশীল, এবং রাজনৈতিক নির্ভরতা কমবে।
তবে এই পুনর্গঠনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অনিশ্চয়তার ছায়া। কারণ, যখন প্রতিটি প্রযুক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয়, তখন উদ্ভাবন আর মানবিক উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্ব অর্থনীতি যেন এখন দ্বিধাবিভক্ত—একদিকে প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে পারস্পরিক নির্ভরতা।
তবু পরিবর্তন অনিবার্য। একবিংশ শতাব্দীর এই দশকে বিশ্ব অর্থনীতি নতুন ভাষা শিখছে যেখানে বাণিজ্য আর শুধু অর্থনৈতিক শক্তির প্রকাশ নয়, বরং ভূরাজনীতির হাতিয়ার। আর এই নতুন বাস্তবতায় প্রতিটি দেশ, প্রতিটি বাজার, এমনকি প্রতিটি কর্মশালাও হয়ে উঠছে সেই বৃহৎ দাবার ছকের একেকটি ঘুটি।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা তাই কোনো শেষ লড়াই নয়, এটি শুরু মাত্র—এক নতুন যুগের, যেখানে অর্থনীতি আর রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে বিশ্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।
তথ্যসূত্র: দি ইকোনমিস্ট, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, রয়টার্স, IMF

