Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

হাসিনার দণ্ড : ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে

Icon

মোহাম্মদ সফিউল্লাহ

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাসিনার দণ্ড : ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আরেক আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে ৫ বছরের লঘুদণ্ড। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যারা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট (উল্লেখযোগ্য পরিমাণ) আন্দোলনকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এছাড়া আহত আন্দোলনকারীদের আঘাতের মাত্রা ও ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে রায়ে। সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পরই তা কার্যকরের দাবি ওঠে।

শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে রয়েছেন। ভারত তাকে ফেরত দেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ আগেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। সে অনুযায়ী তাকে ফেরত চেয়ে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এতে কর্ণপাত করেনি ভারত। শেখ হাসিনাকে ফেরত পেতে আবারও একই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নাকি অপরাধী হিসাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, দুভাবেই চেষ্টা চলছে। তাকে ফেরত আনাটাই বড় বিষয়। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা হবে, সেটা এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। যেহেতু তিনি বাংলাদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, তাই আসামি হিসাবে ফেরত আনার সম্ভাবনাই বেশি।]

ভারতের সেনাপ্রধানের ক্রমাগত টেলিফোন ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। এটা সর্বজনবিদিত যে, ভারত নিজে বিমান না পঠিয়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিমান দিয়ে শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। জনতার রোষে হাসিনা সরকারের পতন হলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর ভারতের আঘাত হানার সমূহ আশঙ্কা এড়ানোর জন্য হাসিনার ইচ্ছা মোতাবেক সামরিক বিমানে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ভারত অপপ্রচার করছে, বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আদালতকে শেখ হাসিনা বিশ্বমানের আদালত বলে উল্লেখ করেছিলেন। ২০২৪ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এই আদালতই শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

হাসিনা নিজের ও দিল্লির ইচ্ছায় ভারতে আশ্রয়ে আছেন। তিনি এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বিগত পনের বছর তার শাসন আমলকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুদেশের সোনালি অধ্যায় বলে দাবি করেছেন। এই রায়ের পর ভারত অবশ্যই বিশ্বের কাছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং খুনের আসামিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর না করে আশ্রয় দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক সীমারেখা লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। ভারতের ওপর বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে।

ভারত শেখ হাসিনার সময়ে ২০১৩ সালে এবং এরপর ২০১৬ সালে দুদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি ইতোমধ্যেই অমান্য করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে অবিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেশী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। বন্দিবিনিময় চুক্তির অধীনে ইতোমধ্যে অনেক অপরাধীর বিনিময় হয়েছে। এর আওতায় শেখ হাসিনার বিনিময় সম্ভব। কিন্তু ভারত এর অপব্যাখ্যা করছে। এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে বন্দিবিনিময়কে বানচাল করার কৌশল অবলম্বন করছে।

বাংলাদেশিদের নিয়ে আস্থার সংকটে ভুগছে ভারত। তদুপরি আদালতের রায় অমান্য করে ভারত যদি বাংলাদেশের কাছে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর না করে, তাহলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তলানিতে নামার আশঙ্কা আছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দেবে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ভারতীয় মিডিয়া আদাজল খেয়ে মাঠে নামবে, অন্তত বিগত দিনের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।

শেখ হাসিনা ভারতের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘Strategic Asset’. ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাশনামলে বাংলাদেশের অতিগোপনীর সব তথ্য ভারতের হস্তগত হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।

সুতরাং শেখ হাসিনাকে এখন ভারত দাবার ঘুঁটি হিসাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক পত্র ভারতকে দিয়েছে। ভারত সেসব উপেক্ষা করে চলেছে। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত দাম্ভিক আচরণ। সুতরাং ‘Strategic Asset’-কে ভারতের হাতছাড়া করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

আগামীতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানোর লক্ষ্যে ভারত কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের দল আরএসএস/বিজেপি ভারতের রাজনীতির মাঠ দখলে নেয়। ২০০২ সালে তারা গুজরাটে ২০০০ মুসলিম নিধনের মাধ্যমে দিল্লির ক্ষমতা দখলের পথ করে নেয়। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় শাসক হিসাবে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। নির্বাচনের সময় এর মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশের জন্য এটি গভীর উদ্বেগের একটি বিষয়। প্রতিবেশী দেশে যদি মুসলিম নিধনযজ্ঞ চলে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে আরও ফাটল ধরবে।

মোহাম্মদ সফিউল্লাহ : সাবেক রাষ্ট্রদূত

rshafiullah@yahoo.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম