বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কিছু মানুষ আছেন—যাদের দেখে মনোজগতে বিশ্বাস জন্মায়, নেতৃত্ব শিখরে নয়, শিকড়ে। মানুষের ভিড়ের মাঝেই নেতৃত্বের আসল প্রকাশ ও বিকাশ।
তারেক রহমান এমনই একজন মানুষ। তাকে দেখার জন্য দূরবীন লাগে না, সাদা চোখেই চেনা যায়। তিনি শিকড়ে বসবাস করেন। তাই খুব সহজেই বোঝা যায়—তার ভেতরটা আলো না অন্ধকার। ইতিহাসের ঢেউ–বিক্ষুব্ধ নদীতে তারেক রহমান এক অনমনীয় পাঞ্জেরির নাম। তার জীবনের গল্প, লড়াই আর স্বপ্ন বয়ে চলেছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।
তারেক রহমানকে নিজের মতো করে খানিকটা তুলে ধরতে পারা মানে রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের অপার সম্ভাবনাকে নতুন করে খোদাই করা। একজন মানুষ কখনো কখনো খুব ছোট ছোট কাজে প্রকাশ পায়। তারেক রহমানকে যারা একটু কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন—রাজনীতিবিদ হলেও রাজনীতির টিপিক্যাল চাতুরী তার ভেতরে বাসা বাঁধেনি।
তারেক রহমানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০১৩ সালের ১৩ মে। আমার টকশো পছন্দ হওয়ায় তিনি ঘনিষ্ঠজনদের বলেছিলেন, ‘এদের মতো লোকদেরই দলের মুখপাত্র হওয়া উচিত।’ মাহিদ ভাই (মাহিদুর রহমান) টেলিফোনে আমাকে এ বার্তা পৌঁছে দেন। একই কারণে কল এসেছিলো সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারির কাছ থেকেও। সে ধারাবাহিকতাতেই একদিন আমার ডাক পড়ে কিংস্টনে।
দিনটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। হোটেলের লবিতে বসে প্রিয় নেতার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। লন্ডনে তখন শেষ বিকেলের আলো নিভে নিভু আর আমার বুকের ভেতরে অনিশ্চয়তার ঢেউ—নাম–না–জানা এক অস্থিরতা। মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক করছে—‘কীভাবে শুরু করব?’ কিছুক্ষণ পর তিনি এলেন—পরনে হালকা নীল ট্রাউজার এবং ইন করা চেক শার্ট। নিরাভরণ সাধারণ উপস্থিতি। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিলেন, ‘আমি তারেক রহমান।’ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অন্যতম কর্ণধার নিজের পরিচয় নিজ মুখে উচ্চারণ করছেন—আমি বিস্মিত ও অভিভূত।
কত হাজারবার তার নাম শুনেছি; টিভি–পত্রিকায় তাকে দেখেছি! তবু সে মুহূর্তে মনে হলো—একজন মানুষ আসছেন, ক্ষমতাধর কোনো নেতা নয়। সব অস্থিরতা–ভয় দূর হয়ে গেলো। আমরা সহজভাবে কথা বলতে শুরু করলাম।
এক যুগে তারেক রহমানকে দেখেছি অহং–আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করতে। জ্যাকেট–জুতা–পোশাক সবই সাধারণ। আমরা নিজেদের মাঝে কখনো কখনো মজা করে বলতাম, ‘ভাইয়ার একই জামা আর কতদিন?’ কিন্তু এমনটাই তারেক রহমান এবং তার পরিবার। ডা. জোবাইদা রহমান—বাংলাদেশের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান; ছিলেন ঢাকা মেডিকেলের সেরা ছাত্রী; ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের উচ্চতর ডিগ্রিধারী। অথচ চলন–বলনে, আচরণে নেই বিন্দুমাত্র আড়ম্বরতা। জাইমা রহমান—বিলেতের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার, জিয়া পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী। অথচ ক্রিকেট মাঠে তাকে দেখেছি মাশরাফির ছক্কায় লাফিয়ে উঠে ‘ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন!’ বলে চিৎকার করতে। তারেক রহমান গাছ ভালোবাসেন, বাগানে সবজি ফলান, বিড়ালের সঙ্গে খেলা করেন, দোকানে গিয়ে ছোলা–পেঁয়াজু–চা খান, কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প–খুনসুটি করেন, ঈদে–চাঁদে বাসায় ডেকে নেতাকর্মীদের মেহমানদারি করেন। লোক দেখানোর জন্য এসব করেন—তা কিন্তু নয়—এটাই তার স্বভাব। ফ্যাসিস্ট আমলে অনেক সময় দলীয় মিটিং বেশি রাতে গড়াতো। তিনি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে বেড়ে দিতেন। আমরা ছুটে গেলে স্নেহের সুরে ধমক দিতেন।
তারেক রহমানকে দেখলে উপলব্ধি করা যায়—সাদামাটা আড়ম্বরহীন জীবন কতটা আলোকিত হতে পারে। এ মানুষটি যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, তার আচরণে তা কখনো টের পাইনি। যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন—হলফ করে বলতে পারবেন, তারেক রহমান নিরহংকার। আগে সালাম দেওয়ার রীতি, বসার নম্রতা, নরম করে কথা বলা, শব্দ প্রয়োগে পরিমিতিবোধ—সবই সহজাত। জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং পিয়াস করিম এ কারণে তাকে সম্মান করতেন। তারেক রহমানের মাঝে আমি প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখেছি, কিন্তু কোথাও বিনয়ের ঘাটতি দেখিনি। তিনি কর্তৃত্বপরায়ণও নন। তার সরল বিশ্বাসের জায়গায় আছে মহান আল্লাহর প্রতি অঢেল আনুগত্য। ‘আপনি পদ দিয়েছেন’ বলে কেউ তাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে তার সরল উক্তি, ‘পদ আমি দেইনি, আল্লাহ দিয়েছেন।’
কদর্যতার বিপরীতে নীরবতার আভিজাত্য তারেক রহমান ও তার পরিবারকে ভিন্ন উচ্চতার মর্যাদা দিয়েছে। ২০২২ সালে ডাক্তার মুরাদের অশালীন আচরণে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। কিন্তু তারেক রহমান ছিলেন নীরব। নোংরামির জবাবে নোংরামি নয়—এটাই জিয়া পরিবারের স্থায়ী উত্তরাধিকার। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে–পরে তারেক রহমানকে কখনোই আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হিসেবে দেখিনি। একান্ত বৈঠকগুলোতেও সমালোচনা ও শত্রুতার বিপরীতে তিনি আমাদেরকে বলেন, ‘ধৈর্য ধরুন, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার চর্চা করুন।’
তারেক রহমানকে নিয়ে সহজেই আলোচনা–সমালোচনা করা যায়। কারণ তিনি সাধারণ মানুষের মাঝেই প্রস্ফুটিত। তার আলাদা কোনো জগত নেই। তিনি বাসে চড়েছিলেন—সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। বাসে ওঠা কি সাজানো? তিনি কি অভিনয় করেছেন? প্রশ্ন আর প্রশ্ন। ডেভিড ক্যামেরন ট্রেনে উঠে বই পড়লে, কমিউটারদের সঙ্গে কথা বললে আমরা উচ্ছ্বসিত হই। কিন্তু তারেক রহমান একই কাজ করায় আমরা হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে পড়ি—‘ছবি কে তুলল?’ ‘পরিকল্পিত নাকি?’ ‘তার নিরাপত্তা কে দেখবে?’ ঘটনা হলো—পশ্চিমের কোনো নেতা যখন ট্রাম বা বাসে ওঠেন, আমরা বাহবা দিই; আর তারেক রহমান করলে হইচই। উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটময় সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চড়ে সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, ‘There cannot be any negotiated peace.’ আমরা মুখে বলি, নেতা মানুষের কাছাকাছি আসুক; কিন্তু তারেক রহমান যখন ইস্ট লন্ডনে এসে ছোলা–পেঁয়াজু–সিঙারা খান, তখন আমরা হৈ–হৈ করে উঠি। নিরাপত্তা, রাজনীতি, উদ্দেশ্য—সবকিছু নিয়ে কচলানি শুরু করি। আসলে আমরা কিছুতেই খুশি হই না। খুঁত ধরতে ছুতো ধরি—এটা আমাদের অভ্যাস। কিন্তু তারেক রহমান যা, তা–ই; ভেতরে–বাইরে এক। আমি তার ভেতরে কপটতা পাইনি।
তারেক রহমানও দোষে–গুণে মানুষ—ফেরেশতা নন। এটা তার চেয়ে বেশি কেউ উপলব্ধি করে না। কিন্তু কিছু গুণ তাকে মহিমান্বিত করেছে। তেলতেলে তোষামোদ তিনি পছন্দ করেন না। প্রথম সাক্ষাতের দিন তাকে বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশের কোটি মানুষ আপনার অপেক্ষায়।’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনিও সবার মতো শুরু করলেন।’ আবার অন্তরে তিনি একজন নরম মানুষ। মানবতার জন্য বিএনপি অফিসিয়ালি এখন যা করছে, তারেক রহমান বহু বছর যাবত জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বা নিজে ব্যক্তিগতভাবে তা করে চলেছেন কোনো রকম প্রচার–প্রচারণা ছাড়াই। অসহায়, বিপদগ্রস্ত মানুষ এবং গুম–খুন–নিপীড়নের শিকার পরিবারগুলোর পাশে তাকে আমি দেখেছি—তার অনুপ্রেরণায় কাজ করছি—পরিচয়ের শুরু থেকেই।
ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু ক্ষমতার লোভ তারেক রহমানকে পাকড়াও করতে পারেনি। মসনদের চেয়ে মানবতাকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন সবসময়। রাজনীতি তার কাছে ক্ষমতার চকচকে দরজা নয়; বরং দেশ ও মানুষের প্রতি অনিবার্য দায়বদ্ধতা। ২০১৪ সালের নির্বাচন–পূর্ব হত্যাযজ্ঞের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে তখন তাকে বলতে শুনেছি, ‘নির্বাচন–ক্ষমতা যখন হয় হবে, আগে আমার মানুষদের বাঁচান।’ তিনি একজন মানবদরদী রাজনীতিবিদ। দেশের মানুষকে গুম–খুন–নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিয়েছেন বারবার। অসংখ্য মিটিংয়ে আমি নিজে তার সঙ্গী ছিলাম। দেশপ্রেম তার রক্তে। চরম দুর্দিনে আমরা হতাশ হয়ে পড়তাম। দ্রুত রেজিমের পতনের জন্য বিদেশীদের সঙ্গে চুক্তি করার পরামর্শ আসতো। ম্লান হেসে তিনি বলতেন, ‘দেশের ক্ষতি মেনে নিতে পারলে কত আগেই ক্ষমতায় যেতাম। এত কষ্ট করতে হতো না।’ নির্বাসনের অতল যন্ত্রণা তাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
রাজনীতি তপস্যার জায়গা নয়—এখানে ঠেলাঠেলি, কূটকৌশল, সংঘাত আছে। তবুও মানুষ নেতৃত্বের ভেতরে মানবিকতার আলো খোঁজে। একদিন ওয়েস্টমিনিস্টারে মিটিং শেষে নেতার সাথে আমরা কয়েকজন টেমসের পাড়ে ম্যাকডোনাল্ডসে বসেছিলাম লাঞ্চ করতে। সে মুহূর্তটায় মনে হয়েছিল—গাড়ি, পোশাক, নিরাপত্তার বাহারে নেতৃত্ব বড় হয় না; প্রকৃত নেতৃত্ব মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহস ও সদিচ্ছা। তারেক রহমানের তা আছে। ক্ষমতার জলাশয়ে সাঁতারের নাম রাজনীতি নয়। রাজনীতি মানুষের দুঃখ–কষ্টের সাথে হাঁটার এক দীর্ঘ যাত্রা। তারেক রহমানকে আমি সে পথেই হাঁটতে দেখছি।
তারেক রহমানের মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি একজন মানুষ—সাধারণতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ একজন মানুষ। বাকিরা দেখুক রাজনীতি। আমি দেখেছি একজন মানুষকে, যিনি আমাদের স্বপ্ন–আশা–সংগ্রামকে রক্ষা করে চলেছেন। মানবিক এ মানুষটির নেতৃত্বেই বিনির্মিত হোক আগামীর বাংলাদেশ।
লেখক : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যনের মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা
