Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জলপাই গাছে ফিলিস্তিনি সত্তার শিকড়

Icon

মোহাম্মদ হাসান শরীফ

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জলপাই গাছে ফিলিস্তিনি সত্তার শিকড়

জলপাই গাছ। তবে এটি কেবলই একটি গাছ নয়, ফিলিস্তিনিদের কাছে অস্তিত্বের প্রতীক, তাদের হাজার বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এ জলপাই বাগানগুলো তাদের ভূমি, সংস্কৃতি এবং জীবন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তারা মনে করে, জলপাই গাছ যতদিন টিকে থাকবে, তারাও টিকে থাকবে। জলপাই গাছ আর তাদের অস্তিত্ব একাকার হয়ে আছে। ইসরাইলিরাও তা জানে। এ কারণে জলপাই গাছ তাদের অন্যতম শিকার। যতবারই তারা হামলার শিকার হয়, ততবারই ফিলিস্তিনিরা নতুন গাছ লাগিয়ে জবাব দেয়।

জলপাই গাছের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। হাজার হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে এটি শুরু হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিকরা জলপাইয়ের শাখাকে শান্তির প্রতীক হিসাবে গণ্য করত। এমনকি প্রাচীন অলিম্পিক্সে জলপাই শাখার মুকুট দেওয়া হতো। আবার জলপাই হলো ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি সংগৃহীত ফসল। ফিলিস্তিনে জলপাই খাদ্য, প্রসাধনী, সাবান, ওষুধ ও জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, আর জলপাই গাছের কাঠ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিলিস্তিনে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত চলা চারশ বছরের উসমানিয়া শাসনামলে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল, যা জলপাই বাণিজ্যকে একটি অপরিহার্য রপ্তানি পণ্যে পরিণত করেছিল। বর্তমানে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক কৃষিজমি জলপাই চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি পরিবার সরাসরি জলপাই ফলন এবং তেল উৎপাদন থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এ ফসল তাদের আয়ের প্রধান উৎস, বিশেষ করে পশ্চিম তীর ও গাজার মতো অঞ্চলে, যেখানে অর্থনৈতিক অবরোধ জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।

প্যালেস্টাইন ট্রেড সেন্টারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ফিলিস্তিনের প্রতি কিলোগ্রামে সবচেয়ে মূল্যবান ফসল হিসাবে জলপাইয়ের মৌসুমি রপ্তানি একটি ভালো বছরে ফিলিস্তিনি অর্থনীতিতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার যোগ করে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ১,০০,০০০ পরিবার জলপাই সংগ্রহ থেকে আয়ের ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ কর্মরত মহিলা। জলপাই গাছকে প্রায়ই সুমুদের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়, যা দৈনন্দিন স্থিতিস্থাপকতা এবং অধ্যবসায়ের বলে ফিলিস্তিনিদের ধারণা। এ কারণেই সম্প্রতি গাজাগামী সাহায্য বহরের নাম দেওয়া হয়েছিল সুমুদ।

একজন ফিলিস্তিনি কৃষক যখন তার বাগানে কাজ করেন, তখন তা কেবল চাষাবাদ থাকে না; এটি হয়ে ওঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা মাটির প্রতি ভালোবাসার একটি পবিত্র কাজ। তারা বিশ্বাস করে, প্রতিটি জলপাই গাছ তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন করে। এ জমি যে তাদের, সে কথাও মনে করিয়ে দেয় জলপাই গাছ।

জলপাই গাছ রোপণ যদি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের প্রতীক হয়, তবে ইসরাইলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে জলপাই গাছ কেটে ফেলা বা পুড়িয়ে দেওয়া হলো এ অস্তিত্বকে মুছে ফেলার এক কৌশলগত চেষ্টা। কাজটি তারা এখন করছে, তা নয়। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় থেকেই জলপাই বাগানসহ ফিলিস্তিনি কৃষি খাত জায়নবাদী বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের শিকার হয়েছে। নির্মমভাবে তারা জলপাই গাছ উচ্ছেদে নেমেছে।

ফিলিস্তিনের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার জলপাই গাছ ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে ফেলা হয়েছে বা বুলডোজার দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় বসতি স্থাপনকারীদের হাতে সংঘটিত ৭৫৭টি আক্রমণ লিপিবদ্ধ করেছে। এসব আক্রমণকালে ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, জলপাই বাগান ধ্বংস করা হয়েছে এবং ফসল নষ্ট করা হয়েছে। আর গাজায় যেখানে একসময় নিজস্ব জলপাই শিল্প ছিল, ইসরাইলের দুই বছরের অভিযানে সেখানে প্রায় সব কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে ৬৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

বর্তমানে পশ্চিম তীরে ১৫০টি বসতি এবং ২০০টি আউটপোস্টে আনুমানিক ৭ লাখ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী বাস করছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে উভয় ধরনের বসতিই অবৈধ, এবং ইসরাইলি আইন অনুসারে অননুমোদিত আউটপোস্টগুলো নিষিদ্ধ হলেও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে সেগুলোকে দায়মুক্তি দিয়ে থাকে। এসব বসতি স্থাপনকারীই সবচেয়ে বেশি হামলা করে জলপাই বাগানে।

জলপাই সংগ্রহের সময় (সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর) ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আসে। এটি আনন্দের সময়। এ সময় পুরো পরিবার একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু একইসঙ্গে এটি চরম বিপদেরও সময়। বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই এ সময় কৃষকদের ওপর হামলা করে, তাদের বাগানে প্রবেশে বাধা দেয় বা তাদের সংগ্রহ করা ফল নিয়ে যায়।

নতুন ইসরাইলি বসতি স্থাপন বা বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণের পথ তৈরি করার জন্য ফিলিস্তিনিদের বাগানগুলো ধ্বংস করা হয়। একটি গাছ উপড়ে ফেললে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সেই জমির মালিকানা দাবি করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া কৃষকদের আয়ের উৎস নষ্ট করে দেওয়ায় তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জীবনধারণের জন্য অন্য কোথাও যেতে বাধ্য হয়। তবে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করা হলো ইসরাইলিদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। গাছ ধ্বংসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করা হয়, যা তাদের ইচ্ছাশক্তি ও মনোবলে আঘাত করে। ফিলিস্তিনিরাও এই লড়াইয়ে হারতে নারাজ।

এ কারণেই এক কৃষককে বলতে শোনা যায় : ‘যখন তারা আমার ২৫ বছরের পুরোনো জলপাই গাছটি কেটে ফেলে, তখন মনে হয় যেন আমার নিজের সন্তানকে হত্যা করা হলো। এ গাছ আমার জীবন, আমার ইতিহাস, আর আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ।’

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা প্রায়ই কৃষকদের সঙ্গে সংগ্রাহক হিসাবে যোগ দেন, শুধু সাহায্যের জন্য নয়, বরং তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে হামলাকারীদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য। এ সংহতি জলপাই বাগানকে পরিণত করেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও টিকে থাকার এক মূর্ত প্রতীক হিসাবে।

জলপাই বাগানগুলো তাই কেবল একটি কৃষিভূমি নয়-এটি ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয়, তাদের অধিকারের দাবি এবং তাদের হারানো স্বদেশের প্রতি গভীরতম ভালোবাসার স্মারক। প্রতিটি নতুন রোপিত চারাগাছ তাদের দৃঢ় প্রত্যয়কে ঘোষণা করে-‘আমরা এই ভূমিতেই ছিলাম, আছি এবং থাকব।’

জলপাই গাছের শিকড়েই ফিলিস্তিনি কৃষক তার আত্মার স্পন্দন অনুভব করে। যতদিন জলপাই গাছ থাকবে, ততদিন ফিলিস্তিনিরাও টিকে থাকবে।

মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম