হালফিল বয়ান
গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা
ড. মাহফুজ পারভেজ
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে এক সময় এন্তার আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ষাট ও সত্তরের দশকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। বাঘা বাঘা পণ্ডিত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যাদের মধ্যে রয়েছেন ফাইনার, হান্টিংটন; এ ইস্যুর পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর মতামত দিয়েছেন। পরিস্থিতি এখন আর সেই জায়গায় নেই; বরং বাংলাদেশসহ বহু দেশের সামরিক বাহিনী বর্তমানে ব্লু হেলমেট মাথায় দিয়ে বিশ্বশান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিতব্য আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী ভূমিকা বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে হয় না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর ও আনন্দময় করে তুলতে সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড ও স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) অডিটরিয়ামে আয়োজিত কোর্স-২০২৫ গ্র্যাজুয়েশন সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন। তাছাড়া, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে ‘মব ভায়োলেন্স’ থেকে সরে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই দিন গুলশানে লেকশোরে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপি শীর্ষক সংকলিত গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
এ কথা সর্বজনবিদিত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশের বাস্তবতায় নির্বাচনের মৌসুম শুরু থেকে ভোটের আগে-পরে পর্যন্ত সময়কাল নির্বাচনি সন্ত্রাসে ভরপুর থাকে। এ কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে সব নির্বাচনেই সেনাবাহিনীর ভূমিকা দেখা গেছে। বিশেষত, নির্বাচনি সন্ত্রাস রোধে এবং সামগ্রিক শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে অতীতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। এ রেওয়াজ ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে সর্বশেষ নির্বাচন পর্যন্ত লক্ষণীয়। নির্বাচনে লাগাতার এমন দৃষ্টান্তের কারণ হলো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী একটি আস্থার প্রতীক। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মাঠপর্যায়ের উত্তেজনা বিবেচনায় সেনাবাহিনী সব সময়ই জনসাধারণের কাছে একটি নিরপেক্ষ, শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং সক্ষম বাহিনী হিসাবে আদরণীয়। কারণ, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ভোটারদের নিরাপত্তাগত অনুভূতি ও আস্থা বাড়ায়, নির্বাচনি সহিংসতার আশঙ্কা কমায়, নির্বাচনি প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রতি জনআস্থা বৃদ্ধি করে। ফলে সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষামূলক ভূমিকা একটি স্ট্যাবিলাইজিং ফোর্স হিসাবে কাজ করে।
বাস্তবতা বিবেচনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় এক লাখেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ভোটের দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানা গেছে। খোদ নির্বাচন কমিশন এ কারণে এরই মধ্যে নির্বাচনি আইনে সংস্কার করে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করেছে। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। যে কারণে নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের একটি বৈঠকে আগামী নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে; যে ক্ষমতা বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে দেওয়া আছে।
জুলাই আন্দোলনে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এক মাসের মাথায় (গত বছরের সেপ্টেম্বরে) সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর কয়েক দফায় সেই ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত এ বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সারা দেশে দায়িত্ব পালন করছে সেনাবাহিনী। সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭টি ধারায় সেনা কর্মকর্তারা তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তল্লাশি, অভিযান, সন্দেহভাজনদের আটক করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু কাউকে গ্রেফতার দেখানো, সাজা দেওয়া বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালানোর মতো নির্দেশ দিতে বিচারিক ক্ষমতা থাকতে হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির এসব ধারা অনুযায়ী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়ায় এখন থেকে সেনা কর্মকর্তাদের সামনে কোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের সরাসরি গ্রেফতার করতে পারবেন, দিতে পারবেন কারাদণ্ড বা জামিনও। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সাধারণত কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা নেই; কিন্তু যখন সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা থাকে তখন শুধু আটকই নয়, তাৎক্ষণিক বিচার করে এক মাসের জন্য জেলেও পাঠাতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার হয়। যদি এ বিচারিক ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে না থাকে, তাহলে তখন স্থানীয় প্রশাসনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
জুলাই-পরবর্তী বর্তমান জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও নাজুক আইনশৃঙ্খলার পটভূমিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। বিশেষত, জুলাই-পরবর্তী সময়ে ‘মব ভায়োলেন্স’, অস্থিরতা, হঠাৎ সংঘাত সৃষ্টি-এসব থেকে দেশকে উত্তরণের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী এখন একটি প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত এ কারণেই নির্বাচনি আইনে সংস্কারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে; যা একটি নীতিগত অগ্রগতি। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। যে কারণে নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্বাচনি আইনে পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তা স্বচ্ছতা ও নীতিকাঠামোকে সুদৃঢ় করেছে। এখন আর আলাদা আদেশ ছাড়াই সেনাবাহিনী নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করতে পারবে। দায়িত্বের সীমা, আইনি কাঠামো ও জবাবদিহিতা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এর ফলে আগে নির্বাচনকালীন কখনো কখনো যেসব ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা’ নিতে হতো, এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এটি নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, বাস্তববাদী ও সময়োপযোগী করেছে। বাংলাদেশের মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল, জনঘনত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত সমাজে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ সমাবেশ ভাঙন, অস্ত্র জব্দ, অস্থিরতা প্রতিরোধ, এসব ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। বিচারিক ক্ষমতা সেনাবাহিনীকে বিশেষ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম করে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।
তাছাড়া ‘In Aid to Civil Power’ নীতির অধীনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হবে গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তিস্বরূপ। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করে বলেছে, সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের সহায়ক বাহিনী হিসাবেই দায়িত্ব পালন করবে। এর অর্থ, সেনাবাহিনী নির্বাচন পরিচালনা করবে না, বরং নির্বাচনি পরিবেশ নিরাপদ রাখবে। মূলত বেসামরিক প্রশাসনই নির্বাচনের মূল নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এতে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ মসৃণ ও বিঘ্নহীন হবে। বলে রাখা দরকার, এ মডেলটি ভারত, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশে ব্যবহৃত হয়।
সামগ্রিকভাবে, সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। যেহেতু, একটি স্থিতিশীল নির্বাচন একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র ও একটি মজবুত রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেহেতু সেই নির্বাচনকে নিরাপদ, স্বচ্ছ, অবিতর্কিত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করা অতীব প্রয়োজন। আর এজন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাস্তব কারণেই সব মহলের কাছে কাক্সিক্ষত।
অতএব নির্বাচন, এ অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক আস্থা ও জননিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ও ইতিবাচক একটি উপাদান, যা সরকারের স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত, নির্বাচন কমিশনের সমন্বিত ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা-এ তিনটির ঐকমত্যভিত্তিক নীতিগত সম্মিলনের মাধ্যমে ফলপ্রসূ হতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করবে।
বিগত বছরগুলোতে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈর-মনোভাবাপন্ন দলীয় একনায়কতন্ত্রের রূঢ় অভিজ্ঞতার তিক্ততা থেকে এ কথা সবারই মনে রাখা দরকার, নির্বাচন যদি দখল, জালিয়াতি বা রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে তা আর গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো থাকে না, বরং ক্ষমতা দখলের যন্ত্রে পরিণত হয়, যে যন্ত্র ফ্যাসিবাদ ও একনায়কের জন্মদাতা রূপে আবির্ভূত হতে পারে। এমন বিতর্কিত নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। তাছাড়া, গণতন্ত্র ও নির্বাচন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে অত্যন্ত জটিল, ভঙ্গুর ও বহুস্তরীয়। এ অবস্থায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈধ উৎস ও জনসমর্থনভিত্তিক কাঠামো শক্তিশালী করা সবার জাতীয় দায়িত্বের অংশ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থা হিসাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, এটাই সবার কাছে কাম্য ও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
উপরন্তু, সত্য স্বীকার করলে বলতে হয়, যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সেনাবাহিনী’-এ তিন উপাদান-সংস্থা পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্পৃক্ত। তাছাড়া, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশ এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রশাসনিক সংস্কার, সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক জাগরণ ও প্রত্যাশা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনি ব্যবস্থা একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করেছে। এ অবস্থায়, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্ত রাজনৈতিক পরিসরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ civil-military সম্পর্ক বাংলাদেশকে স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক গভীরতার নতুন পথে নিয়ে যাবে বলে সবাই আশা করছে।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)
