সাক্ষাৎকার
ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবিলায় আধুনিক সরঞ্জাম জরুরি: ড. সারওয়ার জাহান
মোহাম্মদ কবীর আহমদ
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ড. সারওয়ার জাহান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। ২০১৭ সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন এবং সেন্টার ফর রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় আরবানা-চ্যাম্পেইন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা গবেষণা ও পরামর্শদানে তার ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার ৪০টিরও বেশি গবেষণামূলক প্রকাশনা রয়েছে। তিনি নগর পরিকল্পনা সম্পর্কিত দুটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন; বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত একটি গ্রন্থের সহ-লেখক। বর্তমানে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে তিনি যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ কবীর আহমদ
যুগান্তর : কয়েকদিন আগে দেশে যে ভূমিকম্প (রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭, আবার কারও মতে ৬ মাত্রার) হলো, এর তীব্রতা ছিল স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। এ ঘটনায় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে বসবাসকারীরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আরও বড় ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখাতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
ড. সারওয়ার জাহান : আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। তাই ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। রাজধানীসহ সারা দেশে যথাযথ নিয়ম না মেনে অনেক ভবন তৈরি করা হয়েছে। সেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কাঠামো রাতারাতি পরিবর্তন করা না গেলেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (রেট্রোফিটিং) অবলম্বন করে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এসব কথা আমরা বহুদিন বললেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে-এমন দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান নয়। বরং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য মানুষ গোপন করার চেষ্টা করে থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উচিত এসব ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া। সারা দেশে প্রতিটি ভবন যাতে যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য জোরালো মনিটর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন কি না, এজন্যও জোরালো মনিটরিং প্রয়োজন। নিয়ম না মেনে কেউ ভবন তৈরি করছে-এমন তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ আইনের আওতায় আনতে হবে।
যুগান্তর : কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১২৫ বছর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। অতীতে এ অঞ্চলে তীব্র মাত্রার যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, তেমন ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের কী ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
সারওয়ার জাহান : যে কোনো সময় তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিয়েই আমাদের নগর পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে?
সারওয়ার জাহান : বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্ট হয় যে, তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে অনেক ভবন ধসে পড়তে পারে; গ্যাসলাইন থেকে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে; বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমন আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে, যার কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষের হতাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
যুগান্তর : তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে?
সারওয়ার জাহান : তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগে থেকেই জোরালো প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দলও গড়ে তুলতে হবে। রাজধানীতে খালি জায়গার সংকট তীব্র। অনেক জায়গায় দুই ভবনের মাঝে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব রয়েছে। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে ভবনে আটকে পড়া মানুষকে দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করা এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে দিতে পারে। যেসব এলাকায় সড়ক সরু, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। সরু সড়কের কারণে আরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। মনে রাখা দরকার, তখন ফায়ার সার্ভিসের ভবনও ভেঙে যেতে পারে। সে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও কর্মী তৈরি করতে হবে। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই ভবনে আটকে পড়া মানুষকে দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করার জন্য বিকল্প পথে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানীতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক খাল খনন করা দরকার। একসময় রাজধানীতে অনেক খাল ছিল, সেসব উদ্ধার করতে হবে; পাশাপাশি নতুন করে আরও খাল খনন করতে হবে। আকাশপথেও যাতে জোরালো উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : আপনি বলছিলেন, তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে গ্যাসলাইন থেকে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করণীয়?
সারওয়ার জাহান : এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। সাধারণভাবে বলা যায়, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অনেক মানুষ আহত হবে। আমাদের দেশে আগুন নেভানোর কাজে পানির সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের হাসপাতাল ভবনগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে আশপাশের অন্য ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হাসপাতালের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আগাম পদক্ষেপ নেওয়া হলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব।
যুগান্তর : কী ধরনের আগাম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
সারওয়ার জাহান : তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে সম্ভাব্য যে পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করে নিয়মিত মহড়া দিতে হবে। রাজধানীসহ সারা দেশে যথাযথ নিয়ম না মেনে তৈরি করা ভবনগুলো কম মাত্রার ভূমিকম্পেও ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর যে ধরনের উদ্ধার তৎপরতা দেখেছি, তাতে আমাদের কর্তৃপক্ষগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেয়েছি। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীতে একসঙ্গে অনেক ভবন ধসে পড়লে পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে আগে থেকেই ভাবতে হবে।
যুগান্তর : ১৯৫৯ সালে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা ছিল ঢাকার ১৫ লাখ মানুষের জন্য। ১৯৭৪ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ২০ লাখের মতো; ১৯৮০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ। বর্তমানে এ মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় নগর পরিকল্পনা যথাযথভাবে হয়েছে কি?
সারওয়ার জাহান : সেই ১৯৫৯ সালে ১৫ লাখ লোকের জন্য ঢাকায় যে নগর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বলা যায় প্রায় সেই পরিকল্পনা দিয়েই এখনো চলছে। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন চাহিদা তৈরি হয়। সে চাহিদা পূরণ না করলে তার নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তেমনই একটি শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর বিভিন্ন রকমের চাহিদা তৈরি হয়। সেসব চাহিদা পূরণ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ধীরে ধীরে নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকায় নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে।
যুগান্তর : মাটির গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতে পারে?
সারওয়ার জাহান : ঢাকার অনেক এলাকা নরম মাটির ওপর গড়ে উঠেছে। সেসব এলাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই ঢাকার যেসব এলাকার মাটি তুলনামূলক নরম, সেসব এলাকার স্থাপনার সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : ভূমিকম্পের কথা উঠলে দেশের ছোট-বড় অন্যান্য শহরের ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গটি আসে।
সারওয়ার জাহান : ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের ছোট-বড় সব শহরের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আগাম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
যুগান্তর : ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অসহায়ত্ব তীব্র হয়।
সারওয়ার জাহান : তখন শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই নন, সিনিয়র সিটিজেনদের অসহায়ত্বও তীব্র হয়। কাজেই সব ধরনের চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকেও হিমশিম খেতে হয়।
সারওয়ার জাহান : তা ঠিক। সেসব তথ্য বিবেচনায় নিয়ে ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
যুগান্তর : এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কী কী বিষয়ে গুরুত্ব বাড়াতে হবে?
সারওয়ার জাহান : প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রাজধানীমুখী জনস্রোত বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজধানীমুখী জনস্রোত বন্ধ করা সম্ভব না হলে আগামী দিনে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় নানা সংকট দেখা দেবে। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে।
যুগান্তর : প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব কী?
সারওয়ার জাহান : অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে কী সমস্যা সৃষ্টি হয়, তা আমরা জানি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বহু দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। সিঙ্গাপুরে পুরো শহরটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যে কোনো শহরে সফলভাবে পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন করা বেশ কঠিন। সিঙ্গাপুরের একেকটি এলাকায় নগরীর বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠক হয়েছে। স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে তারপর সেখানে পরিকল্পিত উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করা হয়। কুয়ালালামপুরেও সফলভাবে পুনর্নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। বস্তুত এমন আরও বহু দেশে সফলভাবে শহর পুনর্নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। আমাদেরও উচিত সেসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পুরান ঢাকার অতি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় পুনর্নির্মাণকাজ শুরু করা। এটি করতে দেরি হলে পুরান ঢাকায় যে কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা কঠিন হতে পারে। অন্যান্য শহরেও অতি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় পুনর্নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
যুগান্তর : প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে কী করণীয়?
সারওয়ার জাহান : যদি কোনো কারণে শহরে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়, তাহলে দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য প্রস্তুতি রাখতে হয়। এক্ষেত্রে কোনোরকম ঘাটতি থাকলে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে পানির ভূমিকা অপরিহার্য। সেজন্য সব আধুনিক শহরের সর্বত্রই বিদ্যমান পানির লাইনের পাশাপাশি শুধু আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের একটি পানির লাইন তৈরি করা দরকার। সেই লাইনে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। আগুনের ধরন বুঝে পানির পাশাপাশি অন্যান্য উপকরণের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
যুগান্তর : লক্ষ করা যায়, অবৈধ বিদ্যুতের লাইন, অবৈধ গ্যাসলাইনের কারণেও বহু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
সারওয়ার জাহান : শহরে অবৈধ বৈদ্যুতের লাইন, অবৈধ গ্যাসলাইনের বিষয়ে জোরালো অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। মানহীন কেবলের কারণেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। কাজেই ভবনে বা কোনো মার্কেটে যাতে কেউ মানহীন কেবল ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। সারা দেশে এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। এক্ষেত্রে সিলিন্ডার বিপণন, বিশেষত পরিবহণে যেন যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
যুগান্তর : প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ সতর্কতামূলক কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
সারওয়ার জাহান : শহরের সব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে মানুষকে সরাতে হবে। ভবন নির্মাণে যথাযথ নিয়ম মানা এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকাই যথেষ্ট নয়। কয়েক বছর আগে গুলশানের বহুতল এক ভবনে আগুন লাগার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কসংকেত বেজে উঠেছিল; কিন্তু অনেকেই তা আমলে নেয়নি। এছাড়া যারা অ্যালার্ম শুনে ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বের হয়েছিলেন, তাদের অনেকে জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার করেননি। বস্তুত যথাযথ সচেতনতা ও সতর্কতার অভাবে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যেতে পারে।
যুগান্তর : তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পসহ বড় কোনো দুর্যোগে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব আছে দেশে, এ বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। এ সীমাবদ্ধতা কাটাতে কী করণীয়?
সারওয়ার জাহান : তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প বা বড় কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন, সেসব ক্রয় করতে প্রচুর অর্থের দরকার। দুর্যোগ মোকাবিলায় আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে। সেসব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেসব সরঞ্জাম চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে। বড় কোনো দুর্যোগে বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধারকারী দল আসবে। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তর্দেশীয় জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।
যুগান্তর : যে কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে কী করণীয়?
সারওয়ার জাহান : যেসব দেশে ঘনঘন ভূমিকম্প হয়, সেসব দেশের মানুষ ভূমিকম্পের সঙ্গে মানিয়ে চলার কৌশল শিখেছে। সেসব দৃষ্টান্ত থেকে আমাদেরও শিক্ষা নিতে হবে। তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলায় ভূমিকম্প সহনীয় টেকসই ভবন নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। বস্তুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব।
যুগান্তর : সফলভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় এককথায় আপনার পরামর্শ কী?
সারওয়ার জাহান : কোনো দুর্যোগের পর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যেভাবে ব্যাপক পরিসরে কাজ শুরু করে, সেসব তৎপরতায় যেন ভাটা না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক হলো, কোনো দুর্যোগের পরপর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যেভাবে কাজ করার কথা বলে-পরে কাজের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় না। এককথায় যদি বলি-কেমিক্যাল গোডাউনের মতো বিপজ্জনক উপাদান আবাসিক এলাকা থেকে দূরে সরানো না হলে নিরাপদ নগরীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
সারওয়ার জাহান : ধন্যবাদ।
