Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

তরুণ প্রার্থী-ভোটারই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি

সাইদুল ইসলাম

সাইদুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:১৭ পিএম

তরুণ প্রার্থী-ভোটারই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি

ছবি: যুগান্তর

বিশ্ব রাজনীতি আজ এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। নেতৃত্বের ধরণ, দলীয় কাঠামো, ভোটার আচরণ, রাজনৈতিক ভাষা, সব ক্ষেত্রেই তরুণদের প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, সমসাময়িক বিশ্বায়ন, পরিবেশগত সংকট এবং অর্থনীতির নতুন বাস্তবতা, এসব মিলিয়ে আজকের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি সম্পর্কে আগের প্রজন্মের মতো চিন্তা করে না। তাদের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক মানসিকতা এবং নেতার প্রতি চাহিদা সবই বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান এখন একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা, যা বাংলাদেশেও শক্তিশালী প্রভাব ফেলছে।

দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তরুণ নেতারা শুধু নেতৃত্বেই আসছেন না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মৌলিকভাবে বদলে দিচ্ছেন। চিলির গ্যাব্রিয়েল বোরিক ৩৫ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়ে দেখিয়েছেন, ছাত্র আন্দোলন, যুব সংগঠন বা তৃণমূল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে পৌঁছানোর পথ তৈরি করতে পারে। ফিনল্যান্ডের সান্না মারিন ৩৪ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মহামারি, অর্থনীতি ও সামাজিক কল্যাণ, সবখানে এক নতুন মানবিক ও আধুনিক নেতৃত্বের উদাহরণ তৈরি করেন। ফ্রান্সে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রচলিত দুই বড় রাজনৈতিক শক্তিকে পাশ কাটিয়ে ৩৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং প্রমাণ করেন, তরুণ নেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক পথ নির্মাণ করতে সক্ষম। একইভাবে জেসিন্ডা আরডার্ন ৩৭ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংকটে সহমর্মী নেতৃত্ব দিতে পারেন, নাইব বুকেলে এল সালভাদরে প্রযুক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা গড়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হন। এসব উদাহরণ কেবল নেতৃত্বের বয়স কমার গল্প নয়; বরং বিশ্ব রাজনীতিতে তরুণ দৃষ্টিভঙ্গির বৈপ্লবিক প্রভাবের প্রমাণ। 

তরুণ নেতৃত্বের প্রতি এই বৈশ্বিক আস্থা বাড়ার পেছনে রয়েছে কিছু মৌলিক কারণ। আজকের রাজনীতি তথ্য, প্রযুক্তি, ডেটা এবং বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তরুণদের মধ্যে রয়েছে স্বাভাবিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। তারা বৈশ্বিক রাজনীতিকে সমসাময়িকভাবে বোঝে, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে এবং স্থানীয় সমস্যার আধুনিক সমাধান খুঁজে পায়। তাছাড়া তরুণদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবিকতার প্রতি একটি প্রাকৃতিক আকর্ষণ থাকে, যা এখনকার ভোটার প্রত্যাশার সঙ্গেও মিল রেখেছে। ফলে বিশ্ববাসী বুঝতে শুরু করেছে, যেখানে তরুণরা নেতৃত্ব দেয়, সেখানে রাজনীতি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, গতিশীল এবং উদ্ভাবনী হয়ে ওঠে।

রাজনীতিতে এই পরিবর্তন শুধু নেতৃত্বে নয়, ভোটার আচরণেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের রাজনৈতিক মানসিকতা এখন পুরোনো ধারার সাথে একেবারেই মিলছে না। তারা প্রচলিত শক্তি প্রদর্শন, বিভাজনমূলক ভাষা, সহিংসতা বা টাকার প্রভাবমুখী রাজনীতি দেখে ক্লান্ত। নির্বাচনের সময় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, অযথা শক্তির প্রদর্শনী, পোস্টারের বন্যা, কিংবা বিপুল টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন, এসবকে তারা রাজনৈতিক অদক্ষতা ও অপচয়ের প্রতীক মনে করে। তরুণদের কাছে রাজনীতি মানে সমস্যা সমাধান, নতুন চিন্তা, ডিজিটাল প্রচারণা, আধুনিক নীতি এবং বাস্তব প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। তারা দল নয়, ইস্যু-কেন্দ্রিক রাজনীতি চায়; কর্মসংস্থান, জলবায়ু, শিক্ষা, দুর্নীতি দমন, উদ্ভাবন ও সুশাসন—এসব বাস্তব সমস্যাকেই রাজনীতির কেন্দ্রে দেখতে চায়।

এই কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তরুণ ভোটাররা নির্বাচনের ফলেও বড় ভূমিকা রাখছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিকল্প প্রচারণা তৈরি করছে, তারুণ্য-কেন্দ্রিক নেতাদের সামনে তুলে ধরছে এবং রাজনীতিকে ধীরে ধীরে নীতি-নির্ভর পথে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণরাও একই প্রবণতায় এগোচ্ছে। দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ৩৫ বছরের নিচে; অর্থাৎ প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ডেমোগ্রাফিক গ্রুপ এখন রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা আর আগের মতো নয়। তারা প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষণ বা প্রথাগত প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে না। তারা দেখতে চায় নতুন মুখ, স্বচ্ছ নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা এবং দায়িত্বশীল রাজনীতি। তারা এমন নেতৃত্ব চায়, যাদের বয়স নয়- দৃষ্টিভঙ্গি, সততা ও দক্ষতা রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে। 

এই জায়গাতেই তরুণ প্রার্থীর প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। তরুণ প্রার্থীই পারবে তরুণ ভোটারের ভাষা এবং বাস্তবতা বোঝাতে। তারা ডিজিটাল সেবা, স্মার্ট অবকাঠামো, নতুন অর্থনীতি, প্রযুক্তি-সংস্কার, জলবায়ু ন্যায়বিচার, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং শিক্ষা-সংস্কারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে পারে। তাদের রাজনীতি স্বচ্ছতামুখী, অপচয়হীন এবং আধুনিক। সবচেয়ে বড় কথা, তরুণ প্রার্থীরা জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে দক্ষ, ফেসবুক লাইভ, টিকটক প্রচারণা, অনলাইন টাউন হল, তথ্য-নির্ভর বিশ্লেষণ;এসবেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যা এখনকার রাজনৈতিক যোগাযোগে অপরিহার্য।

তরুণ প্রার্থী ও তরুণ ভোটারের এই সমন্বয়ই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। এটি এমন একটি সংস্কৃতি, যেখানে সহিংসতা নয়, যুক্তি; অপচয় নয়, পরিকল্পনা; টাকার প্রভাব নয়, যোগ্যতা; এবং স্লোগান নয়, নীতি-মুখী প্রতিশ্রুতিই হবে রাজনীতির প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও এটি সময়োপযোগী একটি বার্তা, তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনতে না পারলে তারা দ্রুতই রাজনৈতিকভাবে অচল হয়ে পড়বে। কারণ ভবিষ্যৎ যে কাঁধে গড়ে উঠবে, সেই কাঁধ আজ তরুণদেরই।

অতএব, বিশ্ব রাজনীতি এখন যে পথে এগোচ্ছে, বাংলাদেশও সেই স্রোতের বাইরে নয়। পরিবর্তন অনিবার্য, এবং সেই পরিবর্তনের নেতৃত্ব তরুণরাই দেবে। তাদের উদ্ভাবনী শক্তি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তিতে দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার দাবি; এসবই আগামী দিনের রাজনীতির পরিচিতি হয়ে উঠবে। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি তাই তরুণ প্রার্থী ও তরুণ ভোটারদের হাতেই তৈরি হবে; এটি কেবল সম্ভাবনা নয়, বরং বাংলাদেশের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বাস্তবতা।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক।

ঘটনাপ্রবাহ: ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম