শান্তি চুক্তির নামে অশান্তির বীজ
পার্বত্য অঞ্চলের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংকট
ড. মোঃ মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের ভোরবেলায় যখন পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বয়ান ছিল—এটি একটি ‘ঐতিহাসিক অর্জন’, ‘সাহসী কূটনৈতিক সাফল্য’ এবং ‘অবশেষে পাহাড়ে শান্তি’ প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু ২৭ বছর পর আজ যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতি, নিরাপত্তা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, আদিবাসী রাজনীতি, সশস্ত্র সংগঠনগুলোর শক্তি, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাব এবং বাংলাদেশের সার্বভৌম তদারকি—সব মিলিয়ে দেখা হয়, তখন প্রশ্নটি উঠে আসে আগের তুলনায় অনেক বেশি তীব্রভাবে— চুক্তিটি কি সত্যিই শান্তির জন্য করা হয়েছিল? নাকি এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে তোলা, রাজনৈতিক সুনাম অর্জন এবং ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির একটি সুচিন্তিত অদৃশ্য কৌশল?
পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জনগণের সামনে যেসব উন্নয়নমূলক অঙ্গীকার উপস্থাপন করা হয়েছিল, তার মূল ছিল পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ভূমি অধিকারের নিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পাহাড়ি–বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের সমান সুযোগ সুনিশ্চিত করা। কিন্তু সাতাশ বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, এই প্রতিশ্রুতিগুলোর অধিকাংশই কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি, অস্পষ্ট আইন এবং বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চলের জন্য যেসব বিশেষ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়—যেমন আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং ভূমি পুনর্বিন্যাস কমিশন—তারা প্রত্যাশিত কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। বরং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দায়িত্বের অস্পষ্টতা এবং কেন্দ্রীয়–স্থানীয় প্রশাসনের টানাপোড়েন পুরো কাঠামোটিকে কার্যকর করার বদলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ও দ্ব্যর্থতাপূর্ণ করে তুলেছে।
চুক্তির রাজনৈতিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি প্রক্রিয়াকে শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ রাখা এবং পার্বত্য অঞ্চলে দাসক্ষেত্র বিষয়ক সমঝোতা অর্জনের চেষ্টা চুক্তিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে রূপান্তরিত করেছে। তবে এতে চুক্তির মূল উদ্দেশ্য—স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি—দ্বন্দ্বমুখী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর পুনরুত্থান, দ্বৈত প্রশাসনিক কাঠামো, চাঁদাবাজি ও প্রশাসনিক অক্ষমতা মিলিয়ে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সমতা সীমিত হয়েছে। চুক্তি আনুষ্ঠানিক শান্তি দিয়েছে, কিন্তু মাঠে বাস্তবিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, চুক্তি ছিল ‘মোড়কবন্দী শান্তি; ভেতরে ভূরাজনৈতিক লেনদেন’, যেখানে আদিবাসীদের অধিকার প্রদানের মোড়কে বাংলাদেশের সার্বভৌম পাহাড়ি অঞ্চল ধীরে ধীরে ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত অঞ্চলে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক অবস্থান, নোবেল শান্তি পুরস্কারের সম্ভাবনা, ভারতকে সন্তুষ্ট করা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ‘বাফার জোন’ তৈরির আগ্রহ এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নাম উঠবে—এমন প্রত্যাশা ছিল সেই সময়কার আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক লবিংয়ের অংশ। বিশ্বের বহু সংঘাতময় অঞ্চল—আয়ারল্যান্ড, পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান—এসব জায়গায় শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নেতা-নেত্রীদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বাড়তে দেখা গেছে। বাংলাদেশের শাসক দলের তৎকালীন নীতি-পরিচালকদের ধারণা ছিল—পার্বত্য চুক্তি সেই সুযোগ এনে দিতে পারে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি কি সত্যিই শান্তি এনেছে, নাকি শান্তির নামে পাহাড় ক্রমশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হচ্ছে—এই প্রশ্নটি আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাষ্ট্র এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে না চায়, ভবিষ্যতে পাহাড় কোন ভূরাজনৈতিক শক্তির অধীনে পড়বে, তা সময়ই দেখাবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনতে না পারায় পাহাড়ের ওপর বাংলাদেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে। সেনা ক্যাম্প কমানো, র্যাব না পাঠানো, বোর্ড ও কমিশনগুলোকে ‘আদিবাসী-নিয়ন্ত্রিত কাঠামো’ তৈরি করা—এসব পদক্ষেপ শান্তি আনেনি। বরং স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী, যেমন ইউপিডিএফ এবং জেএসএস-এর শক্তি বৃদ্ধি, পাহাড়ি রাজনীতির দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দুর্বল হওয়ার কারণ হয়েছে। ২০০০–২০২৫ সালের মধ্যে দেখা গেছে, পার্বত্য অঞ্চল কয়েকটি পাহাড়ি রাজনৈতিক সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে বেশি যায়। পুলিশ, বিজিবি এবং প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ‘বাইরের শক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য গুরুতর সংকেত।
চুক্তির আরেকটি মৌলিক প্রতিশ্রুতি ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার ও পরিচয়ের যথাযথ স্বীকৃতি নিশ্চিত করা, কিন্তু বাস্তবে বহু বিষয়ই সংশোধন বা আলোচনার পর্যায়েই আটকে থাকে। অনেক গবেষক মনে করেন, চুক্তির ভাষায় যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা ছিল, তা বাস্তবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে গোষ্ঠীগত রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দ্বারা। ফলে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথিত কাঠামো বাস্তবে নাগরিক অধিকার বা উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেনি; বরং কখনো কখনো তা হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার উৎস। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নটি তাই বাস্তবিক উন্নয়ন বা কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বদলে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির টানাপোড়েনে। সাতাশ বছর পরও পাহাড়ের মানুষ মৌলিক সেবা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার অভাবে ভোগাচ্ছে।
চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য করা বিভিন্ন উদ্যোগ রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার টানাপোড়েন এবং গোষ্ঠীগত চাপের কারণে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর করার বদলে চুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে ভিন্নমত ও চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা অঞ্চলে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি করেছে। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও পূর্ণ হয়নি। সড়ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি উন্নয়নের প্রকল্পগুলোর একটি বড় অংশ নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের মুখে পিছিয়ে গেছে। সরকারি বরাদ্দ থাকলেও স্থায়ী উন্নয়ন গতি পায়নি, কারণ মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা নিরাপত্তার কারণে নিয়মিত কাজ করতে পারেননি। প্রকল্পে চাঁদাবাজির মতো চর্চা অর্থ ও কাজের মানে প্রভাব ফেলেছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
চুক্তির প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং ভূমি কমিশন তৈরি করা হয়। লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক কার্যকারিতা, শান্তি-নিরীক্ষা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অধিকার সুরক্ষা। বাস্তবে দেখা যায়, আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে দ্বৈত প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, দায়িত্বের অস্পষ্টতা এবং ক্ষমতার টানাপোড়েন প্রশাসনিক কার্যকারিতা দুর্বল করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেনা ক্যাম্প কমানো এবং র্যাবের সীমিত উপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা শক্তি না থাকার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠী দখলকৃত এলাকা পুনর্গঠন ও কার্যক্রম প্রসারিত করছে। নাকাম কমানো ধীরগতিতে চলার কারণে ইউপিডিএফ-এর পুনরুত্থান ঘটেছে। বিশ্লেষকরা সুপারিশ করেন, পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য সেনা ক্যাম্প পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ অপরিহার্য। আধুনিক ইন্টেলিজেন্স সম্প্রসারণ এবং তথ্যভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনও অত্যন্ত জরুরি।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চুক্তির প্রভাব সীমিত। সরকারি বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত। কৃষি উৎপাদন, বাণিজ্য, পর্যটন এবং স্থানীয় শিল্প বিকাশ সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে থমকে গেছে। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রায়ই চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ব্যাহত হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ সীমিত হয়েছে। নিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তার কারণে অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণভাবে গোষ্ঠীগত আধিপত্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এই অর্থনৈতিক সংকট পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সামাজিক বিভাজন বৃদ্ধি করেছে। ভূমি ও অধিকার সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিও আংশিকভাবে পূর্ণ হয়েছে। ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা সীমিত থাকার কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনযাপন করছে। দ্বৈত কর্তৃত্ব ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের কারণে ভূমি বিতর্ক, বাসস্থান ও নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো সমাধানহীন রয়ে গেছে।
ভবিষ্যতের করণীয় স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেনা ক্যাম্প এবং র্যাব মোতায়েন স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করে নিরাপত্তা শূন্যতা দূর করতে হবে। আধুনিক ইন্টেলিজেন্স সম্প্রসারণ এবং তথ্যভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্ত্রনিষ্কাশন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে পর্যবেক্ষণ, নিবন্ধন ও আইনগত বাধ্যবাধকতা প্রয়োগ করতে হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সমান সুযোগ, উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছ বাস্তবায়ন, চাঁদাবাজি নির্মূল এবং বিনিয়োগে নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ভূমি ও নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কার্যকর করতে কমিশন ও প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সামাজিক সংহতিও অপরিহার্য। পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা পুনঃস্থাপন, সামাজিক বিনিময় ও সংলাপের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব হ্রাস করা সম্ভব। স্থানীয় নেতৃত্বের স্বচ্ছতা, জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করা এবং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রক্রিয়া ও চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। প্রথমত, তারা সংলাপ ও মতবিনিময় পুনঃসক্রিয় করার মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল চুক্তির প্রতিপালন নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক ও আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করার উপর। এছাড়া, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেমন শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, এবং আঞ্চলিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সরকারি পক্ষের পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতৃত্ব ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল যাতে তাদের দাবি ও অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে নথিভুক্ত ও সমাধান করা যায়। এর পাশাপাশি, চুক্তির বাস্তবায়নে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশেষ মনিটরিং মেকানিজম প্রবর্তন করা হয়েছিল। সবমিলিয়ে, অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলি মূলত সংলাপ পুনঃপ্রবর্তন, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্থানীয় নেতৃত্বের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল।
সব মিলিয়ে দেখা যায়—পার্বত্য চুক্তির উদ্দেশ্য যতটা শান্তি, তার চেয়ে বেশি ছিল কূটনৈতিক অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সখ্যতা স্থাপন। আদিবাসীদের অধিকার ছিল এক ধরনের ‘রাজনৈতিক মোড়ক’—যা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে দেখানো সম্ভব হয়েছিল যে বাংলাদেশ একটি বড় সংঘাত সমাধান করেছে। অথচ বাস্তবতা হলো—সংঘাতের সমাধান হয়নি; বরং সংঘাতের চরিত্র পাল্টেছে।
তাই প্রশ্নটি আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ: পার্বত্য শান্তি চুক্তি কি সত্যিই শান্তি এনে দিয়েছে—নাকি শান্তির নামে পাহাড় ক্রমশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে? যদি রাষ্ট্র এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে না চায়—তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড় কোন ভূরাজনৈতিক শক্তির অধীনে পড়বে, তা সময়ই বলে দেবে; কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশের পক্ষে সুখকর হবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
পরিশেষে বলা যায়, সাতাশ বছরের পর পার্বত্য শান্তি চুক্তি আংশিক শান্তি দিয়েছে। তবে বাস্তবিক শান্তি, উন্নয়ন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দিন দিন নাকাম কমানো, ইউপিডিএফ-এর দৌরত্ব রোধ, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা শক্তি বৃদ্ধি, ইন্টেলিজেন্স সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়। চুক্তি প্রমাণ করেছে যে শান্তি কেবল চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে নয়, সমন্বিত প্রশাসনিক সক্ষমতা, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিকাশ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখকঃ অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com
