Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষার মূল্য কী

Icon

ড. মো. শওকাত আলী

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষার মূল্য কী

ছবি: সংগৃহীত

আমার শিক্ষকতার পথচলা প্রায় ছাব্বিশ বছরের। এ দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিদেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শিক্ষকতা জীবনের এ দীর্ঘ পরিসরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ যেমন বদলেছে, তেমনি বদলে গেছে শিক্ষার্থীদের চিন্তাধারা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। বিগত কয়েক দশকের এ অভিজ্ঞতার আলোকে আমার ভাবনা ও উপলব্ধি নিয়েই এ নিবন্ধটি লেখা হলো।

আজকের পৃথিবী জ্ঞান, প্রযুক্তি ও তথ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ মহাকাশ জয় করেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, আর হাতে হাতে পৌঁছে গেছে সমগ্র বিশ্বের তথ্যভান্ডার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ অগ্রযাত্রার মাঝেও কি আমরা সত্যিকারের শিক্ষিত হতে পেরেছি? শিক্ষা যদি শুধু জ্ঞানের পরিমাপেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা মানুষকে শুধু দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারে, কিন্তু মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, নৈতিকতায় দৃঢ় আদর্শ মানুষ গড়ে তুলতে পারে না। তাই আজকের বাস্তব প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ সমন্বয়ই পারে আগামী প্রজন্মকে আলোকিত ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে।

প্রাচীন যুগে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং চরিত্র গঠন। তৎকালীন গুরুকুল ব্যবস্থা কিংবা মাদ্রাসা ও পাঠশালাগুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি শিষ্টাচার, সততা, শৃঙ্খলা ও পরোপকারের মূল্যবোধ শেখান হতো। আধুনিক যুগে এসে আমরা সেই মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে গেছি। এখন শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে কেবল ভালো নম্বর, চাকরি বা আর্থিক সাফল্যের প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা সেই, যা মানুষকে সত্যবাদী, সহানুভূতিশীল ও নৈতিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, শিক্ষা মানে মানুষের মধ্যে সেরা গুণাবলির বিকাশ। অর্থাৎ শিক্ষা যদি কেবল তথ্য প্রদান করে, কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহারের নৈতিক নির্দেশনা না দেয়, তবে তা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, পরিবেশ ধ্বংস-সবকিছুর মূলে কোথাও না কোথাও শিক্ষার এ নৈতিক শিক্ষার শূন্যতাই দায়ী।

বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় একটি দৃশ্যমান সমস্যা। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি ক্ষমতা, অর্থ বা স্বার্থের প্রলোভনে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। শিক্ষার আলো থাকা সত্ত্বেও সমাজে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, হিংসা, নারী নির্যাতন কিংবা প্রতারণার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মূল্যবোধের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যখন কোনো সমাজে নৈতিকতা হারিয়ে যায়, তখন সেখানে শিক্ষার মর্যাদা টেকে না। শিক্ষিত মানুষ তখন কেবল চালাক বা দক্ষ মানুষে পরিণত হয়, কিন্তু মানবিকভাবে পরিপূর্ণ মানুষ নয়। এর ফলেই আজকের পৃথিবী প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হলেও মানবিকতার দিক থেকে দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

নৈতিক শিক্ষা মানে কেবল ধর্মীয় উপদেশ নয়; এটি হলো মানবতার পাঠ, যেখানে মানুষ শেখে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধ। বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন গণিত, বিজ্ঞান ও সাহিত্য শেখানো হয়, তেমনি নৈতিকতা শেখানোরও একটি কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিশু যখন ছোটবেলায় সততা, পরিশ্রম ও সহমর্মিতার শিক্ষা পায়, তখন সে বড় হয়ে কেবল একজন দক্ষ নাগরিক নয়, একজন সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠে। এজন্য পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। শিক্ষকরা কেবল পাঠদানেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না; বরং তারা হবেন নৈতিকতার আদর্শ উদাহরণ। পরিবারও এ প্রক্রিয়ার প্রথম বিদ্যালয়। বাবা-মায়ের আচরণ, সততা ও জীবনদর্শন সন্তানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু বইয়ের পাতায় নয়, বাস্তব জীবনের উদাহরণ, গল্প, নাটক বা কার্যক্রমের মাধ্যমে নৈতিকতা শেখানো যেতে পারে। শিক্ষককে হতে হবে আদর্শ মানুষ। কারণ শিক্ষার্থীরা পাঠের চেয়ে শিক্ষকের চরিত্র থেকে বেশি শেখে। একজন সৎ, সহানুভূতিশীল শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার বীজ বপন করতে পারেন। পরিবারে যদি সততা ও পরোপকারের চর্চা না থাকে, তবে বিদ্যালয়ের নৈতিক শিক্ষা প্রভাব ফেলবে না। সমাজকেও হতে হবে সহনশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন।

ধর্ম মানুষকে ন্যায়, সত্য ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। তাই ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সামঞ্জস্য রেখে নৈতিক শিক্ষার কাঠামো তৈরি করা দরকার। ডিজিটাল যুগে তরুণরা ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাদের শেখাতে হবে কীভাবে প্রযুক্তিকে সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে ভুয়া তথ্য বা সাইবার অপরাধ থেকে বিরত থাকা যায়।

একটি দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা নৈতিকভাবে দৃঢ় ও দায়িত্বশীল হয়। জাপান, ফিনল্যান্ড বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে নয়, বরং তাদের নাগরিকদের নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার জন্যই উন্নত। আমাদের দেশেও যদি শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় ঘটানো যায়, তবে দুর্নীতি, বৈষম্য ও অপরাধ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। একজন শিক্ষিত, কিন্তু অনৈতিক মানুষ সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু একজন নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ সমাজে শান্তি ও উন্নতির পথ দেখায়। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে এ দায়িত্ব নিতে হবে আমরা যেন কেবল ডিগ্রিধারী মানুষ নয়, বরং মূল্যবোধে সমৃদ্ধ আদর্শ নাগরিক তৈরি করতে পারি।

আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রত্যেক স্তরে নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথাবার্তা, আচরণ ও ব্যবহার সর্বদা মানবিক হতে হবে। পেশিশক্তি প্রদর্শন না করে ভদ্র ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সবার মন জয় করা উচিত। আমরা যে যেখানেই বাস করি বা যে-যে কাজে নিযুক্ত থাকি না কেন, আমাদের আচরণের মাধ্যমে এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে, যেন সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য হয়। এটি অর্জনের একমাত্র উপায় হলো আমাদের অতিমাত্রায় সহনশীল হতে হবে, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা এড়িয়ে চলতে হবে।

শিক্ষা ও নৈতিকতা, এ দুটি উপাদান একে অপরের পরিপূরক। নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা অন্ধ, আর শিক্ষা ছাড়া নৈতিকতা অচল। বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সমাজে কেবল জ্ঞানে নয়, মূল্যবোধেও উন্নত প্রজন্ম গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি নৈতিকতার আলোয় আলোকিত হয়, তবে আগামী প্রজন্ম হবে সততা, সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধে সমৃদ্ধ-যারা কেবল নিজেদের সাফল্য নয়, সমাজ ও জাতির মঙ্গলেও অবদান রাখবে। শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার এ সমন্বয়ই একদিন বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে আলোকিত ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে।

প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী : উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম