Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অন্যমত

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন

Icon

আবু আহমেদ

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন

বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে গিয়েছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে ব্যাংক ব্যবসায় ধস নামে। এর প্রভাব এখনো রয়েছে। বলতে গেলে দেশের মোট ব্যাংকের ৫০ শতাংশই এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়ে ব্যাংকগুলো একরকম পঙ্গুত্ববরণ করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৩৫.৭৭ শতাংশ। গত ১ বছর ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের ৯ মাসে বেড়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের প্রবাহ যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। তাছাড়া ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের বিষয়টিও ভাবাচ্ছে। বর্তমানে ঋণের সুদহার ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ এবং ব্যাংকগুলোতে পুঁজির স্বল্পতার কারণে বিনিয়োগ চাহিদা অনেকাংশেই কমে যাবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা স্থবিরতা দেখা দেবে।

আজ যাদের বড় বড় শিল্প গ্রুপ বলা হয়, তাদের অনেকেই বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আনুকূল্য নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ব্যাংক থেকে। দুর্ভাগ্যক্রমে এসব শিল্প গ্রুপের জন্য যতটা ব্যাংক ঋণ দরকার ছিল, তার থেকে বেশি তারা নিয়ে গেছে বিভিন্ন কায়দায়। এ বড় বড় শিল্প গ্রুপ ওই সরকারের আনুকূল্যে প্রাপ্ত ঋণের কিছুটা কাজে লাগিয়েছে, বাকিটা পাচার করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো প্রায় খালি হয়ে গেছে। যেমন-বেসিক ব্যাংকে যে অনিয়মগুলো হয়েছে, সেটি তো সরকারের চোখের সামনেই হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে; অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পদ্মা ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে, যার খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। ভুয়া কোম্পানি খুলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই। নামে-বেনামে তৃতীয় পক্ষের নামেও বিভিন্ন কায়দায় ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর অসাধু কিছু কর্মচারী লোভের মুখে পড়ে দেদার ওইসব লোককে ঋণ দিয়ে গেছে, যার ফলে ব্যাংকগুলো এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। যাদের রিকভারি করার সামর্থ্য নেই এখন।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা ব্যবসা করেছে, ঠিক আছে; কিন্তু ব্যবসায় সম্পূর্ণ পুঁজি তো আর লাগায়নি। কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছে তারা। সরকার সরেজমিন তদন্ত করে বিষয়টি দেখতে পারে। কথিত নামধারী এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা যারা ব্যবসা পরিচালনা করেছে, যারা ব্যাংক পরিচালনা করেছে, তারা পরস্পর পরস্পরের যোগসাজশেই সেসব করেছে। তবে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কমার্শিয়াল বিজনেস হাউজ, যেগুলো প্রাইভেট সেক্টরে রয়েছে, তারা হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের দেশে যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ১৫ বছরে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এর আগে বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুব একটা ছিল না বললেই চলে। যেগুলো ছিল সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ছোট আকারের। তবে বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা দোষের কিছু নয়। এটি নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ এতে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে একটা গতি আসে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। তবে যারা ব্যক্তিগতভাবে পুরো অর্থনীতিকে, ব্যাংক খাতকে, এমনকি নন ব্যাংক খাত, যেটাকে আমরা লিজিং কোম্পানি বলি-এগুলোতে কালো হাত দিয়েছে, দেদার টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। এ টাকার কিছু অংশ তারা ব্যবসার কাজে লাগিয়েছে, বাকিটা বিদেশে পাচার করেছে। আবার কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়েছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটাই হচ্ছে দুঃখজনক বিষয়। ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকলে তারা কখনই জনগণের এ টাকা-পয়সা নয়ছয় করতে পারত না, লুটপাট করতে পারত না।

লুটপাটের এ বিষয়গুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত করা উচিত। জনগণের টাকা যারা লুটপাট করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ যেন এ ধরনের লুটপাট করার সাহস না পায়। আরেকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সেটা হলো, আওয়ামী ঘরানার অনেক শিল্পমালিক পালিয়ে গেছেন। ফলে তাদের রেখে যাওয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে লুটপাটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করা যাবে না। কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। যেভাবেই হোক, স্থবির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করাতে হবে।

দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি নির্বাচিত সরকার আসে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে, তাহলে দেশের ব্যাংক খাত একটি শক্ত অবস্থানে আসবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা যদি একটি ভালো অবস্থানে আসে, তাহলে ক্যাশ ফ্লো বাড়বে। ক্যাশ ফ্লো যদি বাড়ে, সুদের হার যদি কমতির দিকে থাকে এবং টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবেই। এর ফলে আমাদের নেতিয়ে পড়া অর্থনীতি হয়তো আবার উঠে দাঁড়াবে।

দেশের বর্তমান অর্থনীতি একটা স্থবির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, ১১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ। এ বিশাল অঙ্কের ঋণ এখন শোধ করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আদানি গ্রুপের টাকা বাকি রেখেছে, এয়ারলাইন্সের টাকা বাকি রেখেছে। এ সবকিছুই এখন বর্তমান সরকারকে শোধ করতে হচ্ছে। প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে এ সরকার। একদিকে বিশাল আকারের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ, অপরদিকে রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপের পাওনা পরিশোধের বিষয়টি। সব মিলিয়ে এ বিষয়গুলোকে সামাল দিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ উচ্চ হারে সুদ-আসলে পরিশোধের বিষয়টি। প্রায় ২০ শতাংশ বা তারও বেশি অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে; যার কারণে বিশাল ঘাটতি বাজেটে আমাদের পড়ে থাকতে হয়েছে।

অর্থনীতির ভাষায় একটি কথা রয়েছে : একটি ঘাটতি আরেকটি ঘাটতি সৃষ্টি করে। আমরা আগে ঘাটতি বাজেট করেছি, সেটার ফলস্বরূপ সেই ঘাটতি বাজেটের সুদ এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে করতে আমরা ঋণের খাদের কিনারে চলে এসেছি। অর্থাৎ ঋণের বোঝা এত বেড়েছে যে, সরকার ট্যাক্স মানি, রেভিনিউ মানি সংগ্রহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

সরকারের জন্য আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়ার কারণে রাজস্ব আয়ও কম হচ্ছে। ফলে ঘাটতি বাজেটের পরিধি আরও বাড়ছে। সরকারের এমন অবস্থার মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে মানুষের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি। বিগত সরকারের আমলে জনগণ তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে খুব একটা সরব হতে পারেনি। তাই পুঞ্জীভূত অধিকার ও দাবি-দাওয়া নিয়ে অনেকেই এখন মাঠে নেমেছে। দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামলেই তো হবে না, সরকারের সামর্থ্যরে বিষয়টি বুঝতে হবে। কেউই বুঝতে চাইছে না আমাদের অর্থনীতির শক্তি কতটুকু। সুতরাং, অর্থনীতির শক্তি অর্জন করার জন্য কিছুদিন সময় দিতে হবে, একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সবাই যদি একসঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমে যায়, তাহলে একটা বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই হবে না। সুতরাং আমাদের যা করতে হবে, তা হলো, অন্তত নির্বাচন পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করা। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

আবু আহমেদ : অধ্যাপক; চেয়ারম্যান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম