নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব: জলবায়ু গভর্ন্যান্স, স্টার্টআপ বিপ্লব ও রাষ্ট্রীয় রূপান্তর
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১০:০৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্ব আজ এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জলবায়ু সংকট ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, প্রযুক্তি বিপ্লব এক নতুন অর্থনৈতিক ধারা তৈরি করেছে, আর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তরুণ নেতৃত্বের উত্থান গভীর রূপান্তরের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অগ্রভাগে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে; একই সঙ্গে তরুণ উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও নতুন নেতৃত্বের আগ্রাসী ভূমিকা দেশের ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে।
১. বাংলাদেশের জলবায়ু গভর্ন্যান্সে নতুন প্রজন্মের গুরুত্ব
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দৃষ্টান্তস্থল। বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়—বন্যা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিপুল জনবসতি ঝুঁকির মুখে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের সমন্বিত জলবায়ু গভর্ন্যান্স প্রয়োজন।
তবে সমস্যা হলো- প্রচলিত নীতিগত কাঠামো অনেক সময় কঠোর কেন্দ্রীয়করণ ও বয়স্ক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ থাকে। সেখানে নতুন প্রজন্মের তরুণ, যারা প্রযুক্তির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত এবং স্থানীয় বাস্তবতার গভীর জ্ঞান রাখে, তারা জলবায়ু নীতির ডিজাইন ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমরা যদি আন্তর্জাতিক পরিসরে লক্ষ্য করি, নিউজিল্যান্ডের যুব জলবায়ু কাউন্সিল সরাসরি সরকারকে নীতিমালা সাজাতে সহায়তা করে। কোস্টারিকার যুব নেতৃত্ব দেশটিকে প্রায় ৯৯% নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
বাংলাদেশে এক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে যদি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে ‘তরুণ জলবায়ু অ্যাম্বাসেডর’ নিয়ে আসা যেতে পারে, যারা স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের পথে কাজ করবে।
২. স্টার্টআপ বিপ্লব ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গত দশকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিনটেক, এগ্রিটেক, এডটেক ছাড়াও এখন জলবায়ু ও পরিবেশ প্রযুক্তি (ClimateTech) সেক্টরে তরুণ উদ্যোক্তারা উদ্ভাবন করছে।
যার অন্যতম উদাহরণ হলো- খুলনায় বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে রিসাইক্লিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্টার্টআপ গড়ে তোলা। বরিশালে স্মার্ট সেচ ও বন্যা পূর্বাভাস প্রযুক্তি প্রবর্তন।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলনা করতে গেলে আমরা দেখবো- ইসরাইল তাদের ‘স্টার্টআপ নেশন’ খ্যাতি অর্জন করেছে কৃষি ও পরিবেশ প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটিয়ে। সিঙ্গাপুরে সরকারি উদ্যোগে স্টার্টআপ ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল উৎসাহিত করে, বিশেষ করে সবুজ প্রযুক্তিতে।
বাংলাদেশেও স্টার্টআপদের জন্য কর-ছাড়, সহজ তহবিল প্রাপ্তি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়তা দিয়ে কাজ করার মাধ্যমে স্টার্টআপ সেক্টরে বিপ্লব সাধন করতে পারে।
৩. রাজনৈতিক রূপান্তর এবং তরুণ নেতৃত্বের ভূমিকা
রাজনীতি যেখানে পুরোনো পন্থায় জড়িয়ে আছে, সেখানে তরুণ নেতৃত্ব দেশের ভাবমূর্তির পরিবর্তনে নতুন দিশা দিতে পারে। বিশ্বে দেখা গেছে, যেখানে তরুণরা নেতৃত্বে এসেছে, সেখানে প্রযুক্তি ও পরিবেশবিষয়ক নীতি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
ফিনল্যান্ডের সান্না মারিন ৩৪ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তরুণ নেতৃত্ব ও আধুনিক নীতিনির্ধারণের সেরা উদাহরণ হয়েছেন। ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ’র রাজনৈতিক মুভমেন্টে তরুণ ও উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণদের জন্য কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
৪. নতুন প্রজন্মের জন্য করণীয় রূপরেখা
- নীতিতে তরুণ অংশগ্রহণ বাড়ানো: স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তরুণদের জন্য বিশেষ ‘জলবায়ু ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব ফোরাম’ গঠন।
- দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: ক্লাইমেট টেক, ডেটা অ্যানালিটিক্স ও নীতি বিশ্লেষণে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
- অর্থায়ন ও বিনিয়োগ: Impact Investment, ক্রাউডফান্ডিং ও সরকারী তহবিল সহজলভ্য করতে পদক্ষেপ নেওয়া।
- আন্তর্জাতিক সংযোগ: বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ও স্টার্টআপ সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়।
নতুন প্রজন্মের তরুণরা যদি পর্যাপ্ত সুযোগ, প্রশিক্ষণ ও সমর্থন পায়, তবে তারা শুধুমাত্র দেশের জলবায়ু গভর্ন্যান্স উন্নত করবে না, একটি উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রীয় রূপান্তরও ঘটাবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, যখন তরুণ নেতৃত্ব জলবায়ু নীতি, স্টার্টআপ ও রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তখন টেকসই উন্নয়ন সফল হয় এবং দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন দ্রুত হয়। বাংলাদেশের আগামীর দিকে এগোনোর পথ এখানেই নিহিত।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

