Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

নিষেধাজ্ঞা মাড়িয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় অস্ট্রেলীয় শিশুরা

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম

নিষেধাজ্ঞা মাড়িয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় অস্ট্রেলীয় শিশুরা

অস্ট্রেলিয়ায় শিশুদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের কয়েক দিনের মধ্যেই প্রযুক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ছবি: বিবিসি

অস্ট্রেলিয়ায় শিশুদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের কয়েক দিনের মধ্যেই প্রযুক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র ১৩ বছর বয়সি ইসাবেল দেখিয়ে দিয়েছেন—কিভাবে কয়েক মিনিটেই পাশ কাটানো যায় সরকারের ‘বিশ্ব-নেতৃত্বাধীন’ বলে দাবি করা এ বয়স যাচাই ব্যবস্থা। 

স্ন্যাপচ্যাটে একটি সতর্কবার্তা আসার পর, প্ল্যাটফর্মটি তাকে জানায়—১৬ বছরের প্রমাণ না দিতে পারলে শিগগিরই তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু ইসাবেল সহজেই তার মায়ের ছবি ক্যামেরায় ধরিয়ে বয়স যাচাই পেরিয়ে যান। ‘ধন্যবাদ, আপনার বয়স যাচাই হয়েছে’—এমন বার্তাও তিনি পেয়েছেন। 

ইসাবেলের মা মেল বিষয়টি দেখে অবাক হননি। তার ভাষায়, ‘আমি জানতাম এমনটাই হবে।’ তিনি মেয়েকে টিকটক–স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করতে দিতেন কঠোর নজরদারিতে, কারণ গোপনে ব্যবহার করলে ঝুঁকি আরও বাড়তো। তবে নতুন আইন শিশুদের সুরক্ষায় সহায়ক হবে—এমনটাই তার আশা ছিল। এখন সেই আশা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। 

নতুন আইন কি বাস্তবায়নযোগ্য? 

অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কম বয়সিদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পর থেকেই বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক এবং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। 

বাবা-মায়েদের দাবি—সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো শিশু সুরক্ষায় ব্যর্থ। ১৫ বছর বয়সি কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনার উল্লেখ করে এক মা জাতিসংঘে প্রশ্ন তুলেছেন— ‘আর কত টিলি মরলে ব্যবস্থা নেবে?’  

এই চাপের মধ্যেই ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ ঘোষণা করেন—সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের নতুন ন্যূনতম বয়স হবে ১৬ বছর। শিশু বা অভিভাবককে শাস্তি দেওয়া হবে না, তবে প্ল্যাটফর্মকে ‘যৌক্তিক পদক্ষেপ’ নিতে হবে। গুরুতর ব্যর্থতায় জরিমানা সর্বোচ্চ ৪৯.৫ মিলিয়ন ডলার।

তবে আইন পাস হলেও বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—তা নিয়ে ছিল না স্পষ্ট পরিকল্পনা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জনমত গ্রহণ শেষে সরকার হুড়োহুড়ি করে বিলটি অনুমোদন করায় সমালোচনা আরও জোরালো হয়েছে। 

প্রযুক্তি কি ভরসাযোগ্য?

সরকার-অর্থায়িত একটি ট্রায়াল রিপোর্ট বলেছে—বয়স যাচাইয়ের প্রতিটি পদ্ধতি প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব হলেও কোনোটিই নিখুঁত নয়।

আইডি যাচাই সবচেয়ে নির্ভুল হলেও অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়ান সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যক্তিগত নথি দিতে রাজি নন। ফেস স্ক্যান ও অনলাইন আচরণ বিশ্লেষণ—উভয় পদ্ধতিই ১৬ বছরের দুই-তিন বছর এদিক–ওদিক বয়স শনাক্তে ব্যর্থ হয়।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে—২২ ডলারের একটি হ্যালোইন মাস্ক দিয়েই ফেস স্ক্যান প্রযুক্তি ফাঁকি দেওয়া গেছে।

সরকারের লক্ষ ১০টি প্ল্যাটফর্ম বাদ দিয়ে অন্য অ্যাপ ব্যবহার, ভিপিএন দিয়ে অবস্থান গোপন করা এবং পিতামাতার ইমেইল ব্যবহারসহ নানা উপায়ে কিশোররা নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটানোর টিপস ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইনে। 

স্ন্যাপচ্যাটও জানিয়েছে—এ আইন বাস্তবায়নে ‘প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ’ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, প্ল্যাটফর্ম ও সরকারের সামনে অপেক্ষা করছে এক অন্তহীন ‘হোয়্যাক-এ-মোল’ খেলা—এক লুপহোল বন্ধ হলে আরেকটি খুলবে। 

নিষেধাজ্ঞা কি ঝুঁকি বাড়াবে?

সমালোচকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে—

  • বাচ্চারা আরও বিপজ্জনক, অনিয়ন্ত্রিত ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ভিড়তে পারে
  • গেমিং সাইটের চ্যাটরুমে যেতে পারে, যেগুলোতে সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা ছড়ায়—এমন সতর্কতা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ
  • টিকটক বা ইউটিউব অ্যাকাউন্ট ছাড়া ব্রাউজ করলে বাচ্চারা বেশি অনিরাপদ, কারণ তখন কনটেন্ট ফিল্টার এবং বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ থাকে না

ইউটিউব ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছে—এই আইন শিশুদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করবে। 

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন—বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারে। যেমন, ফেসবুকে প্রাপ্তবয়স্ক কেউ শিশু অ্যাকাউন্টে বারবার মেসেজ করলে স্বয়ংক্রিয় সতর্কতা চালু হয়। ছোট প্ল্যাটফর্মে এসব সুরক্ষা নেই।

কিছু শিশুদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া জীবনরেখা

গবেষণায় দেখা গেছে—এলজিবিটিকিউ+, নিউরোডাইভারজেন্ট বা প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া কখনও কখনও গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা ও কমিউনিটির উৎস।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক শিশু কমিশনার অ্যান হল্যান্ডস বলেন, ১৬ বছর বয়স কোনো জাদুর সীমা নয়। এই আইন একা কিছু করবে না।

সরকারের লক্ষ্য: নতুন সামাজিক মানদণ্ড

সরকার বলছে—এটি কেবল শুরু। সামনে আরও কঠোর দায়িত্ববদ্ধতার আইন (ডিজিটাল ডিউটি অব কেয়ার) আসছে। যোগাযোগমন্ত্রী আনিকা ওয়েলস বলেন—এটি সম্পূর্ণ সমাধান নয়, এটি একটি চিকিৎসা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।

সমর্থকদের মতে, প্রয়োগ কঠিন হলেও শুধু এটুকুই যথেষ্ট—শিশুরা যেন মনে না করে সোশ্যাল মিডিয়া তাদের অধিকার।

বিরোধীদের মতে, ভুল পথ বেছে নেওয়া হয়েছে; ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ ডিজাইন এবং শিশুদের ডিজিটাল শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল।

আইন কি কাজ করবে?

বিশেষজ্ঞদের মত—১০০% শিশু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। তবে ৮০% ব্যবহার না করলে তা সামাজিক আচরণ বদলে দিতে পারে।

কিন্তু ইসাবেলের মতো কিশোররা বলছে—আমি যদি বাদও যাই, অন্য অ্যাপ খুঁজে নেব।

আইন কার্যকর হওয়ার আগেই উদ্বেগ স্পষ্ট—এটি কি সত্যিই কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে, নাকি শিশু ও প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে সরকারের দীর্ঘ লড়াইয়ের একটি নতুন অধ্যায়ই শুরু হলো?

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম