মোহময় ধূপপানি
ঝরনাধারায় রংধনুর খেলা
যারে দেখিবার বড় সাধ,
তার সাথে ভাগ্যের বিবাদ!
দান-দান তিন দানেও হলো না। তবুও হাল ছড়িনি। যেভাবেই হোক যাবই। অবশেষে ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়ল—সাক্ষাৎ হলো মোহময় ঝরনাধারা ধূপপানির সাথে! টানা তিনবার পরিকল্পনা করেও কোনো না কোনো কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি রাঙ্গামাটির ধূপপানিতে। অবশেষে সেই সাধ মিটলো এ বছরের সেপ্টেম্বরে এসে। ভাগ্য এবার এতটাই সহায় যে, যাওয়ার আগে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলো। বর্ষা মৌসুমের পরও তাই ঝরনায় ভরপুর পানি। অপরদিকে আমরা কাপ্তাই পৌঁছানোর আগের দিন থেকেই বৃষ্টি উধাও! একেবারে সোনায় সোহাগা—ঝরনায় পানি আছে, কিন্তু পাহাড়ে কাঁদা নেই।
বছর চারেক হলো দেশের সবকটি জেলা ভ্রমণের চক্র পূরণ করেছি। বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি একাধিকবার। কিন্তু কখনো কোনো ট্যুর অপারেটরের সাথে ভ্রমণ করা হয়নি। কয়েকজনের কাছ থেকে ভালো রিভিউ পাওয়ার পর এই প্রথম ‘পর্যটক বাংলাদেশ’ নামে একটি ট্যুর অপারেটরের সাথে ভ্রমণ করলাম। নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের রোমাঞ্চ শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু সেই পুরনো কাপ্তাই, সেই পুরনো লেক—বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই একাধিকবার যাওয়ার কারণে ভ্রমণপ্রিয় এই মনটায়ও রোমাঞ্চে কিঞ্চিৎ ভাটা অনুভব করছি! চারপাশে সারি সারি পাহাড়, মাঝে স্বচ্ছ সবুজ পানির হ্রদ, পানির বুক চিরে ছুটে চলছে ট্রলার। মনোমুগ্ধকর নৌভ্রমণের জন্য আর কী লাগে! তবুও মনে যেন রোমাঞ্চের ঘাটতি! অথচ প্রথমবার কাপ্তাই লেক ভ্রমণে এসে সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন পাহাড়ে নৌকা ভেড়ানো, পানিতে দাপাদাপি-গোসল। আহা! কত সুখস্মৃতি। এসব ভাবতে ভাবতে আল আমিনকে বললাম, দিন দিন ভ্রমণের রোমাঞ্চ কী কমে যাচ্ছে? ও হ্যাঁ, এবারও যথারীতি আমাদের একত্রিত করেছে আল আমিন। মূলত, ও আর আমি যৌথভাবে তিনবার ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ধূপপানি ভ্রমণ করছি।
ভ্রমণকালে বড় সুবিধা—ভ্রমণপ্রিয় মন নিজেই রোমাঞ্চ খুঁজে নেয়। বিলাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর রোমাঞ্চ যেন মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সেই বিলাইছড়ি উপজেলা। যার সীমানায় সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে ঝরে চলছে ধূপপানি। জাতীয় পরিচয়পত্র জমাদান ও যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে নৌযান ছাড়তেই উৎসুক মন প্রহর গোনা শুরু করেছে, কখন পৌঁছাব বিলাইছড়ি সদরে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা নৌভ্রমণ শেষে বিলাইছড়ি পৌঁছে কটেজে ব্যাগ রেখে শুরু হলো মুপ্পোছড়া, ন-কাটা ঝরনা দর্শনের প্রস্তুতি পর্ব। ভ্রমণের প্রথম দিন এটাই আমাদের গন্তব্য।
আবারও নৌযানে চেপে যাত্রা। আঁকাবাঁকা খাল পেরিয়ে বাঙ্গালকাটার পথে নোঙ্গর। শুরু হলো নিচু পথে হাঁটা। পাহাড়ি পথে পৌঁছানোর আগে স্থানীয় গাইড নিয়ে শুরু হয় মুপ্পোছড়া অভিযান। সমতল ও ঝিরি পেরিয়ে পাহাড়ি পথে শুধুই উপরে উঠা। খানিক বাদে নিচেও নামতে হচ্ছে; খানিক বাদে উঁচুতে। এভাবেই উঠানামা করতে করতে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ। বুঝলাম আশেপাশেই জলপ্রপাত। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলপ্রপাতের পানি আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর। এরপর পাথরের ফাঁক গলে বের করে নিচ্ছে পথ। এবার শুধু উঁচুতে উঠার পালা। পাহাড়ের সরু ও পিচ্ছিল পথ বেয়ে উপরে উঠছি আর একটু পরপরই মিলছে জলপ্রপাতের দেখা। পাথরময় উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে যে কতগুলো জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে তা মনে রাখাই দায়।
পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশের কাছে যেতেই মুপ্পোছড়া ঝরনার দেখা। পাহাড়ের একেবারে উপর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে বিভিন্ন পাহাড়ের খাঁজে। এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজে ধাক্কা লেগে গড়িয়ে পড়ছে নিচের অংশে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য! এমন ঝরনায় গোসল করার লোভ কে সামলাতে পারে? আমরাও পারিনি। শীতল পানিতে গা এলিয়ে দিতেই যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল পথের ক্লান্তি। পাহাড়ের খাঁজে বসে ঝরনার পানির ভেতর পুরো শরীর ঢুকিয়ে দেওয়ার পর রোমাঞ্চকর এক অনুভূতিতে শিহরিত হলাম। অবশ্য এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। প্রবল বেগে ঝরে পরা পানি যেন পিঠের হাড়-গোড় ভেঙে দিবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হালকা বেগে ঝরা পানিতে চলে আসলাম। ফিরতি পথে ন-কাটা ঝরনায়ও গোসল করলাম। মূলত মুপ্পোছড়া থেকে গড়িয়ে আসা পানিই এখানে আরেকটি বড় ঝরনার সৃষ্টি করেছে। এখানে পানি ঝরে পড়ার বেগ আরও প্রবল।
দলের অন্যদের তুলনায় বেশ আগেই নৌকায় ফিরলাম আমরা ছ’জন। প্রায় ঘণ্টাখানেক নৌকার ছাউনীর উপর গা এলিয়ে শুয়ে থাকার ফুরসতও তাই মিললো। রাতে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরের কিছু অংশ হেঁটে দেখলাম। জায়গায় জায়গায় ট্যাপের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থাটা চমৎকার লেগেছে। সরকারি উদ্যোগে এত সুন্দর ব্যবস্থাপনা অন্য কোথাও চোখে পড়েনি। নৌকার ছাদে ইশার নামাজ পড়ার পর সেখানেই শুয়ে পড়েছিলাম। হালকা বাতাসে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু কুয়াশায় ভিজে যাওয়ায় পুরো রাত পার করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অগত্যা রুমে ফিরেই বেঘোর ঘুম।
ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়েই আবার নৌভ্রমণ। এবার উদ্দেশ্য—আকাঙ্ক্ষিত ধূপপানি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওড়াছড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম। ১০ টাকায় বাঁশের লাঠি কিনে সাথে পাহাড়ি গাইড নিয়ে শুরু হলো ট্রেকিং। বিভিন্ন ধানক্ষেতের আইলে কাঁদাময় পথ বেশ ভুগিয়েছে। ক্ষেত শেষে পাহাড়ি পথ অনেকটা খাড়া হলেও স্থানীয়রা মাটি সিঁড়ির মতো করে কেটে রাখায় রক্ষা। কষ্ট করে হলেও সবার পক্ষে উঠা সম্ভব। টানা তিনটি পাহাড় পেরুতে হয়। পুরো রাস্তাই এমন। প্রতিটি পাহাড়েই স্থানীয়রা শরবত, পানীয়, ফলমূল নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান সাজিয়ে বসে আছেন। তৃষ্ণার্ত পথিকের গলা ভেজাতে এগুলোর বিকল্প নেই। অনেক দিন পর ট্রেকিংয়ে যাওয়ায় বিশ্রাম নিতে হলো অনেক। পাশাপাশি শরীরও জানিয়ে দিচ্ছে হাড়-গোড়ের বয়স দিন দিন বাড়ছে! তবুও দলের প্রথম সারিতেই আছি—এটাই সাহস ও ভরসা।
ধূপপানি ঝরনায় পৌঁছানোর আগের পাহাড় থেকেই শোনা যায় প্রবল বেগে পানি ঝরে পড়ার শব্দ। ঢালে নামার আগে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখাও দেয় ঝরনা। দেখার পর সেখানে যাওয়ার আর তর সইছে না। কিন্তু প্রকৃতি বোধহয় অপেক্ষার পালা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নইলে এত খাড়া রাস্তা কেন? এখানেও স্থানীয়রা মাটি কেটে সিঁড়ির মতো ধাপ করে রাখলেও পথ এতটাই খাড়া যে, সেখান দিয়ে উঠানামা প্রায় অসম্ভব। তাই গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দিয়েছে স্থানীয়রা। ওই দড়ি ধরেই সাবধানে উঠানামা করতে হয়। নিচে নেমেও শান্তি নেই। এবার পাথুরে পিচ্ছিল ঝিরিপথ। একেবারে ঝরনার মুখে গিয়ে প্রকৃতি আবার পর্যটকদের পরীক্ষা নেয়! বড় বড় পাথর যেন পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। এদের ফাঁক গলে প্রায় হামাগুড়ির দিয়ে সামনে এগুতে হয়। এরপরই দেখা মিলবে বিশালাকৃতির ঝরনার। ঝরনার পানি বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পর্যটকদের গোসলের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
অনেক উঁচু থেকে সাদা সাদা পানির স্বচ্ছ কণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। জলকণার উপর যেখানেই সূর্যের আলো পড়ছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে রংধনু। উপরে-নিচে নানা দিকে রংধনুর খেলা। দেশের আর কোথাও এভাবে রংধনুর দেখা মেলে না। ক্যামেরায়ও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে এই রংধনুর খেলা। মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য যে একবার দেখবে সারা জীবন তা মনে থাকবে। ঝরনাটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক এর গুহা। ঝরনার পানির ভেতর দিয়ে গুহায় পৌঁছানো যায়। চোখের সামনে আছড়ে পড়ছে পানি, পেছনে গুহায় বসে নির্জনতার সঙ্গে উচ্ছলতার সংমিশ্রণ উপভোগ। অবিস্মরণীয় এক অনুভূতি! এই স্থান ও সময়ের সাথে নিজেকেও রঙিনভাবে সাজিয়ে ফ্রেমে ধরে রাখতে অনেকে অতিরিক্ত জামা-কাপড়ও নিয়ে যায়।
মন থাকতে চাইলেও সময় তো থেমে থাকে না। অগত্যা ফিরতি যাত্রা। মায়ায় আচ্ছন্ন এই ঝরনাকে একা রেখে ফেরাটাই দায়! ফেরার পথে মেঘের গর্জন। আল্লাহ্ আবার ধন্যবাদ দেই। দুইদিনের সুন্দর ভ্রমণ শেষের পর বৃষ্টির আভাস দেওয়ায়। কাপ্তাই লেকে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কোনো পাহাড়ে ট্রলার ভিড়িয়ে গোসলের ইচ্ছা থাকলেও সন্ধ্যা হওয়ায় সবারই ছিল ঘাটে পৌঁছানোর তাড়া। এ যাত্রায় লেকে গোসলের বাসনা তাই অপূর্ণই থেকে যাচ্ছিল। এত পূর্ণতার মাঝে এই অপূর্ণতাও থাকবে কেন? ট্রলার ছুটে চলা অবস্থায়ই দড়িতে বাঁধা বালতি দিয়ে পানি তুলে নৌকার উপরই সেরে নেই গোসল। দুইদিনের ক্লান্তি কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে জলাঞ্জলি দিয়ে চনমনে শরীরে বিদায় জানাই পাহাড়-হ্রদের সম্মিলনী লীলাভূমিকে।
লেখক: সাবেক সংবাদকর্মী
ঝরনাধারায় রংধনুর খেলা
মোহময় ধূপপানি
শাহনেওয়াজ খান
১৩ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৫৮:১০ | অনলাইন সংস্করণ
যারে দেখিবার বড় সাধ,
তার সাথে ভাগ্যের বিবাদ!
দান-দান তিন দানেও হলো না। তবুও হাল ছড়িনি। যেভাবেই হোক যাবই। অবশেষে ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়ল—সাক্ষাৎ হলো মোহময় ঝরনাধারা ধূপপানির সাথে! টানা তিনবার পরিকল্পনা করেও কোনো না কোনো কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি রাঙ্গামাটির ধূপপানিতে। অবশেষে সেই সাধ মিটলো এ বছরের সেপ্টেম্বরে এসে। ভাগ্য এবার এতটাই সহায় যে, যাওয়ার আগে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলো। বর্ষা মৌসুমের পরও তাই ঝরনায় ভরপুর পানি। অপরদিকে আমরা কাপ্তাই পৌঁছানোর আগের দিন থেকেই বৃষ্টি উধাও! একেবারে সোনায় সোহাগা—ঝরনায় পানি আছে, কিন্তু পাহাড়ে কাঁদা নেই।
বছর চারেক হলো দেশের সবকটি জেলা ভ্রমণের চক্র পূরণ করেছি। বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি একাধিকবার। কিন্তু কখনো কোনো ট্যুর অপারেটরের সাথে ভ্রমণ করা হয়নি। কয়েকজনের কাছ থেকে ভালো রিভিউ পাওয়ার পর এই প্রথম ‘পর্যটক বাংলাদেশ’ নামে একটি ট্যুর অপারেটরের সাথে ভ্রমণ করলাম। নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের রোমাঞ্চ শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু সেই পুরনো কাপ্তাই, সেই পুরনো লেক—বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই একাধিকবার যাওয়ার কারণে ভ্রমণপ্রিয় এই মনটায়ও রোমাঞ্চে কিঞ্চিৎ ভাটা অনুভব করছি! চারপাশে সারি সারি পাহাড়, মাঝে স্বচ্ছ সবুজ পানির হ্রদ, পানির বুক চিরে ছুটে চলছে ট্রলার। মনোমুগ্ধকর নৌভ্রমণের জন্য আর কী লাগে! তবুও মনে যেন রোমাঞ্চের ঘাটতি! অথচ প্রথমবার কাপ্তাই লেক ভ্রমণে এসে সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন পাহাড়ে নৌকা ভেড়ানো, পানিতে দাপাদাপি-গোসল। আহা! কত সুখস্মৃতি। এসব ভাবতে ভাবতে আল আমিনকে বললাম, দিন দিন ভ্রমণের রোমাঞ্চ কী কমে যাচ্ছে? ও হ্যাঁ, এবারও যথারীতি আমাদের একত্রিত করেছে আল আমিন। মূলত, ও আর আমি যৌথভাবে তিনবার ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ধূপপানি ভ্রমণ করছি।
ভ্রমণকালে বড় সুবিধা—ভ্রমণপ্রিয় মন নিজেই রোমাঞ্চ খুঁজে নেয়। বিলাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর রোমাঞ্চ যেন মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সেই বিলাইছড়ি উপজেলা। যার সীমানায় সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে ঝরে চলছে ধূপপানি। জাতীয় পরিচয়পত্র জমাদান ও যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে নৌযান ছাড়তেই উৎসুক মন প্রহর গোনা শুরু করেছে, কখন পৌঁছাব বিলাইছড়ি সদরে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা নৌভ্রমণ শেষে বিলাইছড়ি পৌঁছে কটেজে ব্যাগ রেখে শুরু হলো মুপ্পোছড়া, ন-কাটা ঝরনা দর্শনের প্রস্তুতি পর্ব। ভ্রমণের প্রথম দিন এটাই আমাদের গন্তব্য।
আবারও নৌযানে চেপে যাত্রা। আঁকাবাঁকা খাল পেরিয়ে বাঙ্গালকাটার পথে নোঙ্গর। শুরু হলো নিচু পথে হাঁটা। পাহাড়ি পথে পৌঁছানোর আগে স্থানীয় গাইড নিয়ে শুরু হয় মুপ্পোছড়া অভিযান। সমতল ও ঝিরি পেরিয়ে পাহাড়ি পথে শুধুই উপরে উঠা। খানিক বাদে নিচেও নামতে হচ্ছে; খানিক বাদে উঁচুতে। এভাবেই উঠানামা করতে করতে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ। বুঝলাম আশেপাশেই জলপ্রপাত। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলপ্রপাতের পানি আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর। এরপর পাথরের ফাঁক গলে বের করে নিচ্ছে পথ। এবার শুধু উঁচুতে উঠার পালা। পাহাড়ের সরু ও পিচ্ছিল পথ বেয়ে উপরে উঠছি আর একটু পরপরই মিলছে জলপ্রপাতের দেখা। পাথরময় উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে যে কতগুলো জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে তা মনে রাখাই দায়।
পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশের কাছে যেতেই মুপ্পোছড়া ঝরনার দেখা। পাহাড়ের একেবারে উপর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে বিভিন্ন পাহাড়ের খাঁজে। এক খাঁজ থেকে আরেক খাঁজে ধাক্কা লেগে গড়িয়ে পড়ছে নিচের অংশে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য! এমন ঝরনায় গোসল করার লোভ কে সামলাতে পারে? আমরাও পারিনি। শীতল পানিতে গা এলিয়ে দিতেই যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল পথের ক্লান্তি। পাহাড়ের খাঁজে বসে ঝরনার পানির ভেতর পুরো শরীর ঢুকিয়ে দেওয়ার পর রোমাঞ্চকর এক অনুভূতিতে শিহরিত হলাম। অবশ্য এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। প্রবল বেগে ঝরে পরা পানি যেন পিঠের হাড়-গোড় ভেঙে দিবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হালকা বেগে ঝরা পানিতে চলে আসলাম। ফিরতি পথে ন-কাটা ঝরনায়ও গোসল করলাম। মূলত মুপ্পোছড়া থেকে গড়িয়ে আসা পানিই এখানে আরেকটি বড় ঝরনার সৃষ্টি করেছে। এখানে পানি ঝরে পড়ার বেগ আরও প্রবল।
দলের অন্যদের তুলনায় বেশ আগেই নৌকায় ফিরলাম আমরা ছ’জন। প্রায় ঘণ্টাখানেক নৌকার ছাউনীর উপর গা এলিয়ে শুয়ে থাকার ফুরসতও তাই মিললো। রাতে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরের কিছু অংশ হেঁটে দেখলাম। জায়গায় জায়গায় ট্যাপের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থাটা চমৎকার লেগেছে। সরকারি উদ্যোগে এত সুন্দর ব্যবস্থাপনা অন্য কোথাও চোখে পড়েনি। নৌকার ছাদে ইশার নামাজ পড়ার পর সেখানেই শুয়ে পড়েছিলাম। হালকা বাতাসে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু কুয়াশায় ভিজে যাওয়ায় পুরো রাত পার করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অগত্যা রুমে ফিরেই বেঘোর ঘুম।
ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়েই আবার নৌভ্রমণ। এবার উদ্দেশ্য—আকাঙ্ক্ষিত ধূপপানি। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওড়াছড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম। ১০ টাকায় বাঁশের লাঠি কিনে সাথে পাহাড়ি গাইড নিয়ে শুরু হলো ট্রেকিং। বিভিন্ন ধানক্ষেতের আইলে কাঁদাময় পথ বেশ ভুগিয়েছে। ক্ষেত শেষে পাহাড়ি পথ অনেকটা খাড়া হলেও স্থানীয়রা মাটি সিঁড়ির মতো করে কেটে রাখায় রক্ষা। কষ্ট করে হলেও সবার পক্ষে উঠা সম্ভব। টানা তিনটি পাহাড় পেরুতে হয়। পুরো রাস্তাই এমন। প্রতিটি পাহাড়েই স্থানীয়রা শরবত, পানীয়, ফলমূল নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান সাজিয়ে বসে আছেন। তৃষ্ণার্ত পথিকের গলা ভেজাতে এগুলোর বিকল্প নেই। অনেক দিন পর ট্রেকিংয়ে যাওয়ায় বিশ্রাম নিতে হলো অনেক। পাশাপাশি শরীরও জানিয়ে দিচ্ছে হাড়-গোড়ের বয়স দিন দিন বাড়ছে! তবুও দলের প্রথম সারিতেই আছি—এটাই সাহস ও ভরসা।
ধূপপানি ঝরনায় পৌঁছানোর আগের পাহাড় থেকেই শোনা যায় প্রবল বেগে পানি ঝরে পড়ার শব্দ। ঢালে নামার আগে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখাও দেয় ঝরনা। দেখার পর সেখানে যাওয়ার আর তর সইছে না। কিন্তু প্রকৃতি বোধহয় অপেক্ষার পালা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নইলে এত খাড়া রাস্তা কেন? এখানেও স্থানীয়রা মাটি কেটে সিঁড়ির মতো ধাপ করে রাখলেও পথ এতটাই খাড়া যে, সেখান দিয়ে উঠানামা প্রায় অসম্ভব। তাই গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দিয়েছে স্থানীয়রা। ওই দড়ি ধরেই সাবধানে উঠানামা করতে হয়। নিচে নেমেও শান্তি নেই। এবার পাথুরে পিচ্ছিল ঝিরিপথ। একেবারে ঝরনার মুখে গিয়ে প্রকৃতি আবার পর্যটকদের পরীক্ষা নেয়! বড় বড় পাথর যেন পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। এদের ফাঁক গলে প্রায় হামাগুড়ির দিয়ে সামনে এগুতে হয়। এরপরই দেখা মিলবে বিশালাকৃতির ঝরনার। ঝরনার পানি বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পর্যটকদের গোসলের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
অনেক উঁচু থেকে সাদা সাদা পানির স্বচ্ছ কণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। জলকণার উপর যেখানেই সূর্যের আলো পড়ছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে রংধনু। উপরে-নিচে নানা দিকে রংধনুর খেলা। দেশের আর কোথাও এভাবে রংধনুর দেখা মেলে না। ক্যামেরায়ও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে এই রংধনুর খেলা। মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য যে একবার দেখবে সারা জীবন তা মনে থাকবে। ঝরনাটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক এর গুহা। ঝরনার পানির ভেতর দিয়ে গুহায় পৌঁছানো যায়। চোখের সামনে আছড়ে পড়ছে পানি, পেছনে গুহায় বসে নির্জনতার সঙ্গে উচ্ছলতার সংমিশ্রণ উপভোগ। অবিস্মরণীয় এক অনুভূতি! এই স্থান ও সময়ের সাথে নিজেকেও রঙিনভাবে সাজিয়ে ফ্রেমে ধরে রাখতে অনেকে অতিরিক্ত জামা-কাপড়ও নিয়ে যায়।
মন থাকতে চাইলেও সময় তো থেমে থাকে না। অগত্যা ফিরতি যাত্রা। মায়ায় আচ্ছন্ন এই ঝরনাকে একা রেখে ফেরাটাই দায়! ফেরার পথে মেঘের গর্জন। আল্লাহ্ আবার ধন্যবাদ দেই। দুইদিনের সুন্দর ভ্রমণ শেষের পর বৃষ্টির আভাস দেওয়ায়। কাপ্তাই লেকে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কোনো পাহাড়ে ট্রলার ভিড়িয়ে গোসলের ইচ্ছা থাকলেও সন্ধ্যা হওয়ায় সবারই ছিল ঘাটে পৌঁছানোর তাড়া। এ যাত্রায় লেকে গোসলের বাসনা তাই অপূর্ণই থেকে যাচ্ছিল। এত পূর্ণতার মাঝে এই অপূর্ণতাও থাকবে কেন? ট্রলার ছুটে চলা অবস্থায়ই দড়িতে বাঁধা বালতি দিয়ে পানি তুলে নৌকার উপরই সেরে নেই গোসল। দুইদিনের ক্লান্তি কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে জলাঞ্জলি দিয়ে চনমনে শরীরে বিদায় জানাই পাহাড়-হ্রদের সম্মিলনী লীলাভূমিকে।
লেখক: সাবেক সংবাদকর্মী
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023