ভাইরাল নাকি ব্যাকটেরিয়াল জ্বর বোঝার উপায়
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জ্বর মানে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। শরীরে জীবাণু ঢুকে পড়লে শরীর নিজেকে রক্ষা করতে ভেতরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যাতে করে অনুপ্রবেশকারী জীবাণুটির জন্য পরিবেশটি কম আরামদায়ক হয়। পরিবেশ অনুকূল হলে জীবাণুটি সহজে বংশ বিস্তার করে শরীরকে আক্রমণ করতে পারে। শরীর তাই জীবাণুর বিপক্ষে পরিবেশকে প্রতিকূল করতে জীবাণুর চারপাশে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটাই জ্বর।
এ অনুপ্রবেশকারী জীবাণু দুধরনের হতে পারে। ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়া। শরীরে ঢুকলে দুজনেই তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তার মানে জ্বর আসে। তাহলে জ্বরের ওষুধ খেলেই তো জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার চিকিৎসার পথ একই নয়।
ভাইরাল জ্বর হলে বেশিরভাগ সময় বিশ্রাম এবং যত্নই যথেষ্ট; ব্যাকটেরিয়াল হলে প্রয়োজন হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক।
সমস্যাটা হয় সেখানেই, কী করে বুঝবেন আপনার জ্বর কোন দলে পড়ে? ভাইরাসের নাকি ব্যাকটেরিয়ার কারণে?
জ্বর মানেই খারাপ কিছু নয়। জ্বর একটি সতর্কবার্তা। জ্বর হওয়া মানে শরীর বলছে-আমি লড়ছি। এ লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ যদি ভাইরাস হয়, তাহলে সাধারণত লক্ষণগুলো একটু ছড়িয়ে থাকার মতো হয়, শরীরজুড়ে যেন হয়। নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি, গলা খুসখুস, হালকা থেকে মাঝারি কাশি, শরীর ব্যথা, ক্লান্ত লাগা। অনেক সময় চোখ দিয়ে পানি পড়ে, গলা শুকনা শুকনা লাগে , মাথা ধরে, এসবও থাকে। বেশিরভাগ ভাইরাল জ্বরে দুই-তিন দিনের মাথায় একটু একটু করে ভালোর দিকে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে চতুর্থ বা পঞ্চম দিনের বেশি লেগে যেতে পারে।
এখানে একটা ভুল ধারণা রয়েছে। কম বা মাঝারি জ্বর হলেই ভাইরাল, আর বেশি জ্বর হলে ব্যাকটেরিয়াল, এটা ঠিক নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাল রোগেও জ্বর বেশ উঁচুতে উঠতে পারে। তাই শুধু থার্মোমিটারের সংখ্যার ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন না।
ব্যাকটেরিয়াল হলে জ্বরের পাশাপাশি অন্য সমস্যাগুলো যেন এক জায়গায় বেশি প্রকাশ পায়। গলায় খুব ব্যথা করছে, টনসিল ফুলে গেছে, গিলতে কষ্ট হচ্ছে, মুখের ভেতর সাদা-সাদা দাগ দেখা দিয়েছে, এগুলো ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে। অথবা নাক-মুখ ভারী অনুভব করছেন, মুখমণ্ডল বিশেষ করে গালের হাড়ের পাশের অংশে চাপ দিলে ব্যথা করে, এমনকি সাইনাসে ব্যাকটেরিয়া বাসা বেঁধেছে বলে ধরে নিতে পারেন। আবার কানে ব্যথা করছে, এমনকি হালকা পুঁজও হয়েছে, এগুলোও ব্যাকটেরিয়া কানের সংক্রমণে দেখা যায়। বুকে কফ জমে গিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দম নিতে গেলে ব্যথা লাগছে, এগুলো হলে ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ভাবা যেতে পারে। প্রস্রাবে জ্বালা করা, বারবার প্রস্রাব, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ বা ধূসরতা দেখা যাওয়া, এগুলো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে। ত্বকে লাল, উষ্ণ, ফুলে থাকা, ব্যথাযুক্ত ফোড়া, এগুলোও ব্যাকটেরিয়াল আক্রমণে হয়ে থাকে।
লক্ষ করলেন তো? ব্যাকটেরিয়ার লক্ষণ অনেক সময় শরীরের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হতে থাকে। ভাইরাসের ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে লক্ষণগুলো।
এখন এ লক্ষণগুলো নিয়ে একটি সময়রেখা আঁকি। জ্বরটি কখন শুরু হলো? শুরুটা কি হঠাৎ, নাকি ধীরে ধীরে? প্রথম দুদিন খারাপ, তারপর তৃতীয় দিনে একটু ভালো এটা ভাইরাস জ্বরের মতো। কিন্তু যদি তৃতীয়-চতুর্থ দিনে হঠাৎ আবার বেশি খারাপ হয়ে যায়, যাকে আমরা বলি দ্বিতীয় ঢেউ, তাহলে ভাববেন, প্রথমে ভাইরাস ছিল, পরে তার ওপর সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া এসে বসেছে।
এ সময় অনেকে ভুল করে। নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করে। মনে রাখবেন, নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করা ঠিক নয়। এতে ভবিষ্যতে ব্যাকটেরিয়া শরীরের প্রতিরোধের ভাষা শিখে ফেলে, যাকে আমরা বলি রেজিস্ট্যান্স। এ রেজিস্ট্যান্স তৈরি হলে ভবিষ্যতে আপনার শরীরে সেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে কম।
আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, সাধারণ সর্দি-কাশি, নাক ঝরা, গলা খুসখুস, শরীর ব্যথা, হালকা মাথাব্যথা-এ চেনা ভাইরাল ছবিটা থাকলে বিশ্রাম নিন, বেশি করে পানি খান, জ্বর বেশি অনুভব করলে প্যারাসিটামল খেতে পারেন, গরম পানির ভাপ নিন, নাকের জন্য স্যালাইন স্প্রে ব্যবহার করুন।
এমনটি করার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃতীয় দিনের শেষে উন্নতির কিছু ইঙ্গিত পাবেন। জ্বরের উচ্চতা একটু নেমে আসবে, শরীরের ব্যথা কিছুটা কমে যাবে, শক্তি একটু ফিরতে থাকবে। যদি এমন না আসে, বরং নতুন করে শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা, কানে তীব্র ব্যথা, প্রস্রাবে জ্বালা, বা মুখমণ্ডলে তীব্র সাইনাস ব্যথা যোগ হয়, তাহলে আর দেরি করবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু ভিন্ন। তিন মাসের কম বয়সি শিশুর যে কোনো জ্বরই জরুরি বিবেচনায় রাখবেন। খুব নীরব হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমঘুম, শ্বাস নিতে কষ্ট, হাত-পা ঠান্ডা, খাওয়া-দাওয়া একেবারে না করা, এসব হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিন বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। গর্ভবতী, বয়স্ক, ডায়াবেটিস বা কিডনি-লিভারের দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে এমন ব্যক্তি বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, জ্বর হলে তাদের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
এবার কিছু পরীক্ষার কথা বলি। সবার কি পরীক্ষা লাগে? না, ভাইরাসের কারণে জ্বর হলে, দু-তিন দিন পর ভালোর দিকে গেলে, পরীক্ষা ছাড়াই সেরে যায় জ্বর। কিন্তু সন্দেহ যদি ব্যাকটেরিয়ার দিকে যায়, বা অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়, বা জটিলতাযুক্ত হয়, তখন শরীরের কিছু টেস্ট করা প্রয়োজন পড়ে। রক্তের সাধারণ পরীক্ষা সিবিসিতে নিউট্রোফিল বেড়ে গেলে ব্যাকটেরিয়ার কারণে ধরা যায়, আর লিম্ফোসাইট বেড়ে গেলে ভাইরাসের কথা ভাবতে পারেন। সিআরপি বেশি হলে ব্যাকটেরিয়ার কারণ ধরে নিতে পারেন। প্রোক্যালসিটোনিন নামে আরেকটি পরীক্ষাও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে বেড়ে যায়। এ দুটি পরীক্ষা তুলনামূলক ভালো সূচক হিসাবে ব্যবহৃত হয় বেশি। আবার গলা ব্যথায় থ্রোট সোয়াব টেস্ট, প্রস্রাবের সমস্যায় ইউরিন ডিপস্টিক ও কালচার, বুকের সমস্যায় চেস্ট এক্স-রে, এবং ভাইরাস নিশ্চিত করতে নাক-গলার সোয়াব পিসিআর টেস্ট করে বুঝতে পারেন। এসব পরীক্ষার ফল আর আপনার জ্বরের ইতিহাস, এ দুটো মিলে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন-অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে কি না, লাগলে কোনটা এবং কত দিন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক
opurbo.chowdhury@gmail.com
