এগারো শতকের শেষ থেকে গোটা বারো শতক বাংলা বহিরাগত ব্রাহ্মণ সেনবংশীয় রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বেআইনিভাবে রাজ্য দখল করায় তাদের মনে ভীতি ছিল- যদি দেশবাসী রুখে দাঁড়ায়। তাই শ্রেণীবৈষম্য তৈরি করে সাধারণ মানুষকে চাপে রাখতে চেয়েছিল। সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত করে রেখেছিল। চার বর্ণের সবার উপরে ছিলেন শাসক ব্রাহ্মণরা। সমুদয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা তাদের হাতে কুক্ষিগত ছিল। দ্বিতীয় ক্ষমতাভোগীরা ক্ষত্রিয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর লোকজন। এরাও বাঙালি নন। অস্ত্রশক্তি থাকায় সুবিধার ফসল এদের ঘরে তুলে দেয়া হয়। আর ধনী ব্যবসায়ী ও বড় জমিদার-জোতদাররা উপাধি পান বৈশ্য। টাকাকড়ি থাকায় মর্যাদাও ছিল। তবে কোনো অধিকার দেয়া হয়নি আমজনতাকে। কারণ সংকটে, অধিকার আদায়ে এরাই প্রতিবাদ করে। এদেরই চার বর্ণের সর্বনিন্ম স্তরে রাখা হল। পরিচিতি পেল শূদ্র নামে।
অনেক কিছুর মতোই শূদ্রের চিকিৎসার দায় নেননি সেন রাজারা। খেয়ে না-খেয়ে থাকা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষীণ দশার শূদ্র অসুস্থ হলে গ্রামের বদ্যি জরি-বুটি দিত। বাঁচলে বাঁচত মরলে মরত। কে তার খবর রাখে! এ প্রেক্ষাপটেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য সুফি-সাধকরা আসতে থাকেন। তারা সাধারণ মানুষের কষ্টটা উপলব্ধি করে মানবতার বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেন। খানকাহ স্থাপন করে সেখানে অবহেলিত মানুষের অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দিতে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করতেন। হাকিম সাহেবদের নিয়ে হাসপাতাল তৈরি করতেন। অসহায় অসুস্থ শূদ্রকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন। ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার পেছনে এ মানবিকতার ভূমিকা ছিল।
এ একুশ শতকে এসে যখন উন্নয়নের জয়গান শুনছি- নির্বাচনের মৌসুমে আরও শুনব, তখনই দেখছি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন আঙ্গিকে চতুঃবর্ণ বিভাজন স্পষ্ট রয়েছে। এখন নতুন নামে নতুন অবয়বে রাষ্ট্রে ও সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র রয়েছে। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারেও তাই এত রকমফের।
মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের সচেতন বিবেকের অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিদিন অন্যায় তো কম হচ্ছে না। প্রতিবাদ করছি কোথায়? রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমাদের মন্ত্রীরা অনেকে প্রতিদিন এত শব্দদূষণ করেন; কিন্তু ব্যক্তিগত দায় বা লজ্জায় হয়তো দুর্নীতি নিয়ে তেমন কথা বলেন না। শুধু ছিদ্রান্বেষণ করেন প্রতিপক্ষের। আবার বিরোধী দলের নেতারা শব্দবোমা ছুড়ছেন প্রতিনিয়ত। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর অন্যায় নিয়ে কথা বলছেন। শুনে মনে হচ্ছে তাদের চেয়ে পূতপবিত্র আর কেউ নেই। ক’দিন আগেও তাদের অনেকের দুর্নীতির ভাড়ার যে পূর্ণ ছিল তা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। ক্ষমা ভিক্ষার সংস্কৃতি তো নেই-ই। উভয় পক্ষ একে অন্যকে যেভাবে দুর্নীতিবাজের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকা রাজনীতিকরা যেন স্বঘোষিত দুর্নীতিবাজ। এমন বাস্তবতায় তবুও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় মহামান্য আদালতকে। মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন।
রাজধানীতে একজন প্রসূতি মায়ের ওপর অমানবিক নিবর্তন চালানোর পর শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে উন্মুক্ত চত্বরে অবহেলায় সন্তান প্রসব করতে হল। অযত্নে মারাও গেল নবজাতক। কোনো সভ্যসমাজের ছবি এমন হতে পারে না। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় আর মিডিয়ার তৎপরতায় আলোতে এসেছে ঘটনাটি। জানি না আলোর বাইরে এমন ঘটনা কত ঘটে! এ মর্মান্তিক ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল আমাদের দেশের ক্ষমতার আধিকারিকরা আচরণে এখনও সেন ব্রাহ্মণ। আর দরিদ্র সাধারণ মানুষ এ যুগের শূদ্র। তাদের চিকিৎসার দায় নিতে আবার মানবতাবাদী সুফি-সাধকদের আসতে হবে হয়তো।
ভাবা যায়, এ উন্নয়নের জোয়ারের দেশে রাজধানীর এক দরিদ্র গর্ভধারিণী প্রসববেদনা নিয়ে শ্রেষ্ঠ সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষায় দেখলেন সিজার করতে হবে। গরিব রোগীর টাকা-পয়সা নেই তাই প্রসববেদনায় ছটফট করা এ যুগের শূদ্র রমণীকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বের করে দেয়া হল। দুর্ভাগা রমণীর পরিচিত ভ্যানচালক ছেলেটি দ্রুত নিয়ে এলো ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। ১৫০০ টাকা হাসপাতাল চার্জ দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় প্রসববেদনায় কাতর অসহায় মহিলাকে বিদায় করে দেয়া হল। কথাটি শুনে আমার মনে পড়ল স্যার মিটফোর্ডের কথা। ঢাকার কালেক্টরের চাকরি করতে এসে বিনা চিকিৎসায় কলেরা রোগীদের মারা যেতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে ইংল্যান্ডে বসে নিজের সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন যাতে ঢাকায় আধুনিক হসপিটাল বানানো হয়। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর সেদিনের মিটফোর্ড হাসপাতালের। আর সেই হাসপাতালে আজ মানবতার এতটা অসম্মান! অগত্যা ভ্যানচালক দুস্থ মহিলাকে নিয়ে এলো গরিবের আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আজিমপুর মাতৃসদনে। সেখানে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন না করায়, কার্ড না থাকায় সেবা পেলেন না। দোতলা থেকে টেনেহিঁচড়ে আয়া নামিয়ে দিল। ততক্ষণে মায়ের জঠর থেকে পৃথিবীতে আসার জন্য উন্মুখ শিশুটি। খোলা চত্বরে নিতান্ত অবহেলায় ভূমিষ্ঠ হল একটি অভাগা মানবসন্তান। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। সমাজকে ধিক্কার দিয়ে একবুক অভিমান নিয়ে নষ্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। পুরোটাই যেন সিনেমার ট্র্যাজিক সিন। কলকাতার বাংলা ছবিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় ক্যাশে টাকা জমা না দিতে পারায় মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেখে ভাবতাম এ বুঝি চলচ্চিত্রের বাড়াবাড়ি। অথবা বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্য। এবার আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো ভাবনার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিল।
মাননীয় আদালত এ প্রসঙ্গে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেমন, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন করেছে। ...রাষ্ট্র লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীকে সেবা দিচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের ভেতরে কী হচ্ছে? গরিব জনগোষ্ঠী আজ নিগৃহীত। হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করছে। এটি দুঃখজনক। সরকারের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
আদালত আরও বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা পেল না! মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকার জন্য রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হল। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে নবজাতকও মারা গেল। এটি অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় অপরাধ।’
খোঁজ করলে এ জাতীয় অন্যায়ের খতিয়ান দিয়ে কণ্টক মালাগাঁথা যাবে। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা গেল হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে সিস্টার নবজাতকের মায়ের কাছ থেকে দাবিমতো ২০০ টাকা না পাওয়ায় প্রসূতিকে মারধর করে নবজাতকের হাতের স্যালাইন খুলে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। এক জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের বড় কর্তা আজিমপুর মাতৃসদনের ঘটনায় দায় চাপাচ্ছেন আয়ার ওপর। ভাষ্যমতে এ আয়া নয়, অন্য হাসপাতালের দালাল। কিন্তু আসন্ন সন্তানসম্ভবা নারীকে বের করে দেয়ার বিষয়টি মাতৃসদনের দায়িত্ববানদের নজরে এলো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো তারা এ নারীকে পরীক্ষা করেছেন। আবার হবিগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তার-ব্যবস্থাপক থাকার পরও একজন সিস্টার অমন দুর্বৃত্ত আচরণ কীভাবে করতে পারে সে প্রশ্নেরও সুরাহা হল না। এসব মর্মান্তিক চিত্র দেখার পর আমরা যে খুব এগিয়েছি বলে বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপাই তা শুনতে আর রুচি হয় না।
এ দেশের ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণদের জন্য দেশে-বিদেশে সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষত্রিয়দের তো চিকিৎসার চমৎকার ব্যবস্থাপনা আছে। রাজনীতিবিদ, বড় আমলা, ব্যবসায়ী- সব টাকাওয়ালা বৈশ্যরা দেশের নামি বেসরকারি হাসপাতাল আর বিদেশে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে পারেন সহজেই। শুধু দেশে নিয়তির ওপর ভরসা করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন আমজনতা শূদ্ররা। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার দুঃসাহস নেই এদের। টাকা নেই বলে সরকারি হাসপাতাল থেকেও বিতাড়িত হন তারা।
আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি একটু ভাবতে পারেন না দায়িত্ববানরা? হাসপাতালে বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা থাকতে পারে, যাতে পকেটে টাকা না থাকলে হতদরিদ্রকে বিতাড়িত হতে না হয়। আজিমপুর মাতৃসদনে রেজিস্ট্রেশন করা, কার্ড করার বিধান আছে মানছি; কিন্তু এই অভাগা নারীর মতো রেজিস্ট্রেশন ও কার্ড ছাড়া হঠাৎ সংকটে পড়া মানুষের চিকিৎসার দরজা বন্ধ থাকবে কেন? নিজেরা বড় মানুষ, বিদেশে চিকিৎসা করে সুস্থ থাকুন। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই তাতে অমত করবে না। কারণ তারা বড় মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেয়া দেখে মেনে নিয়েছে তাদের উপযোগী এ দেশে ভালো চিকিৎসাসেবা নেই, ডাক্তার নেই। এ মান্যবররা ভালো না থাকলে দেশ চালাবেন কে! রাজনীতি এগিয়ে নেবেন কারা? তাই জনস্বার্থেই দেশ-বিদেশে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাই বলে ‘দুর্বল’ ডাক্তারদের অধীনে ‘নড়বড়ে’ হাসপাতালগুলোতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার কিছুটা সুযোগ রাখা কি যায় না? না এ দাবি করা খুব অন্যায় হবে? না হলে দায়িত্ববানরা বলে দিন এ যুগের শূদ্ররা কোথায় চিকিৎসা পাবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
অনেক কিছুর মতোই শূদ্রের চিকিৎসার দায় নেননি সেন রাজারা। খেয়ে না-খেয়ে থাকা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষীণ দশার শূদ্র অসুস্থ হলে গ্রামের বদ্যি জরি-বুটি দিত। বাঁচলে বাঁচত মরলে মরত। কে তার খবর রাখে! এ প্রেক্ষাপটেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য সুফি-সাধকরা আসতে থাকেন। তারা সাধারণ মানুষের কষ্টটা উপলব্ধি করে মানবতার বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেন। খানকাহ স্থাপন করে সেখানে অবহেলিত মানুষের অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দিতে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করতেন। হাকিম সাহেবদের নিয়ে হাসপাতাল তৈরি করতেন। অসহায় অসুস্থ শূদ্রকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন। ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার পেছনে এ মানবিকতার ভূমিকা ছিল।
এ একুশ শতকে এসে যখন উন্নয়নের জয়গান শুনছি- নির্বাচনের মৌসুমে আরও শুনব, তখনই দেখছি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন আঙ্গিকে চতুঃবর্ণ বিভাজন স্পষ্ট রয়েছে। এখন নতুন নামে নতুন অবয়বে রাষ্ট্রে ও সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র রয়েছে। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারেও তাই এত রকমফের।
মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের সচেতন বিবেকের অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিদিন অন্যায় তো কম হচ্ছে না। প্রতিবাদ করছি কোথায়? রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমাদের মন্ত্রীরা অনেকে প্রতিদিন এত শব্দদূষণ করেন; কিন্তু ব্যক্তিগত দায় বা লজ্জায় হয়তো দুর্নীতি নিয়ে তেমন কথা বলেন না। শুধু ছিদ্রান্বেষণ করেন প্রতিপক্ষের। আবার বিরোধী দলের নেতারা শব্দবোমা ছুড়ছেন প্রতিনিয়ত। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর অন্যায় নিয়ে কথা বলছেন। শুনে মনে হচ্ছে তাদের চেয়ে পূতপবিত্র আর কেউ নেই। ক’দিন আগেও তাদের অনেকের দুর্নীতির ভাড়ার যে পূর্ণ ছিল তা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। ক্ষমা ভিক্ষার সংস্কৃতি তো নেই-ই। উভয় পক্ষ একে অন্যকে যেভাবে দুর্নীতিবাজের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকা রাজনীতিকরা যেন স্বঘোষিত দুর্নীতিবাজ। এমন বাস্তবতায় তবুও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় মহামান্য আদালতকে। মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন।
রাজধানীতে একজন প্রসূতি মায়ের ওপর অমানবিক নিবর্তন চালানোর পর শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে উন্মুক্ত চত্বরে অবহেলায় সন্তান প্রসব করতে হল। অযত্নে মারাও গেল নবজাতক। কোনো সভ্যসমাজের ছবি এমন হতে পারে না। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় আর মিডিয়ার তৎপরতায় আলোতে এসেছে ঘটনাটি। জানি না আলোর বাইরে এমন ঘটনা কত ঘটে! এ মর্মান্তিক ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল আমাদের দেশের ক্ষমতার আধিকারিকরা আচরণে এখনও সেন ব্রাহ্মণ। আর দরিদ্র সাধারণ মানুষ এ যুগের শূদ্র। তাদের চিকিৎসার দায় নিতে আবার মানবতাবাদী সুফি-সাধকদের আসতে হবে হয়তো।
ভাবা যায়, এ উন্নয়নের জোয়ারের দেশে রাজধানীর এক দরিদ্র গর্ভধারিণী প্রসববেদনা নিয়ে শ্রেষ্ঠ সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষায় দেখলেন সিজার করতে হবে। গরিব রোগীর টাকা-পয়সা নেই তাই প্রসববেদনায় ছটফট করা এ যুগের শূদ্র রমণীকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বের করে দেয়া হল। দুর্ভাগা রমণীর পরিচিত ভ্যানচালক ছেলেটি দ্রুত নিয়ে এলো ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। ১৫০০ টাকা হাসপাতাল চার্জ দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় প্রসববেদনায় কাতর অসহায় মহিলাকে বিদায় করে দেয়া হল। কথাটি শুনে আমার মনে পড়ল স্যার মিটফোর্ডের কথা। ঢাকার কালেক্টরের চাকরি করতে এসে বিনা চিকিৎসায় কলেরা রোগীদের মারা যেতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে ইংল্যান্ডে বসে নিজের সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন যাতে ঢাকায় আধুনিক হসপিটাল বানানো হয়। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর সেদিনের মিটফোর্ড হাসপাতালের। আর সেই হাসপাতালে আজ মানবতার এতটা অসম্মান! অগত্যা ভ্যানচালক দুস্থ মহিলাকে নিয়ে এলো গরিবের আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আজিমপুর মাতৃসদনে। সেখানে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন না করায়, কার্ড না থাকায় সেবা পেলেন না। দোতলা থেকে টেনেহিঁচড়ে আয়া নামিয়ে দিল। ততক্ষণে মায়ের জঠর থেকে পৃথিবীতে আসার জন্য উন্মুখ শিশুটি। খোলা চত্বরে নিতান্ত অবহেলায় ভূমিষ্ঠ হল একটি অভাগা মানবসন্তান। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। সমাজকে ধিক্কার দিয়ে একবুক অভিমান নিয়ে নষ্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। পুরোটাই যেন সিনেমার ট্র্যাজিক সিন। কলকাতার বাংলা ছবিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় ক্যাশে টাকা জমা না দিতে পারায় মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেখে ভাবতাম এ বুঝি চলচ্চিত্রের বাড়াবাড়ি। অথবা বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্য। এবার আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো ভাবনার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিল।
মাননীয় আদালত এ প্রসঙ্গে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেমন, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন করেছে। ...রাষ্ট্র লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীকে সেবা দিচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের ভেতরে কী হচ্ছে? গরিব জনগোষ্ঠী আজ নিগৃহীত। হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করছে। এটি দুঃখজনক। সরকারের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
আদালত আরও বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা পেল না! মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকার জন্য রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হল। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে নবজাতকও মারা গেল। এটি অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় অপরাধ।’
খোঁজ করলে এ জাতীয় অন্যায়ের খতিয়ান দিয়ে কণ্টক মালাগাঁথা যাবে। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা গেল হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে সিস্টার নবজাতকের মায়ের কাছ থেকে দাবিমতো ২০০ টাকা না পাওয়ায় প্রসূতিকে মারধর করে নবজাতকের হাতের স্যালাইন খুলে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। এক জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের বড় কর্তা আজিমপুর মাতৃসদনের ঘটনায় দায় চাপাচ্ছেন আয়ার ওপর। ভাষ্যমতে এ আয়া নয়, অন্য হাসপাতালের দালাল। কিন্তু আসন্ন সন্তানসম্ভবা নারীকে বের করে দেয়ার বিষয়টি মাতৃসদনের দায়িত্ববানদের নজরে এলো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো তারা এ নারীকে পরীক্ষা করেছেন। আবার হবিগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তার-ব্যবস্থাপক থাকার পরও একজন সিস্টার অমন দুর্বৃত্ত আচরণ কীভাবে করতে পারে সে প্রশ্নেরও সুরাহা হল না। এসব মর্মান্তিক চিত্র দেখার পর আমরা যে খুব এগিয়েছি বলে বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপাই তা শুনতে আর রুচি হয় না।
এ দেশের ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণদের জন্য দেশে-বিদেশে সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষত্রিয়দের তো চিকিৎসার চমৎকার ব্যবস্থাপনা আছে। রাজনীতিবিদ, বড় আমলা, ব্যবসায়ী- সব টাকাওয়ালা বৈশ্যরা দেশের নামি বেসরকারি হাসপাতাল আর বিদেশে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে পারেন সহজেই। শুধু দেশে নিয়তির ওপর ভরসা করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন আমজনতা শূদ্ররা। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার দুঃসাহস নেই এদের। টাকা নেই বলে সরকারি হাসপাতাল থেকেও বিতাড়িত হন তারা।
আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি একটু ভাবতে পারেন না দায়িত্ববানরা? হাসপাতালে বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা থাকতে পারে, যাতে পকেটে টাকা না থাকলে হতদরিদ্রকে বিতাড়িত হতে না হয়। আজিমপুর মাতৃসদনে রেজিস্ট্রেশন করা, কার্ড করার বিধান আছে মানছি; কিন্তু এই অভাগা নারীর মতো রেজিস্ট্রেশন ও কার্ড ছাড়া হঠাৎ সংকটে পড়া মানুষের চিকিৎসার দরজা বন্ধ থাকবে কেন? নিজেরা বড় মানুষ, বিদেশে চিকিৎসা করে সুস্থ থাকুন। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই তাতে অমত করবে না। কারণ তারা বড় মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেয়া দেখে মেনে নিয়েছে তাদের উপযোগী এ দেশে ভালো চিকিৎসাসেবা নেই, ডাক্তার নেই। এ মান্যবররা ভালো না থাকলে দেশ চালাবেন কে! রাজনীতি এগিয়ে নেবেন কারা? তাই জনস্বার্থেই দেশ-বিদেশে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাই বলে ‘দুর্বল’ ডাক্তারদের অধীনে ‘নড়বড়ে’ হাসপাতালগুলোতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার কিছুটা সুযোগ রাখা কি যায় না? না এ দাবি করা খুব অন্যায় হবে? না হলে দায়িত্ববানরা বলে দিন এ যুগের শূদ্ররা কোথায় চিকিৎসা পাবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
শূদ্ররা কোথায় পাবে চিকিৎসা?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
এগারো শতকের শেষ থেকে গোটা বারো শতক বাংলা বহিরাগত ব্রাহ্মণ সেনবংশীয় রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বেআইনিভাবে রাজ্য দখল করায় তাদের মনে ভীতি ছিল- যদি দেশবাসী রুখে দাঁড়ায়। তাই শ্রেণীবৈষম্য তৈরি করে সাধারণ মানুষকে চাপে রাখতে চেয়েছিল। সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত করে রেখেছিল। চার বর্ণের সবার উপরে ছিলেন শাসক ব্রাহ্মণরা। সমুদয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা তাদের হাতে কুক্ষিগত ছিল। দ্বিতীয় ক্ষমতাভোগীরা ক্ষত্রিয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর লোকজন। এরাও বাঙালি নন। অস্ত্রশক্তি থাকায় সুবিধার ফসল এদের ঘরে তুলে দেয়া হয়। আর ধনী ব্যবসায়ী ও বড় জমিদার-জোতদাররা উপাধি পান বৈশ্য। টাকাকড়ি থাকায় মর্যাদাও ছিল। তবে কোনো অধিকার দেয়া হয়নি আমজনতাকে। কারণ সংকটে, অধিকার আদায়ে এরাই প্রতিবাদ করে। এদেরই চার বর্ণের সর্বনিন্ম স্তরে রাখা হল। পরিচিতি পেল শূদ্র নামে।
অনেক কিছুর মতোই শূদ্রের চিকিৎসার দায় নেননি সেন রাজারা। খেয়ে না-খেয়ে থাকা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষীণ দশার শূদ্র অসুস্থ হলে গ্রামের বদ্যি জরি-বুটি দিত। বাঁচলে বাঁচত মরলে মরত। কে তার খবর রাখে! এ প্রেক্ষাপটেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য সুফি-সাধকরা আসতে থাকেন। তারা সাধারণ মানুষের কষ্টটা উপলব্ধি করে মানবতার বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেন। খানকাহ স্থাপন করে সেখানে অবহেলিত মানুষের অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দিতে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করতেন। হাকিম সাহেবদের নিয়ে হাসপাতাল তৈরি করতেন। অসহায় অসুস্থ শূদ্রকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন। ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার পেছনে এ মানবিকতার ভূমিকা ছিল।
এ একুশ শতকে এসে যখন উন্নয়নের জয়গান শুনছি- নির্বাচনের মৌসুমে আরও শুনব, তখনই দেখছি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন আঙ্গিকে চতুঃবর্ণ বিভাজন স্পষ্ট রয়েছে। এখন নতুন নামে নতুন অবয়বে রাষ্ট্রে ও সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র রয়েছে। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারেও তাই এত রকমফের।
মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের সচেতন বিবেকের অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিদিন অন্যায় তো কম হচ্ছে না। প্রতিবাদ করছি কোথায়? রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমাদের মন্ত্রীরা অনেকে প্রতিদিন এত শব্দদূষণ করেন; কিন্তু ব্যক্তিগত দায় বা লজ্জায় হয়তো দুর্নীতি নিয়ে তেমন কথা বলেন না। শুধু ছিদ্রান্বেষণ করেন প্রতিপক্ষের। আবার বিরোধী দলের নেতারা শব্দবোমা ছুড়ছেন প্রতিনিয়ত। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর অন্যায় নিয়ে কথা বলছেন। শুনে মনে হচ্ছে তাদের চেয়ে পূতপবিত্র আর কেউ নেই। ক’দিন আগেও তাদের অনেকের দুর্নীতির ভাড়ার যে পূর্ণ ছিল তা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। ক্ষমা ভিক্ষার সংস্কৃতি তো নেই-ই। উভয় পক্ষ একে অন্যকে যেভাবে দুর্নীতিবাজের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকা রাজনীতিকরা যেন স্বঘোষিত দুর্নীতিবাজ। এমন বাস্তবতায় তবুও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় মহামান্য আদালতকে। মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন।
রাজধানীতে একজন প্রসূতি মায়ের ওপর অমানবিক নিবর্তন চালানোর পর শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে উন্মুক্ত চত্বরে অবহেলায় সন্তান প্রসব করতে হল। অযত্নে মারাও গেল নবজাতক। কোনো সভ্যসমাজের ছবি এমন হতে পারে না। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় আর মিডিয়ার তৎপরতায় আলোতে এসেছে ঘটনাটি। জানি না আলোর বাইরে এমন ঘটনা কত ঘটে! এ মর্মান্তিক ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল আমাদের দেশের ক্ষমতার আধিকারিকরা আচরণে এখনও সেন ব্রাহ্মণ। আর দরিদ্র সাধারণ মানুষ এ যুগের শূদ্র। তাদের চিকিৎসার দায় নিতে আবার মানবতাবাদী সুফি-সাধকদের আসতে হবে হয়তো।
ভাবা যায়, এ উন্নয়নের জোয়ারের দেশে রাজধানীর এক দরিদ্র গর্ভধারিণী প্রসববেদনা নিয়ে শ্রেষ্ঠ সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষায় দেখলেন সিজার করতে হবে। গরিব রোগীর টাকা-পয়সা নেই তাই প্রসববেদনায় ছটফট করা এ যুগের শূদ্র রমণীকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বের করে দেয়া হল। দুর্ভাগা রমণীর পরিচিত ভ্যানচালক ছেলেটি দ্রুত নিয়ে এলো ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। ১৫০০ টাকা হাসপাতাল চার্জ দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় প্রসববেদনায় কাতর অসহায় মহিলাকে বিদায় করে দেয়া হল। কথাটি শুনে আমার মনে পড়ল স্যার মিটফোর্ডের কথা। ঢাকার কালেক্টরের চাকরি করতে এসে বিনা চিকিৎসায় কলেরা রোগীদের মারা যেতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে ইংল্যান্ডে বসে নিজের সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন যাতে ঢাকায় আধুনিক হসপিটাল বানানো হয়। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর সেদিনের মিটফোর্ড হাসপাতালের। আর সেই হাসপাতালে আজ মানবতার এতটা অসম্মান! অগত্যা ভ্যানচালক দুস্থ মহিলাকে নিয়ে এলো গরিবের আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আজিমপুর মাতৃসদনে। সেখানে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন না করায়, কার্ড না থাকায় সেবা পেলেন না। দোতলা থেকে টেনেহিঁচড়ে আয়া নামিয়ে দিল। ততক্ষণে মায়ের জঠর থেকে পৃথিবীতে আসার জন্য উন্মুখ শিশুটি। খোলা চত্বরে নিতান্ত অবহেলায় ভূমিষ্ঠ হল একটি অভাগা মানবসন্তান। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। সমাজকে ধিক্কার দিয়ে একবুক অভিমান নিয়ে নষ্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। পুরোটাই যেন সিনেমার ট্র্যাজিক সিন। কলকাতার বাংলা ছবিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় ক্যাশে টাকা জমা না দিতে পারায় মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেখে ভাবতাম এ বুঝি চলচ্চিত্রের বাড়াবাড়ি। অথবা বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্য। এবার আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো ভাবনার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিল।
মাননীয় আদালত এ প্রসঙ্গে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেমন, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন করেছে। ...রাষ্ট্র লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীকে সেবা দিচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের ভেতরে কী হচ্ছে? গরিব জনগোষ্ঠী আজ নিগৃহীত। হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করছে। এটি দুঃখজনক। সরকারের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
আদালত আরও বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা পেল না! মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকার জন্য রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হল। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে নবজাতকও মারা গেল। এটি অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় অপরাধ।’
খোঁজ করলে এ জাতীয় অন্যায়ের খতিয়ান দিয়ে কণ্টক মালাগাঁথা যাবে। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা গেল হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে সিস্টার নবজাতকের মায়ের কাছ থেকে দাবিমতো ২০০ টাকা না পাওয়ায় প্রসূতিকে মারধর করে নবজাতকের হাতের স্যালাইন খুলে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। এক জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের বড় কর্তা আজিমপুর মাতৃসদনের ঘটনায় দায় চাপাচ্ছেন আয়ার ওপর। ভাষ্যমতে এ আয়া নয়, অন্য হাসপাতালের দালাল। কিন্তু আসন্ন সন্তানসম্ভবা নারীকে বের করে দেয়ার বিষয়টি মাতৃসদনের দায়িত্ববানদের নজরে এলো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো তারা এ নারীকে পরীক্ষা করেছেন। আবার হবিগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তার-ব্যবস্থাপক থাকার পরও একজন সিস্টার অমন দুর্বৃত্ত আচরণ কীভাবে করতে পারে সে প্রশ্নেরও সুরাহা হল না। এসব মর্মান্তিক চিত্র দেখার পর আমরা যে খুব এগিয়েছি বলে বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপাই তা শুনতে আর রুচি হয় না।
এ দেশের ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণদের জন্য দেশে-বিদেশে সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষত্রিয়দের তো চিকিৎসার চমৎকার ব্যবস্থাপনা আছে। রাজনীতিবিদ, বড় আমলা, ব্যবসায়ী- সব টাকাওয়ালা বৈশ্যরা দেশের নামি বেসরকারি হাসপাতাল আর বিদেশে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে পারেন সহজেই। শুধু দেশে নিয়তির ওপর ভরসা করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন আমজনতা শূদ্ররা। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার দুঃসাহস নেই এদের। টাকা নেই বলে সরকারি হাসপাতাল থেকেও বিতাড়িত হন তারা।
আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি একটু ভাবতে পারেন না দায়িত্ববানরা? হাসপাতালে বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা থাকতে পারে, যাতে পকেটে টাকা না থাকলে হতদরিদ্রকে বিতাড়িত হতে না হয়। আজিমপুর মাতৃসদনে রেজিস্ট্রেশন করা, কার্ড করার বিধান আছে মানছি; কিন্তু এই অভাগা নারীর মতো রেজিস্ট্রেশন ও কার্ড ছাড়া হঠাৎ সংকটে পড়া মানুষের চিকিৎসার দরজা বন্ধ থাকবে কেন? নিজেরা বড় মানুষ, বিদেশে চিকিৎসা করে সুস্থ থাকুন। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই তাতে অমত করবে না। কারণ তারা বড় মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেয়া দেখে মেনে নিয়েছে তাদের উপযোগী এ দেশে ভালো চিকিৎসাসেবা নেই, ডাক্তার নেই। এ মান্যবররা ভালো না থাকলে দেশ চালাবেন কে! রাজনীতি এগিয়ে নেবেন কারা? তাই জনস্বার্থেই দেশ-বিদেশে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাই বলে ‘দুর্বল’ ডাক্তারদের অধীনে ‘নড়বড়ে’ হাসপাতালগুলোতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার কিছুটা সুযোগ রাখা কি যায় না? না এ দাবি করা খুব অন্যায় হবে? না হলে দায়িত্ববানরা বলে দিন এ যুগের শূদ্ররা কোথায় চিকিৎসা পাবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
অনেক কিছুর মতোই শূদ্রের চিকিৎসার দায় নেননি সেন রাজারা। খেয়ে না-খেয়ে থাকা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষীণ দশার শূদ্র অসুস্থ হলে গ্রামের বদ্যি জরি-বুটি দিত। বাঁচলে বাঁচত মরলে মরত। কে তার খবর রাখে! এ প্রেক্ষাপটেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য সুফি-সাধকরা আসতে থাকেন। তারা সাধারণ মানুষের কষ্টটা উপলব্ধি করে মানবতার বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেন। খানকাহ স্থাপন করে সেখানে অবহেলিত মানুষের অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দিতে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করতেন। হাকিম সাহেবদের নিয়ে হাসপাতাল তৈরি করতেন। অসহায় অসুস্থ শূদ্রকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন। ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার পেছনে এ মানবিকতার ভূমিকা ছিল।
এ একুশ শতকে এসে যখন উন্নয়নের জয়গান শুনছি- নির্বাচনের মৌসুমে আরও শুনব, তখনই দেখছি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন আঙ্গিকে চতুঃবর্ণ বিভাজন স্পষ্ট রয়েছে। এখন নতুন নামে নতুন অবয়বে রাষ্ট্রে ও সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র রয়েছে। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারেও তাই এত রকমফের।
মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের সচেতন বিবেকের অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিদিন অন্যায় তো কম হচ্ছে না। প্রতিবাদ করছি কোথায়? রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমাদের মন্ত্রীরা অনেকে প্রতিদিন এত শব্দদূষণ করেন; কিন্তু ব্যক্তিগত দায় বা লজ্জায় হয়তো দুর্নীতি নিয়ে তেমন কথা বলেন না। শুধু ছিদ্রান্বেষণ করেন প্রতিপক্ষের। আবার বিরোধী দলের নেতারা শব্দবোমা ছুড়ছেন প্রতিনিয়ত। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর অন্যায় নিয়ে কথা বলছেন। শুনে মনে হচ্ছে তাদের চেয়ে পূতপবিত্র আর কেউ নেই। ক’দিন আগেও তাদের অনেকের দুর্নীতির ভাড়ার যে পূর্ণ ছিল তা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। ক্ষমা ভিক্ষার সংস্কৃতি তো নেই-ই। উভয় পক্ষ একে অন্যকে যেভাবে দুর্নীতিবাজের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকা রাজনীতিকরা যেন স্বঘোষিত দুর্নীতিবাজ। এমন বাস্তবতায় তবুও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় মহামান্য আদালতকে। মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন।
রাজধানীতে একজন প্রসূতি মায়ের ওপর অমানবিক নিবর্তন চালানোর পর শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে উন্মুক্ত চত্বরে অবহেলায় সন্তান প্রসব করতে হল। অযত্নে মারাও গেল নবজাতক। কোনো সভ্যসমাজের ছবি এমন হতে পারে না। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় আর মিডিয়ার তৎপরতায় আলোতে এসেছে ঘটনাটি। জানি না আলোর বাইরে এমন ঘটনা কত ঘটে! এ মর্মান্তিক ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল আমাদের দেশের ক্ষমতার আধিকারিকরা আচরণে এখনও সেন ব্রাহ্মণ। আর দরিদ্র সাধারণ মানুষ এ যুগের শূদ্র। তাদের চিকিৎসার দায় নিতে আবার মানবতাবাদী সুফি-সাধকদের আসতে হবে হয়তো।
ভাবা যায়, এ উন্নয়নের জোয়ারের দেশে রাজধানীর এক দরিদ্র গর্ভধারিণী প্রসববেদনা নিয়ে শ্রেষ্ঠ সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষায় দেখলেন সিজার করতে হবে। গরিব রোগীর টাকা-পয়সা নেই তাই প্রসববেদনায় ছটফট করা এ যুগের শূদ্র রমণীকে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বের করে দেয়া হল। দুর্ভাগা রমণীর পরিচিত ভ্যানচালক ছেলেটি দ্রুত নিয়ে এলো ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। ১৫০০ টাকা হাসপাতাল চার্জ দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় প্রসববেদনায় কাতর অসহায় মহিলাকে বিদায় করে দেয়া হল। কথাটি শুনে আমার মনে পড়ল স্যার মিটফোর্ডের কথা। ঢাকার কালেক্টরের চাকরি করতে এসে বিনা চিকিৎসায় কলেরা রোগীদের মারা যেতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে ইংল্যান্ডে বসে নিজের সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন যাতে ঢাকায় আধুনিক হসপিটাল বানানো হয়। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আজকের সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর সেদিনের মিটফোর্ড হাসপাতালের। আর সেই হাসপাতালে আজ মানবতার এতটা অসম্মান! অগত্যা ভ্যানচালক দুস্থ মহিলাকে নিয়ে এলো গরিবের আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আজিমপুর মাতৃসদনে। সেখানে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন না করায়, কার্ড না থাকায় সেবা পেলেন না। দোতলা থেকে টেনেহিঁচড়ে আয়া নামিয়ে দিল। ততক্ষণে মায়ের জঠর থেকে পৃথিবীতে আসার জন্য উন্মুখ শিশুটি। খোলা চত্বরে নিতান্ত অবহেলায় ভূমিষ্ঠ হল একটি অভাগা মানবসন্তান। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। সমাজকে ধিক্কার দিয়ে একবুক অভিমান নিয়ে নষ্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। পুরোটাই যেন সিনেমার ট্র্যাজিক সিন। কলকাতার বাংলা ছবিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় ক্যাশে টাকা জমা না দিতে পারায় মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেখে ভাবতাম এ বুঝি চলচ্চিত্রের বাড়াবাড়ি। অথবা বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্য। এবার আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো ভাবনার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিল।
মাননীয় আদালত এ প্রসঙ্গে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেমন, ‘এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন করেছে। ...রাষ্ট্র লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীকে সেবা দিচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের ভেতরে কী হচ্ছে? গরিব জনগোষ্ঠী আজ নিগৃহীত। হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করছে। এটি দুঃখজনক। সরকারের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
আদালত আরও বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা পেল না! মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকার জন্য রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হল। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে নবজাতকও মারা গেল। এটি অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় অপরাধ।’
খোঁজ করলে এ জাতীয় অন্যায়ের খতিয়ান দিয়ে কণ্টক মালাগাঁথা যাবে। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা গেল হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে সিস্টার নবজাতকের মায়ের কাছ থেকে দাবিমতো ২০০ টাকা না পাওয়ায় প্রসূতিকে মারধর করে নবজাতকের হাতের স্যালাইন খুলে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। এক জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের বড় কর্তা আজিমপুর মাতৃসদনের ঘটনায় দায় চাপাচ্ছেন আয়ার ওপর। ভাষ্যমতে এ আয়া নয়, অন্য হাসপাতালের দালাল। কিন্তু আসন্ন সন্তানসম্ভবা নারীকে বের করে দেয়ার বিষয়টি মাতৃসদনের দায়িত্ববানদের নজরে এলো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো তারা এ নারীকে পরীক্ষা করেছেন। আবার হবিগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তার-ব্যবস্থাপক থাকার পরও একজন সিস্টার অমন দুর্বৃত্ত আচরণ কীভাবে করতে পারে সে প্রশ্নেরও সুরাহা হল না। এসব মর্মান্তিক চিত্র দেখার পর আমরা যে খুব এগিয়েছি বলে বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপাই তা শুনতে আর রুচি হয় না।
এ দেশের ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণদের জন্য দেশে-বিদেশে সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষত্রিয়দের তো চিকিৎসার চমৎকার ব্যবস্থাপনা আছে। রাজনীতিবিদ, বড় আমলা, ব্যবসায়ী- সব টাকাওয়ালা বৈশ্যরা দেশের নামি বেসরকারি হাসপাতাল আর বিদেশে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে পারেন সহজেই। শুধু দেশে নিয়তির ওপর ভরসা করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন আমজনতা শূদ্ররা। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার দুঃসাহস নেই এদের। টাকা নেই বলে সরকারি হাসপাতাল থেকেও বিতাড়িত হন তারা।
আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি একটু ভাবতে পারেন না দায়িত্ববানরা? হাসপাতালে বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা থাকতে পারে, যাতে পকেটে টাকা না থাকলে হতদরিদ্রকে বিতাড়িত হতে না হয়। আজিমপুর মাতৃসদনে রেজিস্ট্রেশন করা, কার্ড করার বিধান আছে মানছি; কিন্তু এই অভাগা নারীর মতো রেজিস্ট্রেশন ও কার্ড ছাড়া হঠাৎ সংকটে পড়া মানুষের চিকিৎসার দরজা বন্ধ থাকবে কেন? নিজেরা বড় মানুষ, বিদেশে চিকিৎসা করে সুস্থ থাকুন। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই তাতে অমত করবে না। কারণ তারা বড় মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেয়া দেখে মেনে নিয়েছে তাদের উপযোগী এ দেশে ভালো চিকিৎসাসেবা নেই, ডাক্তার নেই। এ মান্যবররা ভালো না থাকলে দেশ চালাবেন কে! রাজনীতি এগিয়ে নেবেন কারা? তাই জনস্বার্থেই দেশ-বিদেশে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাই বলে ‘দুর্বল’ ডাক্তারদের অধীনে ‘নড়বড়ে’ হাসপাতালগুলোতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার কিছুটা সুযোগ রাখা কি যায় না? না এ দাবি করা খুব অন্যায় হবে? না হলে দায়িত্ববানরা বলে দিন এ যুগের শূদ্ররা কোথায় চিকিৎসা পাবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com