jugantor
শেষ মুহূর্তে ঢিলেঢালা বিএনপির আন্দোলন

  হাবিবুর রহমান খান  

০৩ জানুয়ারি ২০১৪, ০০:০০:০০  | 

নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ঝিমিয়ে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। পাশাপাশি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও কার্যত তেমন কোনো উদ্যোগ ও প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। সাংগঠনিক দুর্বলতা, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া, সুযোগসন্ধানী নেতাদের রাজপথের চেয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখার কৌশল, কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড ও ঢাকা মহানগর বিএনপির চরম ব্যর্থতা এবং জোট নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আন্দোলন ব্যর্থতায় রূপ নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, শেষ মুহূর্তে এসে সিনিয়র ও মহানগরী নেতাদের আত্মগোপনে থাকায়ও আন্দোলনে প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের কঠোর দমনপীড়নও। আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর নেতাদের আত্মগোপনে থাকার প্রভাব পড়েছে তৃণমূলেও। তফসিল ঘোষণার পরপর টানা অবরোধে সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু বুধবার থেকে ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধে সে চিত্র নেই। শেষ সময়ে রাজধানীতে অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলছে বিরোধী দলের এই আন্দোলন।

দাবি আদায়ে নিজেদের ব্যর্থতা পুরোপুরি মানতে রাজি নন বিএনপির হাইকমান্ড। তাদের মতে, সরকারের নজিরবিহীন দমনপীড়নকে মোকাবেলা করেও নেতাকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ সরকার সন্ত্রাস দমনের কৌশলকে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করছে। কিন্তু বিএনপি তো কোনো সন্ত্রাসী দল নয়। সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাব দিতে গেলে সারা দেশ অচল হয়ে পড়বে। তাই অনেক সময় দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে তা করা হচ্ছে না। তাদের মতে, আসছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারলেও ইতিমধ্যে ওই নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত করা চলমান আন্দোলনের সফলতার একটি অংশ বলেই মনে করছেন তারা। পাশাপাশি বিরোধী দলের দাবির প্রতি দেশী-বিদেশী সমর্থন ও সরকারকে চাপে রাখা সম্ভব হয়েছে। দাবির প্রতি কূটনীতিকদের সমর্থন পাওয়াকেও তারা আন্দোলনের সফলতা হিসেবেই দেখছেন।

সাংগঠনিক দুর্বলতা : বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৮৬। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, গোলাম আকবর খন্দকার, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ সর্বোচ্চ ২০ জন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। আর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে আন্দোলনে রাজপথে নয়, এসব নেতার অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছেন আত্মগোপনে থেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করলেও কাক্সিক্ষত সেই পদ পেয়ে তারা দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই পদ পেয়েও ঘরে বসে আছেন। আবার কেউ কেউ মামলা ও গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিলে বাকি ১৫ জনের মধ্যে কাউকেই রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আহমেদ আজম খান ছাড়া বাকিরা আত্মগোপনে। আর ১৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ কয়েকজনকে সক্রিয় দেখা গেলেও বাকিদের কালেভদ্রেও রাজপথে দেখা যায় না। দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ যুগ্ম-মহাসচিবদের মধ্যে একমাত্র মিজানুর রহমান মিনুকে রাজশাহীতে রাজপথে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র মজিবুর রহমান সরোয়ার ছাড়া ফজলুল হক মিলন, হারুন অর রশিদ, মশিউর রহমান কেউ নেই রাজপথে। তবে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যেসব নেতা একই সঙ্গে জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন তাদের অনেকে নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন।

সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির মধ্যে খোকা বর্তমানে কারাগারে। বাকিরা কোথায় কেউ জানে না। একই অবস্থা মহানগরীর সব থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের। আর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নাম ও চেহারাই যেন ভুলে যাচ্ছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অক্টোবরের শেষ থেকে চলমান আন্দোলনে কালেভদ্রে ছাড়া এসব নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া : আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই মুহূর্তে দলে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু নেই। আন্দোলনের কৌশল বলে আত্মগোপনে থাকা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো নেতাকেই কাছে পাচ্ছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনে রাজপথে না থাকার পাশাপাশি ওই নেতারা করণীয় নিয়ে কোনো পরামর্শও দিচ্ছেন না। কেন্দে র কোনো নির্দেশনা না পেয়ে নিজেদের মতো করেই আন্দোলনের কৌশল নিয়ে রাজপথে নামছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

দলের ভেতর কোনো শৃঙ্খলা নেই তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে দফতরে দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী আহমেদের গ্রেফতারের পরপর। ৩০ নভেম্বর রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর খালেদা জিয়া দলের কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকে কার্যালয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে কেউ সেখানে যাননি। সর্বশেষ দলের যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে নয়াপল্টনে গিয়ে দলের দাফরিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু সালাহউদ্দিনও গ্রেফতারের ভয়ে কার্যালয়ে যাননি। তাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হলেও অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। এই নিয়ে শুধু দলের ভেতর নয়, দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে।

এভাবে কয়েকদিন চালানোর পর হঠাৎ হাওয়া সালাহউদ্দিন। কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করেন নজরুল ইসলাম খান। কিন্তু মার্চ ফর ডেমোক্রেসি শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। শোনা যায় দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েকদিন গুলশানের কার্যালয়ে তাকে দেখাও যায়। আবার তিনি হাওয়া। গত কয়েকদিনে দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত দলের চেয়ারপারসনকে অবহিত না করেই মিডিয়ায় জানানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচিতে খালেদা জিয়াকে বাধা দেয়ার পর তিনি নিজেই পরের দিন একই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায় হাফিজউদ্দিন আহমেদ ৩০ ডিসেম্বর থেকে তফসিল স্থগিত না করা পর্যন্ত সারা দেশে নৌ, রেল ও সকড়পথে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দেন। তার এই কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে দলের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তার এই ঘোষণা চেয়ারপারসনের পরামর্শে কিনা। তার প্রমাণ পরের দিনই দেখা যায়। ৩০ ডিসেম্বর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ঘোষণা দেন তিনি, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশনাও মানছেন না নেতারা। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি সফল করতে ওইদিন সকাল ১০টার মধ্যে সিনিয়র নেতাদের নয়াপল্টনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, তিনি যদি কর্মসূচিতে অংশ নিতে নাও পারেন তবুও যেন আন্দোলন চালিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু মার্চ ফর ডেমোক্রেসিকে কেন্দ করে কোনো নেতাকর্মীকেই কেন্দ ীয় কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়নি।

নজিরবিহীন দমনপীড়ন : সাংগঠনিক দুর্বলতা ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার পাশাপাশি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ না দেয়ার পেছনে সরকারের দমনপীড়নও একটি প্রধান কারণ। বিরোধী দলকে মোকাবেলায় সরকার অতীতের সব কৌশলকে ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দলকে দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে সরকার। বিএনপির কেন্দ ীয় ও জোটের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের কেউ গ্রেফতার থেকে বাদ পড়েননি। আর বিরোধী দলকে মামলার পাহাড়ের নিচে ফেলে দিয়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ আর গুলিবর্ষণের ঘটনাও অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। আন্দোলন দমাতে টিয়ারশেল ব্যবহারের প্রচলিত নিয়মকে বাদ দিয়ে বেছে নেয়া হয় সরাসরি গুলি করার কৌশল। কয়েকটি ঘটনায় এমন দৃশ্য দেখে কার্যত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও দেখা দেয় আতঙ্ক।

শুধু মামলা-হামলা আর গ্রেফতারই নয়, দলের কেন্দ ীয় কার্যালয়ও রয়েছে অবরুদ্ধ। দীর্ঘ দুই মাস ধরে কোনো নেতাকর্মীকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সাহস করে কেউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা মানে অবধারিতভাবে গ্রেফতার হওয়া। গত কয়েকদিনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসা ও কার্যালয়। ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে অংশ নিতে বাসা থেকে বের হতে দেয়া হয়নি খালেদা জিয়াকে। তার বাসা ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাসা থেকে বের হওয়ার পথ অবরুদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটি বালুভর্তি ট্রাক। খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দি আছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তার কয়েকটি যৌক্তিক কারণও রয়েছে। গত কয়েকদিনে দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে তার বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাধা দেয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনেও।

তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা : খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত বাধা উপেক্ষা করে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ নেতাকর্মী ঢাকা ও আশপাশে অবস্থান নেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর কোনো নেতা রাজপথে না থাকায় তৃণমূলে দেখা দেয় হতাশা ও ক্ষোভ। অনেকটা হতাশা নিয়েই তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান। আন্দোলনের সফলতা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং মহানগর বিএনপির ব্যর্থতার কারণেই সরকার এখনও বহাল-তবিয়তে টিকে আছেন। কেন্দ ীয় নেতাদের আত্মগোপনে থাকার প্রভাব পড়েছে তৃণমূলেও। কেন্দে র প্রতি অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই লাগাতার অবরোধে অনেকেই রাজপাথে নামছেন না। তার প্রমাণ বুধবার থেকে শুরু হওয়া লাগাতার অবরোধেও দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা বাকি থাকলেও আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে অবরোধে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পিকেটিংয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।

সিলেটে এক জনসভায় খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করতে প্রতিটি ভোট কেন্দে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর কয়েকটি জায়গায় এসব কমিটি হলেও কেন্দে র কোনো মনিটরিং না থাকায় তা থমকে যায়। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর আবারও নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ভোটকেন্দি ক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় সবাইকে নিয়ে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেন। এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো কোথাও এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের কথা জানা যায়নি।

জোট নেতারা রাজপথে নেই : আন্দোলনকে চাঙ্গা করার কৌশল হিসেবে বিগত চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারণ করে গঠন করা হয় ১৮ দলীয় জোট। সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ জোট এটি। কিন্তু আন্দোলনে রাজপথে জোটের শীর্ষ কোনো নেতাকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির মতো তারাও রয়েছে আত্মগোপনে। জোটের একমাত্র শরিক জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরকে বিগত সময়ে রাজপথে সহিংসতা ও সাহসী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েকদিনে জামায়াতও পিছুটান দিয়েছে। আগের মতো সহিংসরূপে তাদের রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গত কয়েকদিনে সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির সংখ্যাও কমেছে।

তবুও আশাবাদী বিএনপি : নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচনের তফসিল স্থগিত করার লক্ষ্যে বিএনপির চলমান আন্দোলন ব্যর্থতায় রূপ নিতে যাচ্ছে বলে মানতে রাজি নন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ দিতে না পারায় দলের কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তবে আন্দোলন দমনের নামে সরকার যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঊনসত্তর, একাত্তর এবং সর্বশেষ এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সরকার এতটা মারমুখী আচরণ করেনি। বিরোধী দলের মিছিলের ওপর সরাসরি গুলির দৃশ্য অতীতের কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার তাই করছে। সরকারের এমন কঠোর মনোভাবের কারণে নেতাকর্মীদের মাঝেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

বিএনপির মতে, নির্বাচনকে বাতিল করা ও নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে এখনও চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। তবে চলমান আন্দোলনে বেশ কিছু সফলতা তারা পেয়েছেন। বিরোধী দলের দাবির প্রতি তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করে একতরফা নির্বাচন করার সরকারি সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের ফলেই দেশে-বিদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বহির্বিশ্বের প্রতিনিধিরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসছে না- এটিও দলের কূটনৈতিক সফলতা। আন্দোলেনের একটি কৌশল ছিল কূটনৈতিক তৎপরতা। সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাব কূটনীতিকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তারা। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ফোন, অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সমঝোতার উদ্যোগ তাদের কূটনৈতিক সফলতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিরোধী দলের দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। সরকার হয়তো গায়ের জোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও করিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু জনসমর্থিত কোনো আন্দোলন অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়নি বর্তমান আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে ওই সরকারের অধীনেই সব দলের অংশগ্রহণে খুব শিগগিরই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।


 

সাবমিট

শেষ মুহূর্তে ঢিলেঢালা বিএনপির আন্দোলন

 হাবিবুর রহমান খান 
০৩ জানুয়ারি ২০১৪, ১২:০০ এএম  | 

নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ঝিমিয়ে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। পাশাপাশি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও কার্যত তেমন কোনো উদ্যোগ ও প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। সাংগঠনিক দুর্বলতা, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া, সুযোগসন্ধানী নেতাদের রাজপথের চেয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখার কৌশল, কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড ও ঢাকা মহানগর বিএনপির চরম ব্যর্থতা এবং জোট নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আন্দোলন ব্যর্থতায় রূপ নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, শেষ মুহূর্তে এসে সিনিয়র ও মহানগরী নেতাদের আত্মগোপনে থাকায়ও আন্দোলনে প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের কঠোর দমনপীড়নও। আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর নেতাদের আত্মগোপনে থাকার প্রভাব পড়েছে তৃণমূলেও। তফসিল ঘোষণার পরপর টানা অবরোধে সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু বুধবার থেকে ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধে সে চিত্র নেই। শেষ সময়ে রাজধানীতে অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলছে বিরোধী দলের এই আন্দোলন।

দাবি আদায়ে নিজেদের ব্যর্থতা পুরোপুরি মানতে রাজি নন বিএনপির হাইকমান্ড। তাদের মতে, সরকারের নজিরবিহীন দমনপীড়নকে মোকাবেলা করেও নেতাকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ সরকার সন্ত্রাস দমনের কৌশলকে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করছে। কিন্তু বিএনপি তো কোনো সন্ত্রাসী দল নয়। সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাব দিতে গেলে সারা দেশ অচল হয়ে পড়বে। তাই অনেক সময় দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে তা করা হচ্ছে না। তাদের মতে, আসছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারলেও ইতিমধ্যে ওই নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত করা চলমান আন্দোলনের সফলতার একটি অংশ বলেই মনে করছেন তারা। পাশাপাশি বিরোধী দলের দাবির প্রতি দেশী-বিদেশী সমর্থন ও সরকারকে চাপে রাখা সম্ভব হয়েছে। দাবির প্রতি কূটনীতিকদের সমর্থন পাওয়াকেও তারা আন্দোলনের সফলতা হিসেবেই দেখছেন।

সাংগঠনিক দুর্বলতা : বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৮৬। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, গোলাম আকবর খন্দকার, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ সর্বোচ্চ ২০ জন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। আর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে আন্দোলনে রাজপথে নয়, এসব নেতার অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছেন আত্মগোপনে থেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করলেও কাক্সিক্ষত সেই পদ পেয়ে তারা দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই পদ পেয়েও ঘরে বসে আছেন। আবার কেউ কেউ মামলা ও গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিলে বাকি ১৫ জনের মধ্যে কাউকেই রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আহমেদ আজম খান ছাড়া বাকিরা আত্মগোপনে। আর ১৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ কয়েকজনকে সক্রিয় দেখা গেলেও বাকিদের কালেভদ্রেও রাজপথে দেখা যায় না। দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ যুগ্ম-মহাসচিবদের মধ্যে একমাত্র মিজানুর রহমান মিনুকে রাজশাহীতে রাজপথে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র মজিবুর রহমান সরোয়ার ছাড়া ফজলুল হক মিলন, হারুন অর রশিদ, মশিউর রহমান কেউ নেই রাজপথে। তবে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যেসব নেতা একই সঙ্গে জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন তাদের অনেকে নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন।

সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির মধ্যে খোকা বর্তমানে কারাগারে। বাকিরা কোথায় কেউ জানে না। একই অবস্থা মহানগরীর সব থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের। আর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নাম ও চেহারাই যেন ভুলে যাচ্ছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অক্টোবরের শেষ থেকে চলমান আন্দোলনে কালেভদ্রে ছাড়া এসব নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া : আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই মুহূর্তে দলে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু নেই। আন্দোলনের কৌশল বলে আত্মগোপনে থাকা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো নেতাকেই কাছে পাচ্ছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনে রাজপথে না থাকার পাশাপাশি ওই নেতারা করণীয় নিয়ে কোনো পরামর্শও দিচ্ছেন না। কেন্দে র কোনো নির্দেশনা না পেয়ে নিজেদের মতো করেই আন্দোলনের কৌশল নিয়ে রাজপথে নামছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

দলের ভেতর কোনো শৃঙ্খলা নেই তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে দফতরে দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী আহমেদের গ্রেফতারের পরপর। ৩০ নভেম্বর রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর খালেদা জিয়া দলের কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকে কার্যালয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে কেউ সেখানে যাননি। সর্বশেষ দলের যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে নয়াপল্টনে গিয়ে দলের দাফরিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু সালাহউদ্দিনও গ্রেফতারের ভয়ে কার্যালয়ে যাননি। তাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হলেও অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। এই নিয়ে শুধু দলের ভেতর নয়, দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে।

এভাবে কয়েকদিন চালানোর পর হঠাৎ হাওয়া সালাহউদ্দিন। কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করেন নজরুল ইসলাম খান। কিন্তু মার্চ ফর ডেমোক্রেসি শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। শোনা যায় দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েকদিন গুলশানের কার্যালয়ে তাকে দেখাও যায়। আবার তিনি হাওয়া। গত কয়েকদিনে দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত দলের চেয়ারপারসনকে অবহিত না করেই মিডিয়ায় জানানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচিতে খালেদা জিয়াকে বাধা দেয়ার পর তিনি নিজেই পরের দিন একই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায় হাফিজউদ্দিন আহমেদ ৩০ ডিসেম্বর থেকে তফসিল স্থগিত না করা পর্যন্ত সারা দেশে নৌ, রেল ও সকড়পথে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দেন। তার এই কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে দলের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তার এই ঘোষণা চেয়ারপারসনের পরামর্শে কিনা। তার প্রমাণ পরের দিনই দেখা যায়। ৩০ ডিসেম্বর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ঘোষণা দেন তিনি, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশনাও মানছেন না নেতারা। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি সফল করতে ওইদিন সকাল ১০টার মধ্যে সিনিয়র নেতাদের নয়াপল্টনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, তিনি যদি কর্মসূচিতে অংশ নিতে নাও পারেন তবুও যেন আন্দোলন চালিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু মার্চ ফর ডেমোক্রেসিকে কেন্দ করে কোনো নেতাকর্মীকেই কেন্দ ীয় কার্যালয়ের সামনে দেখা যায়নি।

নজিরবিহীন দমনপীড়ন : সাংগঠনিক দুর্বলতা ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার পাশাপাশি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ না দেয়ার পেছনে সরকারের দমনপীড়নও একটি প্রধান কারণ। বিরোধী দলকে মোকাবেলায় সরকার অতীতের সব কৌশলকে ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দলকে দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে সরকার। বিএনপির কেন্দ ীয় ও জোটের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের কেউ গ্রেফতার থেকে বাদ পড়েননি। আর বিরোধী দলকে মামলার পাহাড়ের নিচে ফেলে দিয়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ আর গুলিবর্ষণের ঘটনাও অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। আন্দোলন দমাতে টিয়ারশেল ব্যবহারের প্রচলিত নিয়মকে বাদ দিয়ে বেছে নেয়া হয় সরাসরি গুলি করার কৌশল। কয়েকটি ঘটনায় এমন দৃশ্য দেখে কার্যত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও দেখা দেয় আতঙ্ক।

শুধু মামলা-হামলা আর গ্রেফতারই নয়, দলের কেন্দ ীয় কার্যালয়ও রয়েছে অবরুদ্ধ। দীর্ঘ দুই মাস ধরে কোনো নেতাকর্মীকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সাহস করে কেউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা মানে অবধারিতভাবে গ্রেফতার হওয়া। গত কয়েকদিনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসা ও কার্যালয়। ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে অংশ নিতে বাসা থেকে বের হতে দেয়া হয়নি খালেদা জিয়াকে। তার বাসা ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাসা থেকে বের হওয়ার পথ অবরুদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটি বালুভর্তি ট্রাক। খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দি আছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তার কয়েকটি যৌক্তিক কারণও রয়েছে। গত কয়েকদিনে দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে তার বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাধা দেয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনেও।

তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা : খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত বাধা উপেক্ষা করে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ নেতাকর্মী ঢাকা ও আশপাশে অবস্থান নেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর কোনো নেতা রাজপথে না থাকায় তৃণমূলে দেখা দেয় হতাশা ও ক্ষোভ। অনেকটা হতাশা নিয়েই তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান। আন্দোলনের সফলতা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং মহানগর বিএনপির ব্যর্থতার কারণেই সরকার এখনও বহাল-তবিয়তে টিকে আছেন। কেন্দ ীয় নেতাদের আত্মগোপনে থাকার প্রভাব পড়েছে তৃণমূলেও। কেন্দে র প্রতি অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই লাগাতার অবরোধে অনেকেই রাজপাথে নামছেন না। তার প্রমাণ বুধবার থেকে শুরু হওয়া লাগাতার অবরোধেও দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা বাকি থাকলেও আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে অবরোধে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পিকেটিংয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।

সিলেটে এক জনসভায় খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করতে প্রতিটি ভোট কেন্দে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর কয়েকটি জায়গায় এসব কমিটি হলেও কেন্দে র কোনো মনিটরিং না থাকায় তা থমকে যায়। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর আবারও নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ভোটকেন্দি ক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় সবাইকে নিয়ে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেন। এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো কোথাও এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের কথা জানা যায়নি।

জোট নেতারা রাজপথে নেই : আন্দোলনকে চাঙ্গা করার কৌশল হিসেবে বিগত চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারণ করে গঠন করা হয় ১৮ দলীয় জোট। সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ জোট এটি। কিন্তু আন্দোলনে রাজপথে জোটের শীর্ষ কোনো নেতাকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির মতো তারাও রয়েছে আত্মগোপনে। জোটের একমাত্র শরিক জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরকে বিগত সময়ে রাজপথে সহিংসতা ও সাহসী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েকদিনে জামায়াতও পিছুটান দিয়েছে। আগের মতো সহিংসরূপে তাদের রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গত কয়েকদিনে সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির সংখ্যাও কমেছে।

তবুও আশাবাদী বিএনপি : নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচনের তফসিল স্থগিত করার লক্ষ্যে বিএনপির চলমান আন্দোলন ব্যর্থতায় রূপ নিতে যাচ্ছে বলে মানতে রাজি নন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ দিতে না পারায় দলের কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তবে আন্দোলন দমনের নামে সরকার যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঊনসত্তর, একাত্তর এবং সর্বশেষ এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সরকার এতটা মারমুখী আচরণ করেনি। বিরোধী দলের মিছিলের ওপর সরাসরি গুলির দৃশ্য অতীতের কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার তাই করছে। সরকারের এমন কঠোর মনোভাবের কারণে নেতাকর্মীদের মাঝেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

বিএনপির মতে, নির্বাচনকে বাতিল করা ও নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে এখনও চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। তবে চলমান আন্দোলনে বেশ কিছু সফলতা তারা পেয়েছেন। বিরোধী দলের দাবির প্রতি তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করে একতরফা নির্বাচন করার সরকারি সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের ফলেই দেশে-বিদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বহির্বিশ্বের প্রতিনিধিরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসছে না- এটিও দলের কূটনৈতিক সফলতা। আন্দোলেনের একটি কৌশল ছিল কূটনৈতিক তৎপরতা। সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাব কূটনীতিকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তারা। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ফোন, অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সমঝোতার উদ্যোগ তাদের কূটনৈতিক সফলতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিরোধী দলের দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। সরকার হয়তো গায়ের জোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও করিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু জনসমর্থিত কোনো আন্দোলন অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়নি বর্তমান আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে ওই সরকারের অধীনেই সব দলের অংশগ্রহণে খুব শিগগিরই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র