jugantor
ড্যাপ প্রশ্নে কী গুরুত্ব পাবে জনস্বার্থ না ব্যক্তিস্বার্থ?

  যুগান্তর রিপোর্ট  

১৮ মার্চ ২০১৪, ০০:০০:০০  | 

দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও ড্যাপ (ডিটেল এরিয়া প্ল্যান) রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অবশেষে বসতেই যাচ্ছে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আজ দুপুরে এ বৈঠক হওয়ার কথা। বৈঠকের এজেন্ডায় প্রথমে থাকছে বিগত সরকারের সময় গঠিত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির রেখে যাওয়া বিতর্কিত সুপারিশ অনুমোদনের প্রস্তাব। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে এমন একটি বহুল আলোচিত আবাসন প্রকল্পকে ড্যাপের বিভিন্ন শর্ত থেকে মুক্ত করাসহ জলাধার বেষ্টিত বেশ কয়েকটি ব্লককে আরবান এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া কার্যবিবরণীতে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির সুপারিশ পরিবর্তন করে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ তো আছেই। সূত্র জানিয়েছে, মূলত মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে এটিই প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং এ কারণেই আজকের সভা আহবান করা হয়েছে।

এদিকে ড্যাপের বিধিনিষেধের মধ্যে আটকাপড়া ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শেষ পর্যন্ত উপ-কমিটির রেখে যাওয়া বিতর্কিত ও সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী সুপারিশ অনুমোদন করলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠবে। কেননা যে আবাসন প্রকল্পে সরকারের খাস জমিসহ সাধারণ মানুষের অনেক সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে এবং সরকারি বিভিন্ন জরিপ ও ডকুমেন্ট অনুযায়ী যেসব এলাকা বন্যাপ্রবণ ও ভূমিকম্প জোন হিসেবে সংরক্ষিত থাকার কথা তা যদি ড্যাপের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয় তাহলে মন্ত্রিসভা কমিটির সততা নিয়ে নির্ঘাত জনমনে প্রশ্ন উঠবেই। তাই সমাজ সচেতন সাধারণ অনেক নাগরিকের মতো ভুক্তভোগীরা মনে করেন, ড্যাপ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অবশ্যই বসতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে বৃহত্তর জনস্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে হলে এভাবে মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে ড্যাপে নির্ধারিত জলাধার ও বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি সংশ্লিষ্ট এলাকাকে আবাসন প্রকল্প হিসেবে অনাপত্তি দেয়া মোটেই সমীচীন হবে না। বরং রাজধানী ঢাকাকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি একটি আধুনিক রাজধানী শহর গড়ে তোলার জন্য সরকারের সামনে এ মুহূর্তে একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা বেশি প্রয়োজন। আর তাই ড্যাপ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সরকার তথা মন্ত্রিসভার কাছে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করলে তা হবে যুগান্তকারী।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী অতীতের তুলনায় এবার দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে খুবই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। ঘরে-বাইরে সর্বত্র দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স দেখাতে তিনি বদ্ধপরিকর। ফলে এ রকম একটি অবস্থায় ড্যাপ সংশোধনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয় তাহলে কোনো অবস্থাতেই দুর্নীতি দমন কিংবা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। কেননা, স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে বর্তমানে জমিই সবচেয়ে মূল্যবান। আর ঢাকা শহর হলে তো কথাই নেই। সবকিছু বাড়লেও জমি বাড়ার সুযোগ নেই। তাই মহামূল্যবান জমি নিজের নামে কিংবা আবাসন প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য একশ্রেণীর অসাধু আবাসন ব্যবসায়ী সবকিছু করতে প্রস্তুত। যদি একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি কব্জা করা যায় তাহলে ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে তারা তাই করবে। সঙ্গত কারণে সমন্বিত নীতিমালা ছাড়াই ড্যাপ সংশোধনের ক্ষেত্রে যেভাবে মন্ত্রিসভা কমিটি, উপ-কমিটি ও রাজউকের টেকনিক্যাল কমিটিকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে এ ধরনের অবাধ দুর্নীতি করার সুযোগ কোনো অবস্থাতে বন্ধ করা যাবে না।

এছাড়া যে উপ-কমিটির সুপারিশ নিয়ে এত বিতর্ক সেই উপকমিটির দু’জন প্রভাবশালী সদস্য সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ও সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন এখন দুদকের কাঠগড়ায়। তাদের বিপুল পরিমাণ আয়বহির্ভূত সহায়-সম্পত্তির বৈধতা নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তাদের দুদকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। এছাড়া উপকমিটির আহ্বায়ক সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা ও অন্যতম সদস্য পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও এবারকার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। ফলে তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ যদি ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে তাহলে নবগঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির ভূমিকা নিয়ে জনমনে অবশ্যই সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হবে।

এ পর্যায়ে সচেতন মহল মনে করেন, শেষ পর্যন্ত যদি এভাবে কমিটির ওপর ছেড়ে দিয়ে ড্যাপকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে দুর্নীতি দমনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার আশংকা থেকে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তিসহ ব্যক্তিমালিকানার অবিক্রীত অনেক সম্পত্তিও প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ী গ্র“প গ্রাস করে ফেলবে। কিন্তু এতে করে বর্তমান সরকারকে ভবিষ্যতে বড় ধরনের মাশুল দিতে হতে পারে। কেননা এখনকার দুদক যদি বিষয়টিকে শক্ত হাতে ধরতে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকার পরিবর্তন হলে এ বিষয়টি ফের দুদকে নিয়ে যাওয়া হবেই। রাজনৈতিক কারণে হলেও দুদককে দিয়ে তখন সাঁড়াশি পদক্ষেপ গ্রহণ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এটি ঐতিহাসিক কালচার। আর এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি যেহেতু দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তাই দুদককে অভিযোগ প্রমাণ করা নিয়ে বেগ পেতেও হবে না। ফলে বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্টদের সে সময় বড় ধরনের একটি দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি অবশ্যই হতে হবে।

দুদক যা বলেছে : ড্যাপ সংশোধনে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিষয়ে ১২ ফেব্র“য়ারি দুদকের মহাপরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত) জিয়াউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কী ধরনের অনিয়ম করেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাদের হাতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে দেখতে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাই তিনি মনে করেন, দুদকের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ড্যাপ রিভিউ করা নিয়ে রাজউক কিংবা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির পরবর্তী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা সঠিক বা উচিত হবে না’ এ বিষয়ে ১৩ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

রাজউক চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য : যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ২৬ ফেব্র“য়ারি রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেন, ‘ড্যাপ রিভিউ উপ-কমিটির দুর্নীতির কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ নিয়ে দুদকে তদন্তাধীন কোনো বিষয়ে রাজউক কোনো পদক্ষেপ নেবে না। এরই মধ্যে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও ফাইল তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কাজে রাজউক সব ধরনের সহায়তা করবে।’ এছাড়া এক প্রশ্নের জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্র“পের বারিধারা আবাসন প্রকল্পে ৩০৫ একর পর্যন্ত রাজউকের অনুমোদন আছে এবং এই প্রকল্পে আর কোনো জমির অনুমোদন নেই।’ রাজউক চেয়ারম্যানের এই সাক্ষাৎকারটি ২৭ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।

বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে চান মন্ত্রীও : গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘ড্যাপ রিভিউ কমিটির দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন কোনো বিষয়ে তার মন্ত্রণালয় কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না। বরং তদন্তের জন্য দুদককে সব রকম সহায়তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক বিষয় যে, তার মন্ত্রণালয়ের বিগত দিনের একটি বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। অথচ তিনি আগে যখন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তখন কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ নিয়ে দুদক কেন, অন্য কোনো সংস্থার তদন্তের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এখন এসব প্রশ্ন উঠছে কেন?’ মন্ত্রীর এ সাক্ষাৎকারটি ২০ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।

যে আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি : বিগত সরকারের আমলে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির দেয়া সুপারিশ কার্যবিবরণী চূড়ান্ত করার সময় পরিবর্তন হয়ে গেলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি আবাসন কোম্পানির পক্ষ থেকে গত বছর ৩১ অক্টোবর কমিটির সভাপতি বরাবর আবেদন করা হয়। কিন্তু উপ-কমিটির সভাপতি সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা আবেদনটি নিষ্পত্তি করে যাননি। ফলে মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে এটিও এখন একটি বড় প্রশ্ন। এ ধরনের আবেদন যে কমিটি নিষ্পত্তি করেনি এবং নিষ্পত্তি করার ন্যূনতম উদ্যোগও নেয়নি সেই কমিটির সুপারিশ কিভাবে আমলযোগ্য হবে? পূর্বের উপ-কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান, সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন প্রমুখ।

ছাড়পত্রের কী হবে : বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী পূর্ত মন্ত্রণালয়কে কোনো আবাসন প্রকল্প অনুমোদন দিতে হলে অনেকগুলো শর্ত পূরণের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নেয়াও অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ প্রকল্প এলাকায় সরকারি কোনো স্বার্থ বা সরকারের কোনো জমি নেই মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা এসি ল্যান্ড অফিসকে ডিসি অফিসের মাধ্যমে এ বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। কিন্তু আজকের সভার প্রধান এজেন্ডা হিসেবে বসুন্ধরা হাউজিং কোম্পানির ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি (প্রা.) লিমিটেডের প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারের ৮শ’ একর খাস জমি ও ভাওয়াল রাজ এস্টেটের রয়েছে আরও ২১৬ একর জমি। এ বিষয়ে ডিসি অফিসসহ ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকের কার্যবিবরণী ও তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কী এই প্রকল্পের সমুদয় জমির বিষয়ে না দাবি ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে? আর যদি না নেয়া হয় কিংবা ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে সরকারি জমি ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তি দেখিয়ে গায়েব করে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয় তাহলে বিতর্কিত এই জমি কী মন্ত্রিসভা কমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসন প্রকল্প হিসেবে সম্মতি দিতে পারে? সচেতন মহল মনে করেন, মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যদের উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেয়া সমীচীন হবে।

এমতাবস্থায় ভুক্তভোগী মহলের অনেকে মনে করেন, এসব নানামুখী যৌক্তিক প্রশ্ন ও ড্যাপের বিষয়ে দুদক, রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-কমিটির সুপারিশ অনুমোদনে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক আহবান করা কিছুটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবে যেহেতু মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং বিষয়টি এখনও পেন্ডিং তাই সৃষ্ট সংকট নিরসনের জন্য এ বৈঠক বসতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সচেতন মহল মনে করেন, বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য সমীচীন হবে না। বরং বিষয়টিকে একেবারে বিতর্কমুক্ত করতে মন্ত্রিসভা কমিটি এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির বিতর্কিত সুপারিশসমূহ আমলে না নিয়ে নতুন করে একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য ড্যাপ প্রণয়নে আগে নীতিমালা প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন : বিদ্যমান ত্র“টিপূর্ণ ড্যাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরাসহ সচেতন রাজধানীবাসী মনে করেন, মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এবং মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে ড্যাপ সংশোধন করা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা এক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে কোনো নীতিমালা নেই। আর রাজউকের টেকনিক্যাল কমিটিও নানা কারণে বিতর্কিত ও প্রভাবিত। মোদ্দ কথা, কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা সদস্যের প্রভাব বিস্তার করার অবাধ সুযোগ থাকে। ফলে এভাবে ড্যাপ সংশোধন করা হলে নানারকম বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। যার নজির ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটি স্থাপন করেছে। কেননা শুধু বসুন্ধরা হাউজিং প্রকল্প ছাড়া আর কোনো হাউজিং কোম্পানির আবেদন আমলে নিয়ে সুপারিশ করা হয়নি। অথচ যেসব প্রকল্পের দ্বারা কখনও বন্যার পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে না কিংবা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে না, এমন প্রকল্প এলাকাকেও সংরক্ষিত জলাধার দেখিয়ে বাদ দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণে এ ধরনের উদ্যোগ বিতর্কমুক্ত ও একই সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে হলে এ বিষয়ে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। তাই ভুক্তভোগীদের একান্ত নিবেদন এই যে, মন্ত্রিসভা কমিটির বিজ্ঞ সদস্যরা অবশ্যই এর তাৎপর্য বিবেচনায় নেবেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে রাজধানীকে নিয়ে একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়, যা ২০১০ সালে এসে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু নানাভাবে বিতর্কিত এই ড্যাপ বাস্তবায়ন করা নিয়ে শুরুতেই রাজউক বা সরকার জনরোষের মুখে পড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ এবং ওয়েবসাইট ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত জনমত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে ড্যাপ চূড়ান্ত করার জন্য ওই বছর ২৭ জুন ৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়। যার আহবায়ক ছিলেন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই কমিটির সহযোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ৮ জন সচিব। মন্ত্রিসভা কমিটি তিন বছরে মাত্র ২টি সভা করে। শেষ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় পাঁচশ’ আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ রিপোর্ট দেয়ার জন্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি সভাশেষে সুপারিশ প্রণয়ন করে। কিন্তু যেসব সুপারিশের বেশির ভাগই বিতর্কিত ও রাজধানীকে জলাবদ্ধমুক্ত রাখার পরিপন্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠিত হলে গত ২২ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। তবে নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বহাল আছেন। আর গৃহায়ন ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন হয়েছেন ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক।


 

সাবমিট

ড্যাপ প্রশ্নে কী গুরুত্ব পাবে জনস্বার্থ না ব্যক্তিস্বার্থ?

 যুগান্তর রিপোর্ট 
১৮ মার্চ ২০১৪, ১২:০০ এএম  | 

দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও ড্যাপ (ডিটেল এরিয়া প্ল্যান) রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অবশেষে বসতেই যাচ্ছে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আজ দুপুরে এ বৈঠক হওয়ার কথা। বৈঠকের এজেন্ডায় প্রথমে থাকছে বিগত সরকারের সময় গঠিত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির রেখে যাওয়া বিতর্কিত সুপারিশ অনুমোদনের প্রস্তাব। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে এমন একটি বহুল আলোচিত আবাসন প্রকল্পকে ড্যাপের বিভিন্ন শর্ত থেকে মুক্ত করাসহ জলাধার বেষ্টিত বেশ কয়েকটি ব্লককে আরবান এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া কার্যবিবরণীতে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির সুপারিশ পরিবর্তন করে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ তো আছেই। সূত্র জানিয়েছে, মূলত মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে এটিই প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং এ কারণেই আজকের সভা আহবান করা হয়েছে।

এদিকে ড্যাপের বিধিনিষেধের মধ্যে আটকাপড়া ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শেষ পর্যন্ত উপ-কমিটির রেখে যাওয়া বিতর্কিত ও সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী সুপারিশ অনুমোদন করলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠবে। কেননা যে আবাসন প্রকল্পে সরকারের খাস জমিসহ সাধারণ মানুষের অনেক সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে এবং সরকারি বিভিন্ন জরিপ ও ডকুমেন্ট অনুযায়ী যেসব এলাকা বন্যাপ্রবণ ও ভূমিকম্প জোন হিসেবে সংরক্ষিত থাকার কথা তা যদি ড্যাপের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয় তাহলে মন্ত্রিসভা কমিটির সততা নিয়ে নির্ঘাত জনমনে প্রশ্ন উঠবেই। তাই সমাজ সচেতন সাধারণ অনেক নাগরিকের মতো ভুক্তভোগীরা মনে করেন, ড্যাপ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অবশ্যই বসতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে বৃহত্তর জনস্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে হলে এভাবে মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে ড্যাপে নির্ধারিত জলাধার ও বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি সংশ্লিষ্ট এলাকাকে আবাসন প্রকল্প হিসেবে অনাপত্তি দেয়া মোটেই সমীচীন হবে না। বরং রাজধানী ঢাকাকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি একটি আধুনিক রাজধানী শহর গড়ে তোলার জন্য সরকারের সামনে এ মুহূর্তে একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা বেশি প্রয়োজন। আর তাই ড্যাপ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সরকার তথা মন্ত্রিসভার কাছে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করলে তা হবে যুগান্তকারী।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী অতীতের তুলনায় এবার দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে খুবই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। ঘরে-বাইরে সর্বত্র দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স দেখাতে তিনি বদ্ধপরিকর। ফলে এ রকম একটি অবস্থায় ড্যাপ সংশোধনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয় তাহলে কোনো অবস্থাতেই দুর্নীতি দমন কিংবা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। কেননা, স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে বর্তমানে জমিই সবচেয়ে মূল্যবান। আর ঢাকা শহর হলে তো কথাই নেই। সবকিছু বাড়লেও জমি বাড়ার সুযোগ নেই। তাই মহামূল্যবান জমি নিজের নামে কিংবা আবাসন প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য একশ্রেণীর অসাধু আবাসন ব্যবসায়ী সবকিছু করতে প্রস্তুত। যদি একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি কব্জা করা যায় তাহলে ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে তারা তাই করবে। সঙ্গত কারণে সমন্বিত নীতিমালা ছাড়াই ড্যাপ সংশোধনের ক্ষেত্রে যেভাবে মন্ত্রিসভা কমিটি, উপ-কমিটি ও রাজউকের টেকনিক্যাল কমিটিকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে এ ধরনের অবাধ দুর্নীতি করার সুযোগ কোনো অবস্থাতে বন্ধ করা যাবে না।

এছাড়া যে উপ-কমিটির সুপারিশ নিয়ে এত বিতর্ক সেই উপকমিটির দু’জন প্রভাবশালী সদস্য সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ও সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন এখন দুদকের কাঠগড়ায়। তাদের বিপুল পরিমাণ আয়বহির্ভূত সহায়-সম্পত্তির বৈধতা নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তাদের দুদকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। এছাড়া উপকমিটির আহ্বায়ক সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা ও অন্যতম সদস্য পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও এবারকার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। ফলে তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ যদি ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে তাহলে নবগঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির ভূমিকা নিয়ে জনমনে অবশ্যই সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হবে।

এ পর্যায়ে সচেতন মহল মনে করেন, শেষ পর্যন্ত যদি এভাবে কমিটির ওপর ছেড়ে দিয়ে ড্যাপকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে দুর্নীতি দমনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার আশংকা থেকে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তিসহ ব্যক্তিমালিকানার অবিক্রীত অনেক সম্পত্তিও প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ী গ্র“প গ্রাস করে ফেলবে। কিন্তু এতে করে বর্তমান সরকারকে ভবিষ্যতে বড় ধরনের মাশুল দিতে হতে পারে। কেননা এখনকার দুদক যদি বিষয়টিকে শক্ত হাতে ধরতে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকার পরিবর্তন হলে এ বিষয়টি ফের দুদকে নিয়ে যাওয়া হবেই। রাজনৈতিক কারণে হলেও দুদককে দিয়ে তখন সাঁড়াশি পদক্ষেপ গ্রহণ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এটি ঐতিহাসিক কালচার। আর এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি যেহেতু দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তাই দুদককে অভিযোগ প্রমাণ করা নিয়ে বেগ পেতেও হবে না। ফলে বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্টদের সে সময় বড় ধরনের একটি দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি অবশ্যই হতে হবে।

দুদক যা বলেছে : ড্যাপ সংশোধনে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিষয়ে ১২ ফেব্র“য়ারি দুদকের মহাপরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত) জিয়াউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কী ধরনের অনিয়ম করেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাদের হাতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে দেখতে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাই তিনি মনে করেন, দুদকের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ড্যাপ রিভিউ করা নিয়ে রাজউক কিংবা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির পরবর্তী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা সঠিক বা উচিত হবে না’ এ বিষয়ে ১৩ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

রাজউক চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য : যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ২৬ ফেব্র“য়ারি রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেন, ‘ড্যাপ রিভিউ উপ-কমিটির দুর্নীতির কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ নিয়ে দুদকে তদন্তাধীন কোনো বিষয়ে রাজউক কোনো পদক্ষেপ নেবে না। এরই মধ্যে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও ফাইল তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কাজে রাজউক সব ধরনের সহায়তা করবে।’ এছাড়া এক প্রশ্নের জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্র“পের বারিধারা আবাসন প্রকল্পে ৩০৫ একর পর্যন্ত রাজউকের অনুমোদন আছে এবং এই প্রকল্পে আর কোনো জমির অনুমোদন নেই।’ রাজউক চেয়ারম্যানের এই সাক্ষাৎকারটি ২৭ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।

বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে চান মন্ত্রীও : গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘ড্যাপ রিভিউ কমিটির দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন কোনো বিষয়ে তার মন্ত্রণালয় কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না। বরং তদন্তের জন্য দুদককে সব রকম সহায়তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক বিষয় যে, তার মন্ত্রণালয়ের বিগত দিনের একটি বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। অথচ তিনি আগে যখন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তখন কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ নিয়ে দুদক কেন, অন্য কোনো সংস্থার তদন্তের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এখন এসব প্রশ্ন উঠছে কেন?’ মন্ত্রীর এ সাক্ষাৎকারটি ২০ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।

যে আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি : বিগত সরকারের আমলে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির দেয়া সুপারিশ কার্যবিবরণী চূড়ান্ত করার সময় পরিবর্তন হয়ে গেলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি আবাসন কোম্পানির পক্ষ থেকে গত বছর ৩১ অক্টোবর কমিটির সভাপতি বরাবর আবেদন করা হয়। কিন্তু উপ-কমিটির সভাপতি সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা আবেদনটি নিষ্পত্তি করে যাননি। ফলে মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে এটিও এখন একটি বড় প্রশ্ন। এ ধরনের আবেদন যে কমিটি নিষ্পত্তি করেনি এবং নিষ্পত্তি করার ন্যূনতম উদ্যোগও নেয়নি সেই কমিটির সুপারিশ কিভাবে আমলযোগ্য হবে? পূর্বের উপ-কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান, সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন প্রমুখ।

ছাড়পত্রের কী হবে : বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী পূর্ত মন্ত্রণালয়কে কোনো আবাসন প্রকল্প অনুমোদন দিতে হলে অনেকগুলো শর্ত পূরণের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নেয়াও অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ প্রকল্প এলাকায় সরকারি কোনো স্বার্থ বা সরকারের কোনো জমি নেই মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা এসি ল্যান্ড অফিসকে ডিসি অফিসের মাধ্যমে এ বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। কিন্তু আজকের সভার প্রধান এজেন্ডা হিসেবে বসুন্ধরা হাউজিং কোম্পানির ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি (প্রা.) লিমিটেডের প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারের ৮শ’ একর খাস জমি ও ভাওয়াল রাজ এস্টেটের রয়েছে আরও ২১৬ একর জমি। এ বিষয়ে ডিসি অফিসসহ ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকের কার্যবিবরণী ও তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কী এই প্রকল্পের সমুদয় জমির বিষয়ে না দাবি ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে? আর যদি না নেয়া হয় কিংবা ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে সরকারি জমি ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তি দেখিয়ে গায়েব করে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয় তাহলে বিতর্কিত এই জমি কী মন্ত্রিসভা কমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসন প্রকল্প হিসেবে সম্মতি দিতে পারে? সচেতন মহল মনে করেন, মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যদের উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেয়া সমীচীন হবে।

এমতাবস্থায় ভুক্তভোগী মহলের অনেকে মনে করেন, এসব নানামুখী যৌক্তিক প্রশ্ন ও ড্যাপের বিষয়ে দুদক, রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-কমিটির সুপারিশ অনুমোদনে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক আহবান করা কিছুটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবে যেহেতু মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং বিষয়টি এখনও পেন্ডিং তাই সৃষ্ট সংকট নিরসনের জন্য এ বৈঠক বসতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সচেতন মহল মনে করেন, বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য সমীচীন হবে না। বরং বিষয়টিকে একেবারে বিতর্কমুক্ত করতে মন্ত্রিসভা কমিটি এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির বিতর্কিত সুপারিশসমূহ আমলে না নিয়ে নতুন করে একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য ড্যাপ প্রণয়নে আগে নীতিমালা প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন : বিদ্যমান ত্র“টিপূর্ণ ড্যাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরাসহ সচেতন রাজধানীবাসী মনে করেন, মন্ত্রিসভা উপ-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এবং মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে ড্যাপ সংশোধন করা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা এক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা কমিটির সামনে কোনো নীতিমালা নেই। আর রাজউকের টেকনিক্যাল কমিটিও নানা কারণে বিতর্কিত ও প্রভাবিত। মোদ্দ কথা, কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা সদস্যের প্রভাব বিস্তার করার অবাধ সুযোগ থাকে। ফলে এভাবে ড্যাপ সংশোধন করা হলে নানারকম বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। যার নজির ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটি স্থাপন করেছে। কেননা শুধু বসুন্ধরা হাউজিং প্রকল্প ছাড়া আর কোনো হাউজিং কোম্পানির আবেদন আমলে নিয়ে সুপারিশ করা হয়নি। অথচ যেসব প্রকল্পের দ্বারা কখনও বন্যার পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে না কিংবা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে না, এমন প্রকল্প এলাকাকেও সংরক্ষিত জলাধার দেখিয়ে বাদ দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণে এ ধরনের উদ্যোগ বিতর্কমুক্ত ও একই সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে হলে এ বিষয়ে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। তাই ভুক্তভোগীদের একান্ত নিবেদন এই যে, মন্ত্রিসভা কমিটির বিজ্ঞ সদস্যরা অবশ্যই এর তাৎপর্য বিবেচনায় নেবেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে রাজধানীকে নিয়ে একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়, যা ২০১০ সালে এসে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু নানাভাবে বিতর্কিত এই ড্যাপ বাস্তবায়ন করা নিয়ে শুরুতেই রাজউক বা সরকার জনরোষের মুখে পড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ এবং ওয়েবসাইট ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত জনমত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে ড্যাপ চূড়ান্ত করার জন্য ওই বছর ২৭ জুন ৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়। যার আহবায়ক ছিলেন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই কমিটির সহযোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ৮ জন সচিব। মন্ত্রিসভা কমিটি তিন বছরে মাত্র ২টি সভা করে। শেষ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় পাঁচশ’ আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ রিপোর্ট দেয়ার জন্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি সভাশেষে সুপারিশ প্রণয়ন করে। কিন্তু যেসব সুপারিশের বেশির ভাগই বিতর্কিত ও রাজধানীকে জলাবদ্ধমুক্ত রাখার পরিপন্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠিত হলে গত ২২ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। তবে নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বহাল আছেন। আর গৃহায়ন ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন হয়েছেন ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র